ভাগ্যের পরিহাস
রঘুনাথ বায়েন,
সোনারপুর, কোলকাতা
আশীষ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা মা দুজনেই সরকারি উচ্চপদে চাকরি
করেন। অভাব কি জিনিস সে কখনো বোঝেনি। না চাইতেই সবকিছু পেয়ে যায়। বরং
বলাই ভালো চাওয়ার থেকে বেশি পেয়ে যায়। ছোটো থেকে খুব মেধাবী ছাত্র।
ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় কখনো হয়নি। অন্যদিকে আশীষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু
অমল খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান। খুব কষ্টেই তাদের দিন অতিবাহিত হয়।
বাবার একটা সবজির দোকান আছে বাজারে। মা গৃহবধু। অমলও বাবা মায়ের একমাত্র
সন্তান। উপার্জন কম হলেও খুব সুখী পরিবার। অমল লেখাপড়ায় মোটেও ভালো
নয়। লেখাপড়ায় দুজনে দুই মেরুতে অবস্থান করলেও দুজনের মনের মিল আছে।
দুজনে একই ক্লাসে পড়ে ঠিকই, কিন্তু আলাদা স্কুলে। আশীষের বাবার প্রচুর
টাকা। তাই বেসরকারি ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়ে। অমলের বাবার সেই সামর্থ্য
নেই। তাই সরকারী বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ে। অমল লেখাপড়ায় বেশিদূর এগোতে
পারলোনা। কয়েকবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েও অকৃতকার্য হয়ে পড়াশুনা
ছেড়ে দিল। বাবার সবজির দোকানে বসতে শুরু করলো। কি আর করা যাবে। বাবারও
একটু কষ্ট লাঘব হলো। আগের থেকে উপার্জন বৃদ্ধি হলো। সংসারও ভালো চলতে
লাগলো। আশীষের বাবা অমলের বাবাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলতো তোর ছেলেকে
দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। অপদার্থ ছেলে। দ্যাখ দ্যাখ, আমার ছেলেকে দ্যাখ।
ক্লাসে প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি কোনোদিন। ও একদিন খুব ভালো জায়গায়
পৌঁছবে। আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। সত্যিই হলোও তাই। আশীষ পদার্থ
বিজ্ঞানের উপর পি. এইচ. ডি. করতে বিদেশ পাড়ি দিল। প্রথম প্রথম প্রতিদিন
মাকে ফোন করতো। মা ছেলে অন্তপ্রাণ। ছেলেও মা অন্তপ্রাণ। মা কখনো ছেলেকে
না খাইয়ে মুখে অন্ন তোলেনি। বেশিরভাগ দিন মা ছেলেকে নিজের হাতে খাইয়ে
দিত। মা সবসময় ছেলের ফোনের অপেক্ষায় থাকতো। নিজে বেশি ফোন করতো না।
পাছে ছেলের পড়াশুনার ক্ষতি হয়। কিছুদিন পর থেকে ছেলের ফোন কল কমতে শুরু
করলো। মা ফোন করলেও খুব একটা করতোনা। ছেলে বলতো তোমরা এভাবে ফোন করলে
আমার পড়ার ক্ষতি হয়। এর পরে আশীষ আর ফোনও করতোনা। বিদেশীনীকে বিয়ে করে
বাবা মায়ের কথা ভুলেই গেল। বাবা মায়ের বয়স হয়েছে। তারাও সুস্থ
স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরা করতে পারে না। ছেলের চিন্তায় তারা অকালে
শয্যাশায়ী হয়ে পড়লো। এখন তাদের একমাত্র অবলম্বন ছেলের বন্ধু অমল।
বাজার করা থেকে অষুধ কেনা, দুধ আনা সবই অমল করে দেয়। যাকে তারা অপদার্থ
বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো, সেই আজ তাদের অন্ধের যষ্টি। তাই আশীষের বাবা
বলেন, বাবা অমল তুই আমার ছেলের কাজ করছিস। লেখাপড়ায় ভালো না হওয়ার
জন্য তোকে কত কটু কথা বলেছি। তবুও কোনোদিন রাগ বা অভিমান করতে দেখিনি।
পারলে আমাকে ক্ষমা করিস বাবা। পরজন্মে তোকে যেন ছেলে হিসাবে পাই। এই কথা
বলতে বলতে আশীষের বাবা চিরনিদ্রায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। স্বামী ও
ছেলের চিন্তা করে আশীষের মায়ের মাথার গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল। বাড়িতে
তিনি আর থাকেন না। এখনও পর্যন্ত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ছেলেকে খুঁজতে
থাকেন ছেলে অন্তপ্রাণ উন্মাদিনী মা।
(বি:দ্র:- দয়া করে ছেলে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন না। কপালে
দুঃখ থাকলেও থাকতে পারে। পারলে সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত করুন।)