বিশ্বাস অবিশ্বাস
অমৃতা ব্যানার্জী,
কোলকাতা
চির উন্নত শির হিমালয় দ্বারা পরিবেষ্টিত চতুর্দিক। পর্বতের রুক্ষতার উপর
স্নেহের আচ্ছাদন বিছিয়ে ধাপে ধাপে নেমে গেছে সোনার বরণ ধানক্ষেত। নীচ
দিয়ে বয়ে চলেছে সদ্যোজাত খরস্রোতা পুনাখা। ফোছু অর্থাৎ পুরুষ নদী এবং
মোছু অর্থাৎ নারী নদীর সঙ্গমের ফলে এই স্থলে বারংবার জন্ম নিচ্ছে পুনাখা।
বিশেষ ঠাণ্ডা নেই। আলতো শীতল বাতাস বইছে।
ভুটানের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু পুনাখা সাসপেনসন ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে
পরস্পরের হাতে হাত রেখে নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করছে সায়ন ও প্রিয়ম। ওদের
কাছে এখন সবই মধুর। মধুচন্দ্রিমায় এসেছে ওরা।
পর্বতের দিকে তাকিয়ে সায়ন বলে, 'হিমালয় অনন্তকাল ধরে একই ভাবে
দাঁড়িয়ে আছে। যেমন তার কোন ক্ষয় নেই, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসারও
কোনদিন ক্ষয় হবে না। আমাদের ভালোবাসা হবে অনন্ত।'
'তুমি দেখছি এখানে এসে কবি হয়ে উঠলে!' সায়নের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে
কথাগুলো বলে নীচের দিকে তাকায় প্রিয়ম।
ব্রিজ সামান্য দুলছে। নীচে খরস্রোতা গভীর ধারা। প্রিয়মের বুকের ভিতরটা
হঠাৎ ছাঁৎ করে ওঠে। চোখ বন্ধ করে ও।
সায়ন প্রিয়মের হাত ধরে বলে, 'ভয় পেলে? চোখ খোল। এই দেখ, আমি আছি। যখনই
ভয় পাবে আমার হাতটা শক্ত করে ধরবে।'
সায়নের বুকে মাথা রাখে প্রিয়ম। মৃদুমন্দ বাতাস ওদের ছুঁয়ে যায়।
হঠাৎ জোরে প্রিয়মকে ঠেলে দেয় সায়ন। ছিটকে ব্রিজের রেলিংয়ে ধাক্কা
খায় ও। খরস্রোতা পুনাখার দিকে তাকিয়ে মনে হয় এই বুঝি রেলিং ভেঙে নীচে
পড়ে যাবে।
'সায়ন, সায়ন' বলে চিৎকার করে প্রিয়ম। কিন্তু কোথায় সায়ন? কোত্থাও
নেই! ব্রিজের রেলিং ভেঙে ধীরে ধীরে নীচে পড়ে যায় প্রিয়ম।
'ম্যাডাম, আমরা লোকেশনে এসে গেছি। ম্যাডাম শুনছেন?' ড্রাইভারের ডাকে
হুড়মুড়িয়ে চোখ খোলে প্রিয়ম। ডাঃ মধুমিতার ক্লিনিকের সামনে দাঁড়িয়ে
আছে ক্যাব। ভাড়া মিটিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে ক্যাব থেকে নামে প্রিয়ম।
স্বপ্নে দেখা সমস্ত দৃশ্য বাস্তব, শেষটা ছাড়া। চার বছর আগে
মধুচন্দ্রিমায় ঠিক এই ঘটনাগুলোই ঘটেছিল। কিন্তু সায়ন কোনদিন প্রিয়মকে
ধাক্কা দেয়নি, তবুও এক বছর ধরে এই স্বপ্নটা বারবার হানা দিয়ে অস্থির
করে তোলে প্রিয়মকে। শরীর ঘামে ভিজে যায়, ঠোঁট-গলা শুকিয়ে আসে। তাই
অবশেষে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মধুমিতার অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে প্রিয়ম।
ডাঃ মধুমিতা মনোযোগ সহকারে প্রিয়মের সব কথা শোনেন।
—- 'আপনার কি অ্যাক্রোফোবিয়া আছে? মানে কোন উঁচু জায়গায় উঠলে অথবা খুব
উঁচু জায়গা থেকে নীচের দিকে তাকালে ভয় করে?'
