অকালপক্ক
ঝুম্পা মন্ডল,
ডায়মন্ড হারবার, দঃ ২৪-পরগনা
মফস্বলে গড়ে ওঠা নতুন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ক্লাস সেভেনের বাচ্চার
মায়েদের একটা হোয়াটস্যাপ গ্ৰুপে মাঝে মাঝে আলোচ্য বিষয় হয়ে যায়
সৌমাল্যর মা সোমদত্তা সেন।
অবশ্য আলোচনায় থাকার অন্যতম কারণ তিনি ডিভোর্সি, মফস্বলী মানুষের কাছে
ডিভোর্সী মানে আজব প্রাণীর মত ইন্টারেস্টিং, তার উপর তিনি যদি সুন্দরী,
স্টাইলিশ..চাকুরীজীবি হন।
সোমদত্তা এখানকার ব্যাংকে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন মাসছয়েক হলো।
কখনো সখনও ছেলেকে স্কুলে দিতে বা নিতে এলে কারোর সাথে কথাই বলেননা
!.অন্যান্য বাচ্চাদের মায়েরা পাত্তা না পেয়ে মুখ বেঁকিয়ে ভাবে.. এত্ত
ঘ্যাম কিসের?
তাই সোমদত্তার সেই ঘ্যাম হোয়াটস্যাপ গ্রূপে সমালোচনার মাধ্যমেই ভেঙে
দেবার প্রবল চেষ্টায় থাকে হোয়াটস্যাপ গ্ৰুপের মায়েরা।
আজ গার্জিয়ান মিটিং, মিটিং শুরু করার আগে গার্জেনদের জটলা হচ্ছে একটা
সাংঘাতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে, অবশ্যই ঘটনার কেন্দ্রে সোমদত্তা।
".. যেমন মা.. তেমন ছেলে.." মুখ বেঁকাল রিমির মা।
বিপ্রতীপের মা বললো," হবেই তো, বাপ তো দেখেনা, ডিভোর্সি মায়ের ছেলে, কেমন
হবে আর !!"
শুভর মা রিমির মায়ের গা ঠেলা দিয়ে বললো.."নামেই চাকরি করে.. আসল শিক্ষার
অভাব আর কি।"
ঈশানির মা শুভর মাকে সাপোর্ট করে বললো.." তা নয়তো কি? নইলে এসব এই টুকু
বয়সে শিখলো কিভাবে..?"
রাজদীপের মা বলল..." আমার ছেলে এমন বলছে দেখলে টেনে একটা চড় মারতাম।"
সোমদত্তা একটু দূরেই একটা চেয়ারে বসে ছিল , গার্জিয়ানদের এসমস্ত কথা
তার কানে আসছিল একটু আধটু , হয়তো তাকে শুনিয়েই কথাগুলো বলা হচ্ছিল।
তবে সোমদত্তার আত্মসম্মান বোধ এসব ছোটখাটো বিষয়ে একেবারেই পাত্তা
দেয়না।
বিপ্রতীপ'এর মা বলল... "গার্জেন মিটিংয়ে আমাদের এটা তোলা উচিত, একটা
বাচ্চার এই বয়সে ওরকম বেড়ে পাকা কথা শুনে আমাদের ছেলে গুলোও নষ্ট হয়ে
যাবে।"
সবাই এক কথায় সায় দিলো.. "ঠিক কথা।"
মনে মনে বেশ খুশিও হলো গার্জেনরা .. এতদিনে নাগালের মধ্যে পেয়েছে
তারা।"
***********
আলোচ্য বিষয়ের ঘটনাটা গত কালকেই ঘটেছিলো, টিফিন আওয়ার্সে স্কুলের মাঠে
সবাই টিফিন খাচ্ছে, কেউবা খেলছে।
সৌমাল্য টিফিন নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করল রুমের
ফোর্থ বেঞ্চের কোনে তাদের ক্লাসের নতুন মেয়ে দীপশিখা মাথা নিচু করে বসে
আছে, দীপশিখা সবে মাস তিনেক হলো এই স্কুলে ভর্তি হয়েছে, তার সাথে
সৌমাল্যর বিশেষ আলাপ নেই।
