বিফোর টাইম
মৈত্রেয়ী ব্যানার্জি,
বালি, হাওড়া
বাড়ি ফিরতেই মা একগাদা লুচি সাদা আলুর তরকারি জোর করে খাইয়ে দিল। পেটটা
টইটুম্বুর ভরে গেছে। এরকম পেটে কাজ করা যায়! কিন্তু কোনো মা কি এসব বোঝে?
দূরছাই! এখন দৌড়াতে হবে সেই ডানকুনি। সেখান থেকে মধুশ্রী ম্যাডামকে নিয়ে
বেলুড় বাজারে পৌঁছে দিয়ে তবে মুক্তি। অবশ্য এর জন্য টাকাটা ভালই পাওয়া
যায় মধুশ্রী ম্যাডামের কাছ থেকে। এমনিতে টোটো বুক করে একা কোথাও গেলে রেট
তিনশো...আসলে দুশো হলেই ঠিক ছিল, কোভীড এসে তো সব উল্টে পাল্টে গেছে, তাই
রেট অনেকটা বাড়াতে হয়েছে। কেউ কেউ গাঁইগুই করে এতো দর নিয়ে, বলে, 'কি করে
এতো টাকা দিয়ে যাব?' যদি বুঝি পকেটে মাল্লু আছে, মুখে অমনি বলছে, তবে
বুঝিয়ে দিই, উঠবেন তো উঠুন, নাহলে ফুটুন। কাজ হয় ম্যাজিকের মত। যাত্রী
সোনা মুখ করে টোটোতে চড়ে বসে। আবার যদি দেখি রিটায়ার্ড বুড়ো দাদু, পকেটে
বেশি কিছু নেই, অথচ ভিড় বাসে উঠতে ভয় পাচ্ছে, তখন বেশ কম সম করে ভাড়া
নিয়ে যাই। তখন টাকার বদলে মাথায় হাতটাত বুলিয়ে আশীর্বাদ এক্সট্রা জোটে এই
আর কি।
আজ সক্কাল থেকেই মটকাটা গরম হয়ে আছে, সঙ্গে দমচাপা কষ্ট। রোজ খবরের কাগজ
নেওয়াটা অনেকে ট্যারা চোখে দেখে জানি, টোটো চালানো পাবলিক রোজ খবরের কাগজ
নেয়, এটাও বোধহয় একটা খবর। কিন্তু এটা আমার একটা অভ্যেস বলতে পারেন। আসলে
গ্রাজুয়েশনের দোরগোড়ায় এসেও হল না, না না, বাবা মরে যায়নি …. আসলে ওটাই
সবাই ভাবে কিনা! 'আহা!' বলতে কি যে মানুষের সুখ হয় কে জানে? পড়া কমপ্লিট
হয়নি শুনলেই বলবে, 'আহারে! বাবা মারা গেলেন বুঝি? কাঁধে গোটা সংসার এসে
পড়ল?' আরে না মশাই না, এমনিই পড়তে আর ভাল লাগল না, ছেড়ে দিলাম, ব্যস।
ফুরিয়ে গেল। মনে হল নিজে কিছু একটা করি, নিজের রোজগার। বাবা জুটমিলে এখনও
কাজ করে। দিব্যি আছে।
যা বলছিলাম, মন খারাপ হয়েছে কাগজে খড়গপুরের কুকুরের ঘটনাটা পড়ে। কতটা
শয়তান হলে মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে। আমার ইচ্ছা করে ওদের ধরে পায়ে বোম
বেঁধে দিই। উচিত শাস্তি। ওই খবর পড়ে সকালের চা টা কেমন বিস্বাদ হয়ে গেল।
তারপরই ফোন এল নীপা দিদিমণির। উত্তরপাড়া নিয়ে যেতে হবে। দিদিমনির বয়েস
হয়েছে, কিন্তু দেখতে লাগে কমবয়েসী। মাঝে মাঝে আয়না দিয়ে দেখি তো! কুর্তি
লেগিংস পরে তো আরো কম লাগে। প্রথম দিকে তো একবার ভুল করে ফেলেছিলাম। নীপা
দিদিমণির ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দিদিমণি ওর দিদি কিনা। শুনে সে কি হাসি
ওদের! আমি তো ভোমলা মেরে দাঁড়িয়ে আছি। তারপর বলে কিনা ওরা মা আর ছেলে!