—- 'না, সেইরকম ঠিক নয়। তবে খুব উঁচু থেকে নীচের দিকে তাকালে মাঝেমধ্যে
একটু শিরশিরে অনুভূতি হয়।'
—- 'সেটা স্বাভাবিক। বেশিরভাগ মানুষই অল্প বিস্তর এমন অনুভব করে থাকে।
কিন্তু আপনি কি কোনদিন উচ্চতার জন্য মারাত্মক ভয় পেয়েছেন?'
—- 'একদমই নয়।'
—- 'ব্রিজে ভয় অর্থাৎ আমরা মেডিকেল টার্মে যাকে জিওফোবিয়া বলি, সেইরকম
কিছু… ব্রিজে উঠলেই ভীষণ ভয় করে?'
—- 'না। ইনফ্যাক্ট এখনও তো হাওড়া ব্রিজ অথবা সেকেন্ড হুগলি ব্রিজের ওপর
দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করতে হয়। কোন অসুবিধা হয় না।'
—- 'দেখুন আপনার যখন কোন ধরণের ফোবিয়া নেই, তাহলে আমার মতে পারিবারিক
জীবনের কোন দ্বন্দ্ব আপনার অবচেতন মনে এমন ভয়ঙ্কর স্বপ্ন সৃষ্টি করছে।
একটু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনার হাজবেন্ডের সঙ্গে রিলেশন কেমন?'
—- 'হি ইজ ডেড। এক বছর হল।'
—- 'আই অ্যাম সরি। এক বছর আগে আপনার স্বামীর মৃত্যু হয়েছে এবং এক বছর
ধরেই এই স্বপ্ন আপনাকে অস্থির করে তুলছে। আমার মতে আপনি ইনসিকিউরিটিতে
ভুগছেন। স্বামীর মৃত্যু আপনি মেনে নিতে পারেননি।'
কোন উত্তর দেয় না প্রিয়ম।
ডাঃ মধুমিতা বলেন, 'আরেকটা পয়েন্ট ভাবছি। স্বপ্ন অনুযায়ী, শেষ মুহূর্তে
আপনার স্বামী আপনাকে ধাক্কা দেয়। এই ঘটনা কিন্তু বিশ্বাসভঙ্গের ইঙ্গিত।
আপনাদের মধ্যে কি ট্রাস্ট ইস্যু ছিল?'
অস্বস্তি অনুভব করে প্রিয়ম। অভিব্যক্তি দেখে তা বুঝতে পারেন ডাঃ
মধুমিতা। বলেন, 'অস্থির হবেন না। যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে। নেক্সট ডেটে আবার
কথা হবে। মাইল্ড ঘুমের ওষুধ দিলাম। পেপার ওয়ার্কটা কিন্তু অবশ্যই
করবেন। যখনই মনের কোণে চাপা কোন দুঃখ বেরিয়ে আসতে চাইবে, তখনই সেটা
কাগজে লিখে ফেলবেন।'
'থ্যাংক ইউ' বলে চেম্বারের বাইরে বেরিয়ে আসে প্রিয়ম।
ক্যাবে বসে বারবার ডাক্তারের দুটো কথা প্রিয়মের কানে বাজে, 'আপনার
হাজবেন্ডের সঙ্গে রিলেশন কেমন?' 'আপনাদের মধ্যে কি ট্রাস্ট ইস্যু ছিল?'