একটু অবাক হয়ে তার কাছে গিয়ে বুঝলো বন্ধু কাঁদছে, জিজ্ঞেস করার পরেও
দীপশিখা কিছু বলেনা।
কিন্তু কেমন ভয় পেয়ে কাঁদতে থাকে, শেষে অনেকবার জিজ্ঞাসার পরে সৌমাল্য
জানতে পারে.. কিভাবে যেন দীপশিখার কেটে গিয়েছে.. সে বুঝতে পারছেনা, তার
পিছনের স্কার্টে,ব্লেজারে, বেঞ্চে যেখানে বসে ছিলো.. সেখানে রক্ত ভরে
গেছে।
রক্ত দেখে সৌমাল্যও ঘাবড়ে গেল বেশ। কি করা উচিৎ ভেবে পেলোনা সে, বন্ধুর
কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বললো, "কাঁদিস না..." কিন্তু মনের
মধ্যে দুশ্চিন্তা হলো তারও। শিগগিরই ম্যাম দের বলতে হবে ভাবতে গিয়েই
পরোমুহূর্তে মায়ের বলা কিছু কথা মনে করে ভুরু কুঁচকে গেলো তার, মনে
স্বস্তি এনে দীপশিখাকে আস্বস্ত করে বললো.. "ভয় পাসনা বন্ধু, এটা নরমাল
ব্যাপার। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
দীপশিখা জল ভরা চোখে অবাক হয়ে তাকালো সৌমাল্যর দিকে।
সৌমাল্য নিজের গায়ের ব্লেজারটা খুলে দীপশিখাকে বললো "এটা এখন কোমরে জড়িয়ে
নে।"
তারপরে আবার বললো..."আমার মা বলেছিলো.. এমন কারোর হলে ভয়
পাবেনা...হাসাহাসি করবেনা, লজ্জাও পাবেনা, বন্ধুকে সচেতন করবে নয়তো সবার
আগে ম্যামকে জানিয়ে তাকে সাহায্য করবে ।"
দীপশিখা ভরসা পেয়ে বললো... "সত্যি তোর মা বলেছে? ভয়ের কিছু নেই? "
সৌমাল্য হেসে বললো.. "হ্যাঁরে বন্ধু.. আমার মা বলেছে.."যা এখন মিসের কাছে
যা, সমস্যাটা বল ।"
সৌমাল্যর ব্লেজারটা কোমরে বেঁধে ভরসা পেয়ে দীপশিখা সৌমাল্যর হাতটা টেনে
বললো.. "তুইও আমার সাথে চল না রে ।"
ঠিক এই মুহূর্তে রাজদীপ ক্লাস রুমে ঢুকে তাদের দেখে অবাক হয়ে মুচকি হেসে
বললো.." ওবাবা.. এটা কি হচ্ছে রে!! কিরে দীপশিখা..এমনিতে তো আমাদের কারোর
সাথে কথাই বলিসনা...আর এখন??
দীপশিখা চুপ করে মাথা নিচু করে নিতেই, রাজদীপ ফের বললো..." সৌমাল্য বুঝি
তোর বয়ফ্রেন্ড ? ওর হাত ধরে টানছিস যে.. !! "
দীপশিখা সৌমাল্যর হাত ছেড়ে দিয়ে আরও সংকুচিত হয়ে গেলো।
সৌমাল্য রেগে বললো... "কি যাতা বলছিস...বয়ফ্রেন্ড কিরে... ফ্রেন্ড হই
আমরা।"
রাজদীপ ফিচকে হেসে বললো..." বললেই হবে !! আমি নিজের চোখে দেখলাম দীপশিখা
তোর হাত ধরে টানছে" বলে আর কিছু বলার অপেক্ষা না করে নতুন কিছু
আবিষ্কারের আনন্দে .." দাঁড়া আগে এই নতুন খবরটা সবাইকে দিই। "
বলেই দৌড়ে গেলো মাঠে...তার দেখা এই নতুন আবিষ্কারের খবরটা সবাইকে
দিতে।
রাজদীপ চলে যেতেই সৌমাল্য বলল... "তাড়াতাড়ি চল.. নইলে ওরা সবাই এসে আরও
উল্টোপাল্টা কথা বলবে।"
দীপশিখা লজ্জায় বললো... "আমি মিসকে বলতে পারবোনা, তুই বলবি মিস কে?"
