অমূল্য রত্নময় স্মৃতির পেটিকা

সুলেখা ভান্ডারী,

কসবা, বালিগঞ্জ

আমার বাপের বাড়ির গ্রামের নাম বনবাহাদুরপুর, থানা ডায়মন্ড হারবার। বাবার নাম অরবিন্দ, মা কমলা, বড়ো দিদি যশোদা, মেজো দিদি মনিকা তার পরে ছেলে এলো আদরের গোপাল। তারপরে সেজো দিদি উনি হলেন অলোকা, ডাক নাম তার পুতুল। আমি হলাম সুলেখা আদর করে ডাকে সবাই মানু। ছোট ভাই গৌতম। চার বোন আর দুই ভাই মিলে খুব দুষ্টুমি আর মজায় ভরা ছিল ছেলেবেলার দিন গুলি।

খুব মনে পড়ে, বাবা স্বভাবে ছিলেন ভোলা মহেশ্বর। কে খেতে পায়না, কার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার টাকা নেই, কোন পড়ুয়ার বই কেনার টাকা নেই, কোন অসুস্থ ব্যক্তির ডাক্তার দেখাবে টাকা নেই তাদের সবার জন্য বাবা সব সময় এগিয়ে আসতেন।

গ্রামে কোনো ঝামেলা হলে, গ্রামের বাৎসরিক পুজো বা কোনো অনুষ্ঠান হবে, সবার আগে বাবাকে ডাকতো। বাবা যা বলবে সেটা সবাই মেনে নিতো। তখন বিয়ে বাড়ি, পুজো বাড়ি হলে বাবা সেই সব স্বর্ণ দিনের পুরনো গান করত। আর আমরাও সবাই যেতাম খুব মজা করতাম। বাবার খুব প্রশংসা করত সবাই।

বাবা আমাদের কোনদিন বকতো না বা মারতো না। কিন্তু মা আমাদের রাশভারী। খুবই কড়াধাতের মানুষ ছিলেন মা ।খুব শাসন করতেন, সাথে প্রচুর মার ও খেতাম মায়ের কাছে।

মা হাতের কাছে যা পেতো তাই দিয়েই মার খেয়েছি।

জানোতো একবার হয়েছে কি আমি আর ভাই কি একটা দুষ্টুমি করেছিলাম, তো মা বলল -"আজকে তোদের দুজনের খাওয়া দাওয়া বন্ধ। এই কেউ ওদের একদম খেতে দিবিনা আর ডাকবিও না।" এদিকে তো একে একে বেলা অনেক হচ্ছে খুব খিদেও পাচ্ছে। মা রান্নাবান্না করে ঘরে শুয়ে আছে। আমাদের রান্না ঘরে টিনের দরজা ছিল, খুললে একটা কড় কড় করে আওয়াজ হতো। আমরা দুজনে আসতে আসতে পাঁচিল টপকে রান্না ঘরের দরজা যেই খুলেছি অমনি শব্দ শুনে মা বলে উঠলো এই কে রে? যেই না বলা অমনি পড়িমড়ি করে মারলাম দৌড়।

আরো কত কথা মনে পড়ে যায় সব সময়। মা যেমন শাসন করত তেমন ভালো ভালো শিক্ষাও আমাদের দিত। আমাদের একটা থালাতে ভাত মেখে চারজনকে চার ভাগ করে দিত। আমার কেউ ঝগড়া করতাম না। খেয়ে তাড়াতাড়ি স্কুলে যেতাম। একটা ঘন্টা পড়লে মা বলতো তাড়াতাড়ি যা ছুটে ছুটে, আর একটা ঘন্টা পড়লে স্কুলে ঢুকতে দেবেনা।

বর্ষার সময় এক হাঁটু জল, কাদা রাস্তা। কত সময় এমনও হয়েছে ছাতা নিয়ে যাইনি তাই রাস্তার ধারে কচু পাতা ছিঁড়ে মাথায় দিয়ে গেছি। মা আমাদের পাঠিয়ে দিয়ে ঠাকুরকে ডাকতো ওরা যেন ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়।