সায়ন ও প্রিয়মের বিয়েটা ছিল অ্যারেঞ্জড কাম লাভ। প্রিয়মের এক
দুঃসম্পর্কের পিসি সম্বন্ধ এনেছিলেন। উভয় পরিবারই পাত্রপাত্রীকে পছন্দ
করেছিল। তারপর ছ'মাসের মেলামেশা। গঙ্গার ধারে, ভিক্টোরিয়ার সামনে,
সিনেমা হলে পাশাপাশি বসে দু'জনকে বোঝার চেষ্টা করত ওরা। সায়নের কাজের
জন্য যখন বেরোনোর সুযোগ হত না তখন ফোনে চলত এন্তার গল্প। স্কুল জীবনের
প্রথম ক্রাশ, এক্স গার্লফ্রেন্ডকে চুমু খাওয়ার কথা - কোনকিছুই বাদ
পড়েনি। ছ'মাস পরে বিয়েতে সম্মতি দিয়েছিল উভয়ে।
ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছিল। তারপর ভুটানে মনোরম মধুচন্দ্রিমা। পরস্পরের
সঙ্গে সমস্ত কথা ভাগ করে নিত ওরা। আড়াইটে বছর হাসি-খেলায় কেটে
গিয়েছিল।
তারপর হঠাৎ গরম বাতাস ঢুকতে শুরু করেছিল ওদের সম্পর্কের মাঝে। পাল্টে
যাচ্ছিল সায়নের ব্যবহার। বিশেষ কথা বলত না। চুপচাপ থাকত। দমবন্ধ লাগত
প্রিয়মের। সেই সময়েই তো রুবিনা প্রমাণ দেখাতে শুরু করেছিল। কেঁপে
উঠেছিল প্রিয়মের ছোট্ট পৃথিবীটা। প্রমাণে বিশ্বাস থাকলেও মন মানতে পারত
না কথাগুলো।
কিন্তু বিষয়টা সম্পূর্ণ বুঝে ওঠার আগেই তো সব ভেসে গেল।
মেসেজ টোন শুনে প্রিয়মের ঘোর কাটে। সেই নম্বরটা থেকে মেসেজ, 'ছয় নয়
নয় ছয় হওয়ার আগে একবার চোখ মেলে দেখা ভালো। আইনত স্বামীর মৃত্যুর পরেও
স্ত্রীর শ্বশুরবাড়িতে পূর্ণ অধিকার থাকে।'
এই একটা অচেনা নম্বর থেকে বেশ কিছুদিন হল মাঝেমধ্যে এসএমএস আসে। ধাঁধার
ছলে থাকে কিছু কথা, অথবা পরোক্ষ কিছু বক্তব্য। কিন্তু প্রেরকের নাম কোথাও
থাকে না। প্রথমে অদ্ভুত লাগত প্রিয়মের। ভেবেছিল বাড়ির লোককে জানাবে।
কিন্তু পরে মনে হয়েছিল, জীবনই যখন জটিল ধাঁধার জালে আবদ্ধ, তখন কয়েকটা
এসএমএস কীইবা ক্ষতি করবে? সত্যিই এই অচেনা প্রেরক প্রিয়মের কোন ক্ষতি
করেনি। বিপরীতে সাহায্য করে মাঝেমধ্যে। মন যখন অস্থির হয়ে ওঠে তখন এমন
কিছু মেসেজ আসে যে হালকা লাগে। প্রিয়মের আজকাল মনে হয়, কোন এক অদৃশ্য
সঙ্গী যেন ওর হাত ধরে রেখেছে।
আজকের আসা মেসেজের প্রথম লাইনের মানে বুঝতে পারেনি প্রিয়ম। তবে শেষ
লাইনটা ওকে ভাবিয়েছে। সায়নের শ্রাদ্ধের দু'দিন পরেই বাবার বাড়িতে ফিরে
এসেছিল প্রিয়ম। আসলে এক মুহূর্তও আর ওই বাড়িতে থাকতে পারছিল না। অনেক
প্রয়োজনীয় জিনিস, এমনকি ওদের জয়েন্ট লকারের চাবিটাও রয়ে গেছে। একদিন
গিয়ে সব গুছিয়ে আনতে হবে, ভাবে প্রিয়ম।
************************************************** সায়নের বাড়ির
সামনে আসতেই অবাক হয়ে যায় প্রিয়ম। আমূল পরিবর্তন বাড়িটায়। আগে ছিল
দোতলা। এখন তিনতলার কাজ চলছে, প্রায় শেষের পথে। সামনের সাজানো বাগানটাকে
আরো সুন্দর করে সাজিয়ে একটা ক্যাফে খোলা হয়েছে। বাড়িটাকে ভীষণ ঝলমলে,
প্রাণবন্ত লাগছে।
নম্বর প্লেটটার ওপর চোখ পড়তেই চমকে ওঠে প্রিয়ম। সায়নদের বাড়ির নম্বর
ঊনসত্তর, অর্থাৎ ছয় নয়! বাড়িটা তো আমূল পাল্টে গেছে, মানে নয় ছয়!