"আচ্ছা বাবা..বলবো, এখন চল। " বলে সৌমাল্য দীপশিখাকে সঙ্গে নিয়ে স্টাফ
রুমের সামনে গেলো।
অরুনিমা মিসকে সামনে পেয়ে সৌমাল্য বললো.. "ম্যাম দীপশিখার শরীরটা খারাপ..
ব্লিডিং হচ্ছে খুব।"
দীপশিখা আর সৌমাল্যর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বুঝেই অরুনিমা মিস থতমত খেয়ে
যান। সৌমাল্যর মুখে ভাবলেশহীন ভাবে খবরটা শুনে থতমত খায় তাঁরা।
নিজের কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুহূর্ত কাটিয়ে তৎক্ষনাৎ ব্যবস্থা নেন মিস।
প্রাথমিক ব্যবস্থার পরে দীপশিখার কাছ থেকে সৌমাল্যর বলা কথাটা শুনে
অরুনিমা মিস প্রিন্সিপাল ম্যামকে সব জানিয়ে দীপশিখার মাকে ফোন করেন..
মেয়েকে বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য।
তারপর প্রিন্সিপাল ম্যামকে অরুনিমা ম্যাম বললেন সৌমাল্যর মা নাকি এসব
ছেলেকে বলেছেন।
প্রিন্সিপাল ম্যাম একটু অবাক হলেন.. তারপর সৌমাল্যকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন.. "দীপশিখার কাছে শুনলাম তোমার মা তোমাকে এই ব্যাপারে কিছু বলেছেন,
.. বলো শুনি কি শিখিয়েছেন মা ?"
সৌমাল্য নির্দ্বিধায় বললো.. "মা বলেছে..যদি কখনো কোনো বন্ধুকে এমন
ব্লিডিং হতে দেখো, তাহলে তাকে হেল্প করবে, হাসাহাসি করবেনা, সাহস দেবে..
কারণ এটাতে ভয়ের কিছু নেই, এইরকম হয় বলেই মায়েরা মা হতে পারে..যেমন আমার
মা।"
প্রিন্সিপাল ম্যাম মৃদু হাসলেন.. আর কিছু বললেন না।
** ** ** ***
ব্যাপারটা যেভাবেই হোক গার্জিয়ানদের কানে যায়,
আর গার্জিয়ানদের চিন্তার শেষ থাকে না, এমন অকালপক্ক ছেলের সাথে মিশলে
তাদের ছেলেদের খারাপ হতে বেশি সময় লাগবে না, সেটাই মিটিঙে জানানোর
সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
মিটিং এ পড়াশোনা সংক্রান্ত এটা-সেটা কথা বলার পরে রাজদীপের মা উঠে
দাঁড়িয়ে গতকালের কথা উল্লেখ করে বলেন... "এই বয়সে ছেলেরা যদি.. এমন পেকে
যায়.. তাহলে স্কুলের পরিবেশ উচ্ছন্নে যাবে। "
ঈশানীর মা বললো .." এই বয়সে এসব মাথা ঢুকানোর দরকার কি আছে? "
বলাই বাহুল্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মায়েরা সবাই সাপোর্ট করল তাদের।
সবাই মিলে ছেলেকে কোন ঠাসা করছে দেখে সোমদত্তা এবারে উঠে দাঁড়িয়ে
প্রিন্সিপালের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে বললেন,
" আমার ছেলে বাড়ি গিয়ে কাল আমাকে সমস্ত কিছুই বলেছে, আমি গর্ববোধ করি
আমার ছেলে এমন করেছে বলে, আমার মনে হয় আমার ছেলে গতকাল যা করেছিলো ঠিকই
করেছিলো, মেয়েটির দিকে যথাসাধ্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা
না করে.. না বুঝে মেয়েটির অবস্থার লেগপুলিং করলে কি বেশি সম্মানজনক হতো
কি? "
গার্জিয়ান দের মধ্যে গুঞ্জন বেড়ে উঠলো।
সৌমাল্যর মা আবার বললো...
