ভুল

ঝুম্পা মন্ডল,

ডায়মন্ড হারবার, দঃ ২৪-পরগনা

পুষ্পিতা মিষ্টির ট্রে টা নিয়ে যেতে গিয়েও দরজার কাছে থমকে গেলো। তার আঠাশ বছরের মেয়ে সোহিনীর বন্ধুরা খোশ মেজাজে গল্প করছে অনেকদিন পরে, মেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে বললো... " জানিস তো আমার এক্সের সাথে দেখা হলো আজ শপিং মলে ।"

কথাটা শুনে পুষ্পিতা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো পর্দার এপারে। বুকের মধ্যে কেমন যেন ঢিপ ঢিপ করছে তার। ওখানে মেয়ের বর মৃগাঙ্ক রয়েছে। তার সামনেই মেয়ে কেমন নির্দ্বিধায় বলে চলেছে তার প্রাক্তনের কথা। অথচ আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এই প্রাক্তন সম্পর্কে চরিত্র নিয়ে টানাটানি করতো সবাই। অথচ এরা কি নির্দ্বিধায়....

মৃগাঙ্ক হেসে জিজ্ঞেস করলো.." কী কিছু কথা হলো? এখন কি আফসোস করছে নাকি তোমাকে দেখে!"

"আরে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল দূর থেকে, আমি পাত্তাই দিইনি। ওর সাহস আছে সামনে আসার? ও বছর সাতেক প্রেম করার পরে বিয়ের সব কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার পরে আমাকে ছেড়ে দিয়ে ভেবেছিলো আমি মরে যাবো। বা....।"

মৃগাঙ্ক হেসে ওঠে সোহিনীর কথায়। তার হাতটা ধরে বলে, "ভাগ্যিস ব্রেকাপ হয়েছিলো তোমাদের, নইলে আমি কী ভাবে তোমাকে পেতাম!!"

উপস্থিত বন্ধুরা সবাই হই হই করে সায় দিয়ে উঠলো এই কথায়। সোহিনীর মুখের প্রশান্তির হাসি দেখে পর্দার আড়ালে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো পুষ্পিতা। আজ ওদের দ্বিতীয় এনিভার্সারী। মেয়েটার আগেও একটা সম্পর্ক ছিল। দুইজনে যে বিয়ে করবে সেটা দুই বাড়ি থেকেই জানতো, সবই ঠিক ঠাক চাকরির অপেক্ষা ছিল শুধু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকলোনা সম্পর্কটা। ছেলেটা চাকরি পেয়ে মুম্বাই চলে গিয়ে সেখানেই কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পরে।

তার মেয়েকেও ভেঙে পড়তে দেখেছিলো পুষ্পিতা, খুব ভয়ে পেয়েছিল সে, কখন কি করে বসে। কিন্তু এটাও দেখেছিলো কয়েক মাস পরে কি সুন্দর ভাবে নিজেকে সামলেও নিয়েছিল মেয়েটা। আজকালকার ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ম্যাচিওরড । অনেক বেশি বোঝে। খোলামেলা, নিজের মেয়েকে দেখে বোঝে ও, ওরা সমস্ত পরিস্থিতিকে কি সুন্দর মানিয়ে নিতে পারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুষ্পিতা, সেদিন সোহিনীর বাবা সাগরের কাছেও নিজের অতীতের স্বীকারোক্তি করেছিল পুষ্পিতা। কলেজে পড়ার আগে থেকেই বছর চারেকের একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল সে। জানিয়েছিল এক কালবৈশাখীর সন্ধেবেলায় তার প্রাক্তনের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পনের কথা। মনের ভিতরের ঝড় আর বাইরের ঝড় মিলেমিশে দুজনের নিজেকে আটকে রাখার ক্ষমতা ভুলেছিল সে। যতদিন সম্পর্ক টিকে ছিল ব্যাপারটা ভুল বলে একবারও মনে হয়নি পুষ্পিতার। কিন্তু সেই দীর্ঘদিনের সম্পর্ক শেষ হওয়ার পরেই ভুল করেছে ভেবে আত্মগ্লানিতে ভুগেছিলো সে ভীষণ রকম। সেই সম্পর্ক এতোদূর গড়ানোর পরে পুষ্পিতা ভাবেনি সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে। কতবার নিজেকে শেষ করার কথা ভেবেও বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে পারেনি সে। অবশেষে বিয়ে করবেনা স্থির করেছিল পুষ্পিতা। চাকরি আর বাবা মাকে নিয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলো এই কয় বছর, কিন্তু ওই ঘটনার বছর আটেক পরে সাগরের সাথে অফিস যাওয়ার পথে ট্রেনে আলাপ হওয়ার পরে দুজনের দুজনকে বেশ ভালো লেগেছিলো।

অবশেষে পুষ্পিতা যখন বুঝতে পারছিলো সম্পর্কটা একটা পরিণতি পেতে চলেছে, তখন মনের মধ্যে অনেক দিন পরে বিশ্বাস আর ভালোলাগার অনুভূতি হলেও একটা অস্বস্তির অনুভূতি হচ্ছিলো তার। নিজের মনের সাথে বেশ কিছুদিন যুদ্ধ করেছিল পুষ্পিতা।সবটুকু স্বীকার করেই এগোবে সে...নইলে কোনো সম্পর্কে এগোবেনা এই সিদ্ধান্ত ছিল তার। তার মনে হয়েছিল একটা সম্পর্কে বিশ্বাসটা দুজনের মধ্যে থাকা দরকার। তাতে যদি সাগর পিছিয়ে যায় সেটাই মেনে নেবে পুষ্পিতা।

