অলক্ষ্মী

সুস্মিতা ভান্ডারী কর,

পাঁশকুড়া পূর্ব মেদিনীপুর

১৪ বছর বয়সে প্রথম জেনেছিলাম আমার জন্মের পর ঠাম্মা মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে পরেছিল। আমি বাবা মায়ের দ্বিতীয় কন্যা সন্তান। এই ঘটনার ঠিক দেড় বছর পর আমার ভাইয়ের জন্ম হয়। ঠাম্মা আমাকে আজীবন লক্ষ্মীছাড়ি বলে ডাকতো। ছোটো বেলাতেই বুঝে গিয়েছিলাম বাড়িতে আমার আর দিদির জন্য একরকম ব্যবস্থা আর ভাইয়ের জন্য অন্যরকম। পুজোয় ভাইয়ের চারটে জামা আমার আর দিদির একটা একটা। ভাইয়ের টিফিন বক্সে আপেল কলা মিষ্টি। আমার আর দিদির যা হোক একটা। এইসব কড়া নিয়মের বাইরে বেড়োনোর ক্ষমতা আমার মায়েরও ছিল না। দিদিও কখনও এইসব নিয়ম ভাঙার চেষ্টাও করেনি। কিন্তু আমাকে ঠাম্মার কাছে বারবার শুনতে হয়েছে এ মেয়ের বড়ো নোলা ভীষণ লোভ। এক্কেবারে অলক্ষ্মী এইচেয়ে কোথা থেকে। তবুও আমার বায়নার অন্ত ছিল না। মা মাঝে মাঝেই আমার বায়না মেটাতে সবাইকে লুকিয়ে পয়সা দিত। দিদিকে কখনও কিছু চাইতে দেখিনি।

তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। স্কুল থেকে ফিরে দেখি মার মুখ থমথমে। কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করতে পেরেছি। কিন্তু কি হয়েছে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। সন্ধ্যেবেলায় পড়তে বসে দিদি বলল তুই মাকে কেন এতো বিপদে ফেলিস বলতো? ঠাকুমা দেখেছে লুকিয়ে লুকিয়ে মা তোকে পয়সা দিচ্ছিল। এই নিয়ে কথা শুনিয়েছে।

আমার থেকে সাড়ে তিন বছরের বড় দিদি সেদিন বুঝিয়েছিল এই বাড়িতে মেয়েদের কি কি করতে নেই। মেয়েদের মুখফুটে কিছু চাইতে নেই, মেয়েদের বেশি কথা বলতে নেই, লাফাতে নেই, দৌড়াতে নেই, মেয়েদের চিৎকার করতে নেই, ঘুড়ি উড়াতে নেই, গুলি খেলতে নেই পা ছড়িয়ে বসতে নেই, হা হা করে সবার সামনে হাঁসতে নেই, সব সময় খাই খাই করতে নেই। আমি অবাক হয়ে শুনেছিলাম নেই -এর ফর্দ।

দিদিকে খুব বেশিদিন এই নেই মানতে হয়নি। আমার রোগা ভোগা দিদিটা বিয়ের ধকল মানতে না পেরে বিয়ের দুবছর পরই মাত্র ২২ বছর বয়সেই মারা যায় শশুরবাড়িতেই। সেদিন প্রথম আমার মা সারাদিন বিছানায় শুয়ে ছিল। ঠাকুমা ভাই আর বাবার মানবিকতা বোধকে সেই একদিনের জন্য একটু জাগ্রত অবস্থায় দেখেছিলাম। মাকে ওরা কেউ ফরমায়েশ দেয়নি। সত্যি বলতে এতো দুঃখের দিনেও সেদিন একটাই কথা ভেবেই ভালো লেগেছিল আমার কাক ভোরে ওঠা মা টা এই সুযোগে একটা পূর্ণ দিনের বিশ্রাম পেলো।

কলেজের এক অধ্যাপক ফাঁকা ক্লাসরুমে আমার বান্ধবীর হাত চেপে ধরেছিল। ব্যাপারটা প্রিন্সিপালকে জানাতে গেলাম তিনি বললেন গালস কলেজে ওইসব হয়েই থাকে। এইনিয়ে বেশি সোড়গোল করো না। দেখছি কি ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তিনি যে কি ব্যবস্থা নিয়েছিলেন সেটা আজ অব্ধি জানতে পারলাম না। কিন্তু আমার ভাই এই ব্যাপারটা জেনে আমাকে একটা বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিল। বাবার সামনে দাঁড়িয়ে সোজা সোজা ভাষায় আমাকে বললো তোর আর সেজেগুজে কলেজ যাওয়ার দরকার নেই। বাড়িতে বসে পড়েই পরীক্ষা দেয়ে। আমি তো দিদির মতো লক্ষ্মী মেয়ে নই। তাই অন্যের করে দেওয়া ব্যবস্থা আমার পক্ষে মানা সম্ভব হয়নি।