অজানা প্রেরক কি এই অর্থে পাঠিয়েছিল এসএমএস? কিন্তু…
দু'বার কলিং বেল বাজানোর পরে দরজা খোলে রুবিনা, সায়নের দাদা সৌম্যর
স্ত্রী। প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও পরে হেসে প্রিয়মকে ভিতরে আসতে বলে সে,
'আরে এস, এস। কতদিন পর দেখা! আসার আগে তো একটা ফোন করতে পারতে। আমি গিয়ে
তোমাকে নিয়ে আসতাম।'
'আমি নিজে আসতে পারি না?' গম্ভীর স্বরে বলে প্রিয়ম।
আন্তরিকভাবে রুবিনা বলে, 'কেন পারবে না? এটা তো তোমারও বাড়ি।'
বাড়ির ভিতর ঢুকে প্রিয়ম বলে, 'আসলে অনেক জিনিসই তো এখানে রয়ে গেছে,
লকারের চাবি, কিছু কাগজপত্র। তাই ভাবলাম নিয়ে যাই।'
— 'বেশ করেছ। তোমার জিনিস তুমি ছাড়া আর কে নেবে?'
একটু থেমে রুবিনা আবার বলে, 'তোমাদের ঘরটা তো বন্ধ পড়ে আছে। পরিষ্কার
করতে সময় লাগবে। তুমি বরং আজকের দিনটা গেস্ট রুমে থাকো। তার মধ্যে আমি
কাজের মেয়েকে দিয়ে তোমাদের ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে রাখছি।'
—- 'না, না অতো কিছুর প্রয়োজন নেই। বিকেল তো প্রায় হয়েই এল। আমি কাল
সকালে চলে যাব।'
—- 'তাহলেও তো একটু পরিষ্কার করতে হবে। নাহলে তুমি গোছগাছ করবে কেমন
করে?'
প্রিয়মকে নিজের ঘরে নিয়ে আসে রুবিনা। প্রিয়মের ফেভারিট ধোঁয়া ওঠা গরম
কফি আর পেঁয়াজি বানিয়ে আনে। ভালো লাগে প্রিয়মের। রুবিনা আজও ওর পছন্দ
ভোলেনি।
কথা প্রসঙ্গে প্রিয়ম ক্যাফে সম্পর্কে জানতে চায়। রুবিনা বলে, 'তুমি চলে
যাওয়ার পরে আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলাম। তোমার দাদা তো সারাদিন
কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সন্ধের পর এতো বড় বাড়িটা আমাকে গিলে খেত। তাই
ক্যাফেটা খোলা। সন্ধে সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ক্যাফে খোলা থাকে।
একজন রান্নার লোক রেখেছি ক্যাফের জন্য। আমি শুধু ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে
বসি। মানুষের সঙ্গে কথা বলি। সময় বেশ কেটে যায়।'
সন্ধে সাড়ে সাতটা। গেস্ট রুমের খাটে বসে আছে প্রিয়ম। রুবিনা ক্যাফেতে
ব্যস্ত। ঘন্টাখানেক আগে সৌম্য একবার বাড়িতে এসেছিল। প্রিয়মের সঙ্গে
কিছু পোশাকি কথাবার্তা বলে আবার বাইরে চলে গেছে সে। গোছগাছ করার কথা।
কিন্তু প্রিয়মের ইচ্ছে করছে না। বারবার পুরোনো দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে
উঠছে।
রুবিনার সঙ্গে প্রথম দিন থেকেই প্রিয়মের ভীষণ ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