"আমি একজন ছেলের মা হয়ে আজকের দিনে সত্যিই ভয় পাই প্রতিনিয়ত... এই
ভেবে যে... আমার ছেলেটা মানুষের মত মানুষ হবে কিনা, চারিদিকে যা হচ্ছে...
অমানুষ হয়ে মেয়েদের প্রতি অসম্মানজনক কিছু করবে না তো?
আজকাল কো -এড স্কুলের সেভেনের বাচ্চারা বন্ধু-বান্ধবীদের বন্ধু মনে করে
না তারা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড হিসেবে দেখে।
আমার তো মনে হয় এটা অনেক বেশি অকালপক্কতার ফল।
প্রত্যেক ছেলের মায়েদের উচিত মেয়েদেরকে সম্মান করতে শেখানো, তাছাড়া
কোয়েড স্কুল যখন তখন যে সমস্ত বিষয় গুলোর সমস্যার সম্মুখীন তারা হতে পারে
সেগুলো আগে থেকেই বাচ্চার মায়েদের জানিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া ভালো, ওরা
প্রত্যেকে টিনেজ বয়সের সম্মুখীন হচ্ছে, ওদের এসব জানানোর মধ্যে কোন
খারাপ কিছু দেখি নাতো।"
প্রিন্সিপাল ম্যাম হাসিমুখে বললেন... "কথাগুলো আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি সবই
শুনেছি, সৌমাল্যর প্রতি আমারও কোন অভিযোগ নেই, কিন্তু কিছু গার্জেনের
অভিযোগের ভিত্তিতে প্রসঙ্গ টা উঠেছে। "
রাজদীপের মা মনে হয় হার মেনে নিতে পারছিল না, উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে
যাবেন
এমন সময় দীপশিখার মা উঠে দাঁড়িয়ে বললো.. "আমার মেয়ের সাথেই ঘটনাটা
ঘটেছে, মেয়ের মুখে শুনেছি সব, সৌমাল্য যখন সাহায্য করছিলো তখন ওদের
ক্লাসেই রাজদীপ ওদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড বলে হাসাহাসি করছিলো.. এটা
কেমন শিক্ষা !!"
রাজদীপের মা উঠে কিছু বলতে গেলে বিপ্রতীপের মা তাকে টেনে বসিয়ে দিলো।
দীপশিখার মা আবার বললো... "সৌমাল্যর প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই, ওর মা
ঠিকই করেছেন তো.. মেয়ের মুখে শুনে প্রথমে একটু অবাক হলেও আমি পরে বুঝেছি
ভুল আমারই.. মেয়েকে আগে থেকে এ বিষয়ে জানানো আমারই উচিত ছিল, তাহলে
আমার মেয়ে কাল ওই ভাবে ভয় পেয়ে লজ্জায় কাঁদতোনা একা একা , এমনিতেই একটু
চুপচাপ টাইপের.., সৌমাল্য হেল্প না করলে হয়তো লজ্জায় একা বসে কাঁদতো
কতক্ষণ ... কে জানে!!"
দীপিশিখার মায়ের কথা শুনে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সমস্ত মায়ের মুখ বন্ধ
হয়ে গেল একদম।
বলাই বাহুল্য এতদিন দীপিশিখার মাও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মধ্যে একজন
অন্যতম সদস্য ছিলেন, আজ সকালেই তিনি লেফট করেছেন এই গ্রুপ থেকে..|