আমার মেয়ে বেলার আর একটা দিনের কথা খুব মনে পরে। বাড়িতে কি একটা পুজো ছিল। দিদি মাকে রান্না ঘরে সাহায্য করছে। ঠাম্মা আমাকে ঠাকুরঘরে নিয়ে প্রসাদ ঘট ফুল বেলপাতা সাজানোর প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পুজোর যোগার শেষ হলে আমারও শিক্ষা সম্পর্ণ হবে। কিন্তু আমার চোখ তখন আটকে আছে নারায়ণের জন্য সাজানো প্রসাদি নৈবেদ্যর থালায়। নৈবেদ্যর চূড়ায় চূড়ামনি হয়ে বসে আছে বেশ বড়ো সাইজের একটা নলেন গুড়ের সন্দেশ। যথা সময় পুজো শেষ হলো। মা প্রসাদ ভাগ করার তোড়জোড় করছে হঠাৎ সবকিছু সরিয়ে দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আমি সেই মহার্ঘ সন্দেশ ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলাম। মুখ ভর্তি সুস্বাদে আমি তখন অভিভূত। হুঁশ ফিরলো যখন সন্দেশ ভরা গালে মায়ের এক প্রচণ্ড চর এসে পরলো। ঠাকুমার প্রভূত গালি গালাজ থেকে বুঝেছিলাম নৈবেদ্য যতই আমার সাজানো হোক প্রসাদের সিংহ ভাগের অধিকার বাড়ির পুরুষ সদস্যদের।

দু গালে মায়ের চর খাওয়ার পর কখন জানি ঘুমিয়ে পড়েছি। অনেক রাতে মায়ের ছোঁয়ায় ঘুম ভাঙ্গলো। অভিমানে রাগে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে রইলাম। কিন্তু আমার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে মায়ের অসহায় কান্না আমাকে ঘুমাতে দিলো না।

এই ঘটনা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবো না। মরার সময় ছেলের হাতে জল না পেলে সর্গ বাস হয়না ঠাম্মার এই কথা বাবা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো। আর সেই ভাই ছিল বাবার স্বর্গে যাওয়া ইনভেস্টমেন্ট। আমার ভাই বর্তমানে ব্যাঙ্গালোরে এক বহু জাগতিক কর্ম সংস্থায় কর্মরত এবং বিবাহিত। তার অবাঙালি পরিবারকে নিয়ে এখানে নিরাপদে জীবন যাপন করছে। এ শহরে খুব একটা আসার দরকার পরে না। এলেও অফিসের ভি.আই.পি গেস্ট হাউসে থাকে। পূর্ব দক্ষিণ খোলা বিশাল ফ্ল্যাটের অভ্যস্ত জীবন এ বাড়ির সেঁতসেঁতে দেয়ালে ওদের কষ্ট হয়।

বাবা মারা গেছেন প্রায় দুবছর হলো। প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৬০% ছেলের কেরিয়ারেই খরচ করেছেন। ইনভেস্টমেন্টের পুরোটাই যে জলে গেছে সেটা সেদিন মৃত্যুর আগেও বিশ্বাস করতে পারেনি। ঠাকুমার প্রায় ৮৪ চলছে। বৃদ্ধার আর ছেলের হাতে জল পাওয়া হলো না।

আমার ছাত্র পড়ানো আর স্কুলের চাকরির টাকায় সংসারটা কোনো মতে দাঁড়িয়ে আছে।

সেদিন সবে বাড়ির দরজায় পা রেখেছি মা ছুটে এলো। তাড়াতাড়ি আয় সকাল থেকে কিছু খাচ্ছে না। বার বার তোকেই খুঁজছে। ঘরে ঢুকেই বৃদ্ধার মাথার কাছেই বসলাম। মনে হলো আমাকে দেখে যেন একটু হাঁসলো। আমার হাতে ধরা দুধের গ্লাস থেকে দু চুমুক দিয়েই আবার ক্লান্তিতে মাথাটা বিছানায় এলিয়ে দিলো। ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলো। আমি মুখটা নামিয়ে আনলাম মুখের কাছে। প্রায় আসতে নিভে যাওয়া কন্ঠে ঠাম্মা বললো " লক্ষ্মীছাড়ি বিয়ে করিস, তোর মেয়ে হতে খুব সাদ হয়"। পারলে এই বুড়িটাকে ক্ষমা করে দিস। মা আর আমি সেদিন সারারাত জেগে রইলাম। সারারাত ঠাম্মার বন্ধ চোখ থেকে গড়িয়ে পরা জল মুছলাম। এতদিন পর বৃদ্ধার কাছে আমার অলক্ষ্মী জন্ম সার্থক হলো বোধ হয়।