রুবিনা বলেছিল, 'আমাকে দিদি বা বউদি বলে ডাকবে না। আমরা দুই বন্ধু। আমাকে
নাম ধরে ডাকবে।' সত্যি সখীর মতো সম্পর্ক ছিল ওদের মধ্যে। সায়নকে
মাঝেমধ্যেই কাজের জন্য বাইরে যেতে হত। অনেক সময় কলকাতাতে থেকেও রাতে
বাড়ি ফিরতে পারত না। এইসব মুহূর্তে রুবিনা ছিল প্রিয়মের একমাত্র সঙ্গী।
সন্ধেবেলা প্রিয়ম অফিস থেকে ফেরার পরে দুই জায়ে মিলে বসে চা, তেলেভাজা
খেতে খেতে টিভি দেখত। ছুটির দিনে সায়ন ব্যস্ত থাকলে দুই জায়ে মিলে
সিনেমা দেখতে কিংবা শপিং করতে বেরিয়ে যেত। সৌম্যর ব্যবসায় টুকটাক
সাহায্য করত রুবিনা। তবুও প্রিয়মের প্রতি কোনদিন অবহেলা ছিল না। বিশেষ
দিনগুলোতে প্রিয়মের জন্য নিয়ে আসতো দামী উপহার। প্রিয়মের মনে হত বাবা,
মা এবং সায়নের পরে যদি কাউকে বিশ্বাস করা যায় সে হল রুবিনা।
অবশ্য সেই রুবিনার সঙ্গে সম্পর্কের বাঁধনটাও এই এক বছরে কেমন আলগা হয়ে
গেছে।
রুবিনাই এনে দিয়েছিল বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ। সায়নের ব্যবহার যখন ধীরে
ধীরে বদলাতে শুরু করে, তখন রুবিনাই দেখিয়েছিল এক মহিলার সঙ্গে সায়নের
ঘনিষ্ঠ ছবি। সায়নের ঘুষ নেওয়ার টাকা, দামী ঘড়িও দেখিয়েছিল রুবিনা।
প্রথমে বিশ্বাস হয়নি প্রিয়মের। তার সায়ন ঠগ? তবুও রুবিনাকে তো
অবিশ্বাস করা যায় না। তাছাড়া সায়নের ব্যবহারেও দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল।
একদিন সাহস করে সায়নকে জিজ্ঞাসা করেছিল প্রিয়ম, 'তুমি কি আর আমাকে
ভালোবাস না?'
—- 'এ আবার কেমন কথা?'
—- 'তুমি কি ঘুষ নাও?'
কিছুক্ষণ বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থেকে সায়ন বলেছিল, 'আমাদের সম্পর্কের
সেতু বোধহয় নড়বড়ে হয়ে গেছে।'
প্রিয়মেরও তাই ধারণা ছিল, তবুও মন এই কথা মানতে পুরোপুরি সায় দিত না।
সায়ন হরিদ্বার গিয়েছিল, বন্ধুর বিয়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। সেই সময়ই
মেঘ ফাটা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল উত্তরাখণ্ড। সায়নকেও গ্রাস করেছিল
প্রবল জলধারা। পাওয়া যায়নি সায়নের দেহ। পুলিশ অনেক খুঁজেও হদিশ
পায়নি। সবার ধারণায় সায়ন মৃত। পুলিশের মতেও সায়নের লাস্ট লোকেশন
যেখানে ছিল সেখানে প্রকৃতির রোষ এতো ভয়ঙ্কর ছিল যে কারোর বেঁচে থাকা
সম্ভব নয়।
আবার এসএমএস ঢোকে, 'বসন্ত সেথায় করেছিল খেলা। আজ বৃক্ষ নেই, নেই পুষ্প,
তবুও কি শিকড় মৃত?'