মা সব সময় বলতো স্কুলে বা কোথাও যাচ্ছো, দেখছো গরু বা ছাগল হয়তো দড়ির সাথে জড়িয়ে গেছে, তোমার যেতে দেরি হোক, তুমি দড়িটা খুলে দিয়ে যাবে। প্রখর গ্রীষ্মে জলের জন্য কোনো জীব-জন্তু কষ্ট পাচ্ছে দেখলে তাকে জল দেবে। বাসে বা ট্রেনে উঠলে কোনো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা অথবা কাউকে কোলে ছোট বাচ্চাকে নিয়ে দাড়িয়ে আছে দেখলে তুমি উঠে ওনাকে বসতে বলবে। দেখবে উনি তোমাকে অনেক ভালো বলবে।

আমরা তখন কোথাও কোনো ভালো কিছু দেখলে এনে মা কে দেখাতাম, পড়ে শোনাতাম। হয়তো কোনো ঠোঙ্গার মধ্যে কিছু কিনে এনেছি বা স্কুলে খেয়েছি তাতে ভালো ঠাকুরের ছবি, ভালো হাতের লেখা বা ভালো কবিতা বা ভালো গল্প আছে, সেটা নিয়ে এসে মা কে বলতাম, মা কে দেখাতাম, পড়ে শোনাতাম। মা বলতো তোরাও চেষ্টা করলে সব পারবি।

মা বাবা সব সময় বলতো কোথাও গেলে শিক্ষক বা শিক্ষিকা বা গুরুজনদেরকে দেখলে প্রণাম করবে। মা আমাদের সব ক্ষেত্রে সব সময় উৎসাহ দিত। কোথাও খেলা হলে নাটক, গান, কবিতা, যাত্রা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমাদেরকে সব সময় যোগদান করতে বলতো। এমনকি কোন পুজোবাড়ী, বিয়েবাড়িতে আলপনা দেওয়া, কোণে সাজানো, হরি বাসরে টাকা পুরস্কার দেওয়া সবকিছুতেই আমাদেরকে এগিয়ে দিত । সব সময় বলতো "যা যা তোরাও পারবি"।

আমি বলতাম - না আমি যাবো না, আমি প্র্যাকটিস করিনি।

মা বলত- আমি বলছি তুই পারবি, চেষ্টা করলে সব পারা যায়।

সত্যি সেই জন্য মনে হয় মা মা-ই হয়। তাই মা বাবার আশীর্বাদ সব সময় সন্তানের মাথায় থাকে। তেমনি সব জায়গায় আমার উত্তীর্ণ হতাম।

কোনো সময় কোথাও মেলা হবে, যাত্রা হবে, হরিনাম হবে বা দুর্গা ঠাকুর দেখতে যাবো। মা বলতো তোর বাবা তাড়াতাড়ি দোকান থেকে চলে আসবে তোরা স্কুল থেকে এসে তাড়াতাড়ি খেয়ে গাছপালায় জল দিয়ে দিবি।

তখন আমাদের কি আনন্দ। সব ভাই বোন মিলে বাগানের গাছে জল দিয়ে দিতাম। কলসি, বালতি, ডোঙ্গা, ছিঙ্গুনি করে জল দিতাম গাছে।

কতো রকমের সবজি - আলু, পিঁয়াজ, কুমড়ো, পটল, উচ্ছে, লঙ্কা, শশা, কপি, মুলো, বিট, শাক। কতো রকমের ফুলের ও ফলের গাছ ছিল।

রোজ ফুল তুলে পুজো করতাম। বৃহস্পতিবার হলে চাল বেটে তুলসী মঞ্চে, সব ঘরের চৌকাঠে, ঠাকুর ঘরে, ধানের গোলায় আলপনা দিয়ে লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়তাম।