তবে তারপর থেকে নীপা দিদিমণি আমার ওপর খুব খুশি। আমাকে ছাড়া অন্য টোটো
নেয়ই না। এখন বুঝি, মহিলাদের যদি বয়েস কম বলা হয় তাহলে ওরা খুব খুশি হয়।
নীপা দিদিও ওই কুকুরের খবর পড়ে খুব কষ্ট পেয়েছেন, সারা রাস্তা ওই নিয়েই
বকবক করছিলেন।
বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম বিজনকাকুর বাড়ি কান্নার আওয়াজ। খিদে পেয়েছে খুব।
সেই সকালের লুচি কখন হজম হয়ে গেছে। ভাগ্যিস মা জোর করে লুচিটা গিলিয়েছিল।
না হলে এতক্ষণে আকাশ পাতাল সব খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করত। কিন্তু কেসটা কি?
এরা কাঁদে কেন! আমার একটা খুব বদভ্যাস আছে, লোকের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার,
মায়ের বক্তব্য। টোটো থামিয়ে নামলুম। এক পাড়ায় বাড়ি, যদিও বিজনকাকু আমাকে
খুব তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখেন। গ্র্যাজুয়েট নই, টোটো চালাই, পান মসলা
খাই না, গুটকা খাই না। দেখেছেন, আপনাদের কি একপেশে ধারণা, টোটো চালালেই
গুটকা খেতে হবে আর পিচিক পিচিক করে রাস্তায় থুথু ফেলতে হবে। না। আমি মুখে
মাস্ক পড়ি। রাস্তায় থুথু ফেলি না। আমার ব্যাথা অন্য জায়গায়।
এই বিজনকাকুর একটা পরী আছে। বুঝলেন না! মেয়ে, ঠিক নীল পরীর মত দেখতে।
ডাক্তারি পড়ে। সবে ঢুকেছে। মেডিকেল কলেজে। মাঝে মাঝে আসে হোস্টেল থেকে।
আমার টোটোতে চেপে ও বাড়ি ফেরে কোনো কোনো দিন। আমি সেদিন টোটোর বদলে
হেলিকপ্টার চালাই। মানে, মনে ভাবি আর কি। মেয়েটা বাপের মত নাক উঁচু নয়।
কথা বলে খুব। গলাটা কি মিষ্টি। রিনরিন করে বাজে কানের কাছে। বলে, "তুমি
পড়লে না কেন রাজুদা? পড়াটা কমপ্লিট করতে পার তো এখনও। তারপর তোমার
স্বাধীন ব্যবসা করতে তো বাধা নেই।" একেবারে আমার মনের কথা ঠিক বলে
দিয়েছে। স্বাধীনভাবে বাঁচবো বলেই তো টোটো চালাই। যখন খুশি, যতক্ষণ খুশি
চালাই। ইচ্ছে না হলে বাড়িতে শুয়ে মায়ের বকবকানি শুনি। আমার ভারী ভাল
লাগে। মা সারাদিন কাজ করে আর উসটুম ধুসটুম বকে। কোনো কথার সঙ্গে কোনো
কথার লিংক নেই, তবু ভাল লাগে।
যাইহোক, এখন দেখি নীল পরীর বাড়ি কান্নাকাটি কেন। গেট খুলে ঢুকতে গিয়ে
দেখি পাশের বাড়ির দোতলা থেকে মিত্তির জেঠি আর মান্না কাকু উঁকি মারছে।
সানগ্লাসটা মাথায় তুলে শাহরুখের মত পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলাম, "ও
জেঠি! ও মান্না কাকু! বাইরে থেকে উঁকি দিয়ে কি দেখছেন? নেমে এসে দেখুন
না, বিপদ হয়েছে কিছু নিশ্চয়ই।" ওমা! দুটো মুখই টুক করে সরে গেল। আশ্চর্য
মানুষ মাইরি! উঁকি মেরে দেখবে, কিন্তু সাহায্য করার বেলা নেই। কাল তো নীল
পরী এসেছে বাড়ি। পুজোতে আসেনি এবার। পড়ার চাপ আছে বোধহয়। ডাক্তারিতে নাকি