চমকে ওঠে প্রিয়ম। এই লাইনগুলো তো সায়নের লেখা। অবসর সময়ে টুকটাক লিখত
ও। কলেজ ম্যাগাজিনে লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল। ছুট্টে বেডরুমে যায়
প্রিয়ম। আলো জ্বালে, দরজা বন্ধ করে। আসবাবের উপর মোটা ধুলোর পরত, ঠিক
যেন সম্পর্কের প্রতিরূপ। জীবন্ত হয়ে ওঠে এই ঘরে কাটানো সোনালী দিনগুলো।
কিছুক্ষণ মেঝেতে চুপ করে বসে থাকে প্রিয়ম।
একটু পরে আলমারি খোলে প্রিয়ম। আলমারি ভর্তি অসংখ্য পোশাক। সায়নের সব
পোশাক দানের ব্যবস্থা করতে হবে। লকার খোলে প্রিয়ম। প্রয়োজনীয় কাগজ আর
ব্যাঙ্কের লকারের চাবি এখানেই রাখত ওরা। লকারের চাবিটা বের করার সময়
একটা কাগজ হাতে পায় প্রিয়ম। এক প্রকার চাবিতে জড়ানো ছিল কাগজটা। খুলে
দেখে সায়নের চিঠি।
প্রিয়ম,
চিঠি লেখার যুগ নেই, তবুও লিখছি। আসলে কিছু এমন কথা থাকে যা সামনাসামনি
বলা যায় না। সেই সময় নিজেকে উজাড় করার জন্য চিঠির আশ্রয় নিতে হয়।
জানি না, এই চিঠি আদৌ কোনদিন তোমার হাতে পড়বে কিনা।
ইদানিং তুমি আমার ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ। জানি, এই পরিবর্তন
তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আজ লিখছি এই পরিবর্তনের কারণ।
মাস তিনেক আগে আমার যখন নতুন থানায় ট্রান্সফার হয় তখন কলকাতা শহরের
পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে। শহর কলকাতা তখন উত্তাল। পর পর দুটো
ব্রিজ ভেঙে পড়েছে। প্রাণ হারিয়েছেন বহু মানুষ। বহু মানুষ গুরুতর আহত
হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সংবাদমাধ্যম প্রতি মুহূর্তে ফেটে পড়ছে। শুরু
হয়েছে প্রতিবাদ মিছিল।
একটা কোলাপ্স আমাদের থানার আন্ডারে ঘটায় ইনভেস্টিগেশনের দায়িত্ব আমার
ওপর পড়ে। আগে এই সমস্ত ঘটনার ইনচার্জ সতীশবাবু বেশ অসন্তুষ্ট হন।
ইনভেস্টিগেশন যত এগোতে থাকে একের পর এক সত্যের খোলস খোলে। জানতে পারি,
দুটো ব্রিজ-ই বানিয়েছিল আমার দাদার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি, তবে অন্য
নামে। ভাবতে পারিনি আমার দাদা এমনটাও করতে পারে। সতীশবাবু এবং ওপরতলার
বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে দাদার দহরম-মহরম। তাই কখনও বিপদে পড়তে হয়নি।
দাদা বেশ কম বয়সেই ব্যবসা শুরু করেছিল। বেশ কিছু বছর সৎ ভাবে কাজ করার
পরে যখন সাফল্য এবং পরিচিতি - দুই'ই বাড়ে, তখন দাদা অসৎ পন্থা অবলম্বন
করা শুরু করে। দাদার সঙ্গে আমি এই বিষয়ে কথা বলি। দাদা আমাকে এই কাজ
থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দেয়। পারিনি আমি সরতে। মানবিক দায়বদ্ধতা আমাকে
সরতে দেয়নি। তখন শুরু হয় প্রাণে মারার হুমকি। বউদি তোমার মন বিষিয়ে
দিচ্ছে জানি। ওগুলো সব মিথ্যে প্রমাণ, এডিটেড ফটো। ওরা আমাকে একা করে
দুর্বল বানাতে চায়।
তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ, কেন তোমাকে এখনও কিছু জানাইনি। আসলে নিজের