তাই সাগরের কাছে স্বীকারোক্তির পরে পুষ্পিতা যখন তাকিয়েছিল সাগরের দিকে, সাগর তখন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলো পুষ্পিতাকে। সাগরের চোখে মুখে এক অদ্ভুত হাসি। আজও সেই হাসি ভুলতে পারেনা সে।

পুষ্পিতার বুকে দামামা বেজেছিল ওই সময়টুকু। চোখ নামিয়ে নিয়েছিল মুহূর্তে ।

কিছুক্ষণ পরে সাগর তার কাছে এসে বলেছিলো , "মনে ভাবো আমি কিছু শুনিনি , তুমিও আমাকে কিছু বলোনি। তুমি আগেও আমার কাছে যেমন ছিলে ঠিক তেমনি আছো, তোমাকে এই কয়দিনেই ভালো বেসে ফেলেছি, তাই ভালোমন্দ মিলিয়ে সবটুকু তোমাকেই আমি চাই। "

সাগরের এই কথা শুনে পুষ্পিতার চোখে জল চলে এসেছিলো। সাগরের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মন ভরেছিল তার । বুঝতে পারছিলো অনেকদিন পরে তার মনের ভিতরের ক্ষতটা শুকাচ্ছে। ভীষণ শান্তি লেগেছিল সেদিন।

দুইজনের বাড়ি থেকেও এই সম্পর্ক মেনে নিয়েছিল নির্দ্বিধায়। বিয়ে নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়ার পরে ফুলশয্যার রাতে সাগর আদরে ভরিয়ে দিচ্ছিলো পুষ্পিতাকে । পুষ্পিতা যখন ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছিলো তখন সাগর তার কানের লতিতে আলতো কামড় দিয়ে বলেছিলো, "ওই ছেলেটা কি তোমাকে ঠিক এইভাবে আদর করেছিল? একটু বলো আমিও ঠিক ঐভাবেই তোমাকে.......।"

পুষ্পিতা চমকে গিয়েছিল মুহূর্তে, সঙ্গে সঙ্গে প্রবল ভাবে বুঝেছিলো আরেকটা ভীষণ ভুল করলো সে জীবনে। আজও সেই ভুলের বোঝা বয়ে চলেছে সে, আজও সাগরের বাইরের সম্পর্ক নিয়ে বললে শুনতে হয় "তোমার মত তো বিয়ের আগে... কত সতী আমার জানা আছে।" সম্পর্কের তিক্ততায় শীতলতায় আজও তাকে বিছানায় ঠান্ডা পেলে সাগর তার প্রাক্তনকে নিয়ে নোংরা কথা শোনায়। এমনকি সাগরের বন্ধু স্থানীয় কেউ সাগরের পরকীয়া নিয়ে প্রতিবাদ করলে নির্দ্বিধায় পুষ্পিতার অতীত টেনে আনতে দ্বিধা করেনা সাগর। হিসহিসিয়ে পুষ্পিতাকে ছোট করার জন্য বলে ওঠে "আমার বন্ধু হয়ে যার সাপোর্টে কথা বলছিস সেকি খুব ভালো! জিজ্ঞেস করে দেখ তাকে ।"

মাথা হেঁট হয়ে যায় পুষ্পিতার। মনে হয় এর থেকে বিয়ে না করলেই ভালো। সব জানার পরেও এইভাবে সবসময় বিদ্ধ করতে থাকে তাকে, নাকি পুষ্পিতার ভুলের অজুহাত টেনে নিজে অন্য সম্পর্কে জড়ানোর অজুহাত খোঁজে সেটা বুঝতে পারেনা পুষ্পিতা। বিয়ের পর থেকেই এই জন্য আজ পর্যন্ত সম্পর্কটা তাদের তলানিতে। থাকতে হয় একসাথে থাকে। গুমরে গুমরে নিজের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য করে সাগর তাকে এইভাবে বারবার।

সবসময় অপমানের ভয়ে ভিতরে ভিতরে কুঁকড়ে থাকে পুষ্পিতা। পুষ্পিতার মনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অপমানের ভয় ঢুকে যায়। যে কথা সে লুকাতে চায়নি, দুইজনের মধ্যে বিশ্বাস অটুট রাখতে সবটুকু বলে স্বীকৃতি চেয়েছিলো সে, সেটা যে তার কত বড়ো ভুল ছিল আজ বুঝতে পারে পুষ্পিতা । মেয়েদের সতীত্ব ব্যাপারটা যুগে যুগে চলে এসেছে আমাদের সমাজে। পুষ্পিতা আজও বুঝে উঠতে পারেনা তার আসলে কোনটা ভুল ছিল !! ভালোবেসে বিশ্বাস করে হঠাৎ ঘটে যাওয়া অতীতের আত্মসমর্পন! নাকি বিশ্বাস করে সবকিছু সাগরের কাছে স্বীকারোক্তি!! তার ভুল কি তাহলে কাউকে বিশ্বাস করাটা!! এতগুলো বছর গুমরে থেকেছে সে।

কিন্তু আজ তার মেয়ে আর জামাইয়ের সম্পর্কের বাঁধন দেখে খুব খুশি হলো পুষ্পিতা। স্বস্তি এলো এইভেবে এখনকার জেনারেশন এর মধ্যে সতীত্ব নিয়ে নেকামি করেনা, কত সাবলীল ওরা, দুজনের কারোর প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকা নিয়ে নোংরা কথা বলে অপমান করে ওদের বর্তমান সম্পর্ককে ক্ষত বিক্ষত করেনা। ওরা কি সহজে অতীতকে মাড়িয়েই ভবিষৎকে সুখের করতে পারে।