আমাদের বাড়িতে প্রায়সই গান বাজনার আসর বসতো। তাতে খোল, করতাল, হারমোনিয়াম, ডিগি তবলা বাজানো হতো।

শুধু কি তাই! ঘরের চালের মুড়ি, খই, চালভাজা, ছোলা, বাদাম, মটর, চিড়ে সব ভাজতাম। মুড়ির ছাতু, গরুর দুধের সন্দেশ, নারকেল নারু, ডালের বরফি তারপর কত রকমের পিঠে, যেমন- পুলি পিঠে, মালপোয়া, পাটিসাপটা, রস বড়া, সরু চাকলি, আসকি পিঠে, তিলের নাড়ু সবই মায়ের হাতে হাতে আমরাও করতাম।

আবার কতো রকমের আচার, আমের টক মিষ্টি আচার, কুলের আচার ,চালতার আচার, আরো কত আচার মা বানাত। সেসব দেখে দেখে আমরাও শিখেছিলাম। আজ আর বাড়িতে আচার বানানো হয় না, সবই বাইরে থেকে আসে। তবে পুরনো সেইসব স্মৃতি মনের মনিকোঠায় আজও সযত্নে রাখা আছে।

মনে আছে সময়ে সময়ে খেসারির ডাল, বিউলির ডাল, মটর ডাল ইত্যাদি আগের দিন রাতে ভিজিয়ে রেখে পর দিন সকালে শিলে বেটে বড়ি দেওয়া হতো আমাদের বাড়িতে। মা বলতো তোরাও এইসব কাজ শিখে নে, তোমাদেরও করতে হবে একদিন। তবে আজকাল আর বাড়িতে ভরি দেওয়া হয় না। বড়িও আজকাল বাজার থেকেই আসে।

মা বলতো সব কাজ শিখে রাখা ভালো। আমরাও মায়ের কাছ থেকে সব শিখেছি মন দিয়ে। সবাই আমাদের খুব ভালবাসতো।

মা বাবার নাম ধরে বড়োরা তাঁদের ছেলে মেয়েদের বলতো -ওদের ছেলে মেয়েদের শিক্ষা দেখে আয়। ওরা মা বাবার কত বাধ্য, কত লক্ষী ওরা, মা-বাবার সব কথা শোনে।

আজও মনে আছে যখন খুব ছোট্ট আমরা তখন মা আমাদেরকে শিক্ষা দিত, যদি বাড়িতে কোনো আত্মীয় আসতো বা কখনো কারো বাড়িতে গেছি আর তারা কিছু খেতে দেয়, সেই দিকে যেন হ্যাংলার মতো না তাকিয়ে থাকি। কোনো খাবার যেনো তুলে না খাই। যদি মা নিতে বলে তবে নেবো।

মা সব সময় বলতো কেউ কিছু দিলে সবাই মিলে ভাগ করে খেতে হয়।

ছোট বেলায় বাবা মার সাথে কতো মামার বাড়ি, পিসির বাড়ি, মায়ের মামার বাড়ি সব জায়গায় যেতাম। পাল তোলা নৌকা করে তখন মামার বাড়িতে যেতে হতো। সে কি মজা! তা বলে বোঝাতে পারবনা।

নদীতে ভাটার সময় জল কম থাকলে অনেকটা কাদায় হেঁটে যেতে হতো নৌকায় ওঠার জন্য।

কাদায় হাঁটতে খুব মজা লাগতো। তারপর নৌকায় উঠে পা ধুয়ে পাড়ি দিতাম মামার বাড়ি। চৈত্র সংক্রান্তি বা পয়লা বৈশাখে প্রায় প্রতিবছরই মামার বাড়ি যেতাম আমরা।

সন্ন্যাসীর মেলা, চড়ক গাছ, গাজন, যাত্রা, পুতুল নাচ, মানুষ ঠাকুর, সঙ হতো ইত্যাদি হতো গোষ্টোর মেলায়।

রাধা কৃষ্ণের প্রতিযোগিতা হতো। অনেকে বাড়ির রাধা কৃষ্ণ ঠাকুর সাজিয়ে খোল করতাল বাজিয়ে প্রচুর লোক সব হরে কৃষ্ণ নাম গান করতে করতে মেলায় আসতো।

আমরাও অনেকবার মানুষ ঠাকুরের সঙ সেজেছি। কতো পুরস্কার পেয়েছি।

সেইসব দিনের কথা এখন মনে পড়লে খুব কষ্ট হয়। পয়লা গোষ্টের দিনে নিম হলুদ মাখতাম। পুকুর থেকে কত মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ধরতাম।

সকাল হলে মামা আর দাদুর সাথে তালের রস খেতে যেতাম। আবার হাটে যেতাম পাটালি, গুড়, ফুটি, তরমুজ, শশা, লংকা, কুমড়ো আরো অনেক কিছু নিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই মামাদের সঙ্গে বায়না করে মেলায় যেতাম।

মামা বলতো অনেক হাঁটা পথ, তোরা পারবিনা। গাড়ি নেই, খুব রোদ্দুর........

আমরা বলতাম না আমরা পারব যেতে।

কষ্ট হতো ঠিকই কিন্তু সে কি মজা!

একবার কি হয়েছে জানো? তখন স্কুলে আমাদের গরমের ছুটি চলছে । আমাদের বাড়িতে মামা এসেছিল, চলে যাওয়ার সময় আমি খুব বায়না করছিলাম।

আমি যাব মামার বাড়িতে মামার সঙ্গে।

মা বাবা মামা সবাই বলল- তোর যেতে হবে না।

আমার তখন এক গোঁ- আমি যাব।

তখন মামা বলল দিদি ও যাক।

রাত্রে বাঁধা ছাঁদা করে রাখলাম। আজকের মতন তখনকার দিনে এমন ট্রলি বাক্স প্যাকিং হতো না । কাপড়ের ঝোলা ব্যাগে গোটা কয়েক জামাকাপড় গুছিয়ে নেওয়া আর রাস্তায় খাবার মত কিছু শুকনো খাবার ।

মামার বাড়ি যাওয়ার আনন্দে ঘুম প্রায় হলো না বললেই চলে।

পরদিন খুব ভোর ভোর মামার সাথে মামার বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হলাম।

অনেকটা পথ বাসে এসে তারপর নৌকা।

পথে মায়ের বেঁধে দেওয়া চিড়ে মুড়কি মুড়ি ইত্যাদি খেয়েছি।

আবার বাস থেকে নেমে নৌকা ধরার আগে কাকদ্বীপের হাটে মামা চপ ফুলুরি আলুর বম কিনে খাইয়েছে।

নৌকা থেকে যখন বৈকুন্ঠপুরের ঘাটে নেমেছি তখন সূর্য প্রায় মাথার উপরে ।

বৈকুন্ঠপুরের ঘাট থেকে মামার বাড়ি মৃনাল নগর প্রায় সাড়ে তিন চার কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে পার করতে হবে, কোন গাড়ি ঘোড়ার বালাই ছিল না তখন।

তখন আমার বয়স কত হবে, বড়জোর আট - ন বছর।

নেমে হাঁটছি তো হাঁটছি রাস্তা যেন আর ফুরায় না।

মাঠের কাঁচা রাস্তা উঁচু নিচু আর তেমন রোদ্দুর।

আর হাঁটতে পারছি না।

পথ চলছি আর বারবার মামাকে জিজ্ঞেস করছি -মামা আর কত দূরে?

মামা বললে এই তো এসে গেছে।

আবার কিছুক্ষণ পর- ও মামা আর কত দূর?

মামা হাত বাড়িয়ে বললে -ওই যে সব থেকে উঁচু তালগাছটা দেখা যাচ্ছে ওইখানে মামার বাড়ি।

আর হাঁটতে পারছি না, আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। চড়া রোদ্দুরে ক্রমাগত ধুলোর ঘূর্ণি হওয়ায় নাক মুখ প্রায় জ্বালা করছে। হাত পায়ের দশা রাখালের মত।

মামা বলল তোকে বারণ করেছিলাম না। তুই তো কথা শুনলি না চলে এলি।

ঠিক আছে, এবার এই বটগাছটার তলায় বস জিরিয়ে নে, তারপর আবার যাব।

তারপর অনেক কষ্ট করে কিছুটা পথ মামার কাঁধে চেপে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে প্রায় বেলা গড়িয়ে মামারবাড়িতে পৌঁছালাম।

তবে সেই সময় আমাদের সমস্ত মামাতো মাসতুতো ভাই বোনেদের স্কুলে গরমের ছুটি চলায় আমার আরো তিন মাসির ছেলে মেয়েরা মামাতো ভাই বোন সবাই মামার বাড়িতে উপস্থিত ছিল। আমি যাওয়াতে সবাই হইহই করে উঠলো। আর ১০-১৫ দিন খুব আনন্দ করে মামাদের পুকুরে সাঁতার কেটে মাছ ধরে, বাগানের আম জাম কাঁঠাল খেয়ে তারপর বাড়ি এসেছিলাম। এখনকার প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা তো পিস্তুতো ভাই বোন, মামাতো ভাই বোন, জারতুতো ভাই বোন, খুড়তো তো ভাই বোন এসব তো চেনেই না জানেও না। সত্যিই তখনকার দিনের মজাটাই আলাদা ছিল।

তখন আমরা কত খেলা খেলেছি। লুকোচুরি, হাডুডু, চোর পুলিশ, বউ বসন্তী, গাজিকোট, কুমিরডাঙ্গা, আরো কত কি।

কলের গান, বাক্সতে চোখ দিয়ে সিনেমা দেখতাম, পটের গান, পুতুল নাচ, রাতে যাত্রা দেখে ভোরবেলা যখন ফিরতাম তখন শুনতাম চৌকিদারের বলতো- জাগতে রাহো জাগতে রাহো।

তারপর পিঠে চিঠির থলে নিয়ে ছুটে রানার চলতো এদিক থেকে ওদিক।

বৃষ্টি হলে কাগজের নৌকা বানিয়ে জলে ভাসাতাম। পুকুরের উপরের ঝুলে পড়া ডাল দিয়ে দোলা চড়তাম।

সবাই ছুটে ছুটে জলের মধ্যে ঝাঁপ দিতাম।

চুরি করে জাল নিয়ে মাছ ধরতাম। বৃষ্টিতে কই, শিং, মাগুর, শোল, লেঠা এইসব মাছ পুকুর থেকে উপরে উঠে যেত। আর আমরা বৃষ্টি ভিজে ভিজে সেই সব মাছ ধরে ধরে বালতিতে ভরতাম।

বৃষ্টি হলে লম্বা লম্বা লাফ দিয়ে পুকুর থেকে বড় বড় সোনা ব্যাঙ উঠে আসতো আর এমন করে ওপরের দিকে চেয়ে থাকতো যেন মনে হচ্ছে আমাদের দিকে দেখছে।

বৃষ্টিতে ভিজলে মা-বাবা দাদা খুব বোকতো। তাও আমরা লুকিয়ে পালাতাম। খুব মাছ ধরার নেশা ছিল কি না!

আর ছিল প্রবল গাছে চড়ার নেশা, বৃষ্টিতে গাছের গা ভিজে থাকতো। মা চেঁচাতো -ওরে গাছের গা ভিজে আছে, পড়ে যাবি, হাত পা ভেঙ্গে যাবে........

কিন্তু কে শোনে কার কথা! তবে ভালোই জানতাম এখন কানে কথা না তুললে কি হবে? এরপর যখন বাড়িতে ঢুকবো এই গাছের ডালই তখন মায়ের হাতে চড়ে আমাদের পিঠে গজাবে।

কিন্তু তবুও গাছে উঠে ডাব, আম, জাম, খেঁজুর, জামরুল আমড়া, তেতুল, কুল পেড়ে বন্ধুদের সাথে খুব মজা করে খেতাম।

কতো বন্ধু ছিল। আরতি, জয়শ্রী, কবিতা, বন্দনা, শিলা, বনানী, মায়া, মমতা, কুণ্ডু আরও কত বন্ধু ছিল।

শনিবার স্কুল থেকে দুপুরে বাড়িতে এলে মা ঘরের দরজার সামনে মাদুর পেতে শুয়ে থাকতো আর বলতো যা তাড়াতাড়ি মুখ হাত-পা ধুয়ে, ভাত খেয়ে আমার কাছে এসে শুবি।

রেডিওতে তখন শনিবারের বারবেলা হত। শ্রাবন্তী মজুমদার এংকারিং করতো। কত পুরনো দিনের গান স্বর্ণযুগের গান।

আর সোমবার সন্ধ্যেবেলায় যাত্রা হত রেডিওতে। ছুটির দিন দুপুরে ভাত খেয়ে যখন আমরা একটু গড়িয়ে নিতাম, মা বলতো আমার পিঠে একটু ঘামাচি মেরে দে তো। মারপিঠে ঘামাচি মেরে পাউডার লাগিয়ে দিতাম।

মার মাথার পাকা চুল তুলে দিতাম আর মার কাছে শোয়ার জন্য আমরা ভাই-বোনেরা সবাই ঝগড়া করতাম।

মা বলত একদিন করে সবাই শুবি।

মা যখন ধান সিদ্ধ করত, মুড়ি ভাজতো আর খুব ঘাম হতো, আমরা দেখলেই গামছা ভিজিয়ে এনে মুছে দিতাম। তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করতাম। আর বাবা দোকান থেকে এলে ছুটে গিয়ে পা ধুয়ে দিতাম। ঘাম মুছে দিতাম, মাদুর পেতে বালিশ দিয়ে বলতাম শুয়ে পড়ো। হাত পাখার বাতাস দিতাম। তারপরে শরবত দিতাম।

বাবা বাজার থেকে সেরা ফল মাছ মিষ্টি আমাদের জন্য নিয়ে আসতো।

বাজারে আমাদের খুব বড়ো ট্রেলারিং এর দোকান ছিল। অনেক কারিগর কাজ করতো। বাবা নিজের হাতে আমাদের জন্য কত সুন্দর সুন্দর ফ্রক জামা স্কার্ট টেপজামা তৈরি করে দিত। সেই সব দিনের কথা কি ভোলা যায়।

যখন একটু বড়, এই ক্লাস নাইন টেনে পড়িপড়ি, বাইরে বেরোলে শাড়ি পড়ে যাই। তখন একবার নতুন শাড়ি পড়ে ভ্যান গাড়িতে করে ডায়মন্ড হারবার ঠাকুর দেখতে যাব। ছোটবেলার মতন উপরে উঠে বসতে যাচ্ছি তখন দাদা বললো তুই পিছনে পা ঝুলিয়ে বস তোর শাড়ির কুঁচি নষ্ট হয়ে যাবে।

দাদা আমাকে খুব ভালোবাসতো।

কোথায় পতাকা উত্তোলন হবে সেখানে সবার আগে আমাকে দাঁড় করাত, ঠাকুরের গলায় মালা পরানো সব আমাকে দিয়ে করাতো।

সেই সময় আমাদের পুরো জেলায় একটাই কলেজ। দাদা তিন বছর ফকির চাঁদ কলেজের জিএস ছিল। এলাকায় খুব নাম ডাক ছিল দাদার। তাই কোথাও কিছু অনুষ্ঠান হলে দাদার ডাক পড়তো। তখন তো বড় দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে । দাদা ও জায়গা বুঝে আমাকে সাথে করে নিয়ে যেত।

দাদা আমাদের খুব শাসন ও করতো। দাদাকে দেখে খুব ভয় হত।

কিন্তু যেমন দাদা আমাদের শাসন করতো তেমনই আমাদের ভালোবাসতো। আমরা সবাই দাদাকে খুব সম্মান করি।

আমি আর ভাই পিঠাপিঠি ছিলাম। খুব ঝগড়া মারপিট করতাম, আবার হাসাহাসি ও করতাম।

পড়া যেমন তেমন শীতের সময় ছাদে রৌদ্রে বসে শুধু খাওয়া, হাসি আর ঝগড়া।

মা এসে কঞ্চি দিয়ে ধাঁই ধপা ধপ মার কাকে বলে!

যেই মা বলতো- পড়ার নাম যেমন তেমন শুধু খাওয়ার আর গল্প, আবার যদি পড়ার বদলে হাসির শব্দ পেয়েছি তো তোদের একদিন কি আমার একদিন।

বেদম মেরে মা যেই চলে যেত কান্নাকাটি ভুলে আবার মুচকে মুচকে হাসি। সেই সব দিন আজও ভুলতে পারি না।

মা সবসময় রান্না ঘরের চালের বাতায় কঞ্চির বাড়ি গুঁজে রাখত। দুষ্টুমি করলেই শপাৎ শপাৎ করে খুব মারতো।

বাবা কিন্তু আমাদের গায়ে কোনদিনও হাত দিত না।

আর আমার দুই দিদি সব কাজে ছিল তুখোড় পড়াশোনা গান-বাজনার পাশাপাশি ঘরের কাজেও ছিল ও মস্ত ওস্তাদ। মায়ের পরে সব কাজ দিদিদের থেকে শিখে বড় হয়েছি।

রবীন্দ্রনাথের সেই গানটি মনে পড়ে গেল।

-"পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায়

ও সে চোখের দেখা প্রাণের কথা তাকি ভোলা যায়"

সত্যিই এখন দুপুরে বা রাত্রে যখনই একা একা থাকি কিছুতেই ঘুম আসে না তখন সেই সব পুরনো দিনের কথা বারবার চোখের সামনে ফুটে ওঠে, যেমন ভাল লাগে তেমন আবার খুব কষ্ট ও হয়। দুচোখে জলের ধারা নেমে আসে আর মন কিছুতেই মানে না। মনে হয় আবার যদি সেই দিনগুলো ফিরে পেতাম, মা বাবাকে একবার দেখতে পেতাম...............

কিন্তু তা আর কোনদিনই হওয়ার নয়। এটাই হল বাস্তব, আর তাকে মেনে নিতেই হবে।

বাবা হল বাড়ির পিলার আর মা হল বাড়ির মাটি। তোমরা যেখানেই থাকো, ভালো থেকো। আমাদের মাথায় তোমাদের আশীর্বাদের হাত টাকে রেখো।

"তুমি আমার মা আমি তোমার মেয়ে
বলোনা মা কি পেয়েছো আমায় কোলে পেয়ে
মাগো আমায় কোলে পেয়ে"। -এই গানটা যতবার শুনি তোমার কথা খুব মনে পড়ে মা।

"আয় খুকু আয় আয় খুকু আয়
কাটেনা সময় যখন আর কিছুতেই
বন্ধুর টেলিফোনে মন বসে না
জানলার গ্রিলটাতে ঠেকাই মাথা
মনে হয় বাবা জেনো বলছে আমায়-
আয় খুকু আয় আয় খুকু আয়"। -এই গানটা শুনলে বাবার কথা আজও খুব মনে পড়ে।

তোমরা এইভাবে আমার মনের মনিকোঠায় সারাজীবন থেকো আর আমাকে আশীর্বাদ করো। সবাইকে যেন ভাল রাখতে ও ভালবাসতে পারি।

- তোমাদের সেই ছোট্ট মানু (সুলেখা)।