দাদা-বউদির অপরাধের কথা তোমার সামনে বলার মতো সাহস আমার নেই। কম বয়সে
বাবা-মাকে হারিয়েছি। মনে হত দাদা-বউদি একমাত্র আপন। বিয়ের সময় তোমাদের
বাড়িতে দাদাকে নিয়ে অনেক গর্ব করেছিলাম। আজ সেই দাদার অপরাধের কথা কোন
মুখে বলব? যেদিন আদালত পর্যন্ত ঘটনা পৌঁছবে, তখন সবাই জানতে পারবেই।
কিন্তু তার জন্য আমাকে শেষ পর্যন্ত লড়তে হবে। নিজেকে নিয়ে বড় ভয় হয়
আজকাল। ভাবি, দাদার বিরুদ্ধে লড়তে পারব তো? দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী
দেওয়ার সাহস আছে আমার? জানি না।
আজ এই চিঠিটা না লিখলে তোমাকে ঠকানো হত। যদি কোনদিন এই চিঠি পাও, তোমার
করণীয় নিজে নির্ধারণ কর। ভালো থেকো।
ইতি,
সায়ন
চিঠিটা মুঠোয় ভরে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে প্রিয়ম।
ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে আসে প্রিয়ম। সৌম্যদের ঘরের পাশ দিয়ে যাওয়ার
সময় দাঁড়িয়ে পড়ে। ওদের ঘরের দরজা বন্ধ। কিছু টুকরো কথা কানে আসে।
—- 'এতোদিন পরে কেন এল? কোন কিছু সন্দেহ করেছে নাকি?'
—- 'না, না। ওই কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে এসেছে।'
—- 'বাড়ির অধিকার দাবি করবে না তো?'
—- 'মনে হয় না। হলে ব্যবস্থা করতে হবে।'
প্রিয়মের ভিতরটা তোলপাড় হয় সারারাত। সকালবেলা মুখে যথাসম্ভব হাসি
ফুটিয়ে বেরিয়ে যায় ও। মন খুঁজতে থাকে এমন মানুষকে যাকে এইসব কথা বলা
যায়। প্রিয়মের মনে পড়ে কল্যাণের কথা। সায়নের বন্ধু কল্যাণ, মাঝেমধ্যে
বাড়িতে আসত, পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই আছে।
কল্যাণের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্ত কথা বলে প্রিয়ম। চিঠিটা দেখায়। বলে
এসএমএসের কথা। কল্যাণ বলে, 'এই সন্দেহ আমাদের কয়েকজনের মনেও আছে। কিন্তু
উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে কিছু করে উঠতে পারিনি। সায়নের এই চিঠিটা আমাদের
ভীষণ হেল্প করবে।'
সময় এগোয়। এগোতে থাকে ইনভেস্টিগেশন। সৌম্য, সতীশবাবু সহ আরো কিছু মানুষ
গ্রেফতার হয়। মামলা এখন বিচারাধীন।
একদিন প্রিয়ম কল্যাণকে জিজ্ঞাসা করে, 'আননোন নম্বরের লোকেশন কি ট্র্যাক
করা গেছে?'
—- 'দেখুন বউদি, এই সমস্ত ডিটেলস আমরা সাধারণত ডিপার্টমেন্টের বাইরে
কাউকে দিই না, তবুও আপনি যেহেতু আমাদের ভীষণ সাহায্য করেছেন এবং এসএমএস
আপনার কাছেই আসত, তাই আপনাকে ডিটেলস দিতে পারি। সিমটা কার নামে সেটা আমরা
জানতে পারিনি, তবে লোকেশন ঋষিকেশ। গীতা ভবনের আশেপাশের কোন এক আশ্রম।'
'থ্যাংক ইউ' বলে চলে যায় প্রিয়ম।
**************************************************
দুরুদুরু বুকে লছমন ঝুলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ম। আবার সেই ঝুলন্ত
সেতু, আবার সেই মনের ভিতরের দোলাচল