গাঁতিয়ে পড়তে হয়। আর এই মোটা মোটা বই পড়তে হয়। কি করে জানলুম? আরে হায়ার
সেকেন্ডারি তো পাশ করেছি। আমার খুব বন্ধু ছিল অয়ন। ক্লাসের ফার্স্ট বয়। ও
এখন ইন্টার্নশিপ করছে। ওর কাছেই অনেক কিছু শুনি, জানতে পারি। ও বাড়ি এলে
এখনও আমার সঙ্গে দেখা করে, কাঁধে হাত রেখে হাঁটে …. আমি তখন রাস্তার অন্য
সবার মুখগুলো দেখি।
বিজনকাকুর বাড়িতে ঢুকে সোজা ওপরে উঠে এলাম, আওয়াজটা ওখান থেকেই আসছে
কিনা! ড্রয়িংরুম পেরিয়ে একটা ছোট ঘর থেকে আওয়াজ আসছে কান্নার। ঢুকে দেখি
বিজনকাকু মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়ে, ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। আর নীল পরী আর কাকিমা
কাঁদছে না, কান্নার মত আওয়াজ করে ওদের মেনি বিড়ালকে ডাকছে! মেনিটা বইয়ের
আলমারির ওপর চেপে বসে আছে, নামছে না কিছুতেই। নীল পরী আর ওর মা আমাকে
দেখেই যেন আশার আলো দেখতে পেল। "ও রাজুদা, গুলতি নামতে পারছে না অত উঁচু
থেকে, সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি, দেখোনা।" খাওয়ার কথা বলতেই নিজের পেটটা
চুই চুই করে উঠল। পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে, আর আমি সমাজসেবা করতে এসে দেখি
এই কেস!
কিন্তু নীল পরী বলে কথা, তাই বিড়াল নামানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। ঘরের এ
মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত বইয়ের আলমারি। গুলতি এ মাথা থেকে ও মাথা ছুতে
বেড়াচ্ছে, কিন্তু ধরা দিচ্ছে না, এত খচ্ছর বিড়াল। অবশ্য বিড়ালকে খচ্ছর
বলা যায় কিনা ঠিক বলতে পারব না। অনেক চেষ্টা করে, গুলতির আঁচড় খেয়ে শেষে
নামালুম। নীল পরীর এক মুখ হাসি দেখে পরিশ্রম সার্থক। চলে আসছিলাম, কাকিমা
বললেন, "খেয়ে যাও বাবা, এত বেলা হয়ে গেছে।" দেখলাম নীল পরীও তাই চাইছে।
বিজনকাকুকে আগেই উঠিয়ে বসিয়ে দিয়েছিলাম। তিনিও বললেন, "হ্যাঁ, রাজু, খেয়ে
যাও।" নাহ! মানুষটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা নয়।
কি ভাবছেন? খেয়ে এলাম ওদের সাথে এক টেবিলে? মাথা খারাপ নাকি! এতক্ষণ আমার
কথা শুনে কি তাই মনে হয়? আমার মা না খেয়ে বসে থাকে আমার জন্য রোজ। সে
আমার ফিরতে যত দেরীই হোক না কেন! কত বলেছি, তুমি খেয়ে নিও। কিন্তু মা খায়
না। তাই বাড়ি ফিরে চললাম। টোটোতে বসার আগে সানগ্লাসটা চোখে পরে নিয়ে
একবার শাহরুখ খানের মত করে ওদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নীল পরীকে দেখে
হাত নেড়ে টোটো চালিয়ে দিলাম। মাথার ওপর আকাশটা বহু বৃষ্টির কান্নাকাটির
পর আজ নীলে নীল শামিয়ানা টাঙিয়ে হাসছে।
কোথাও যাবার হলে ডাকবেন, হাজির হয়ে যাব বিফোর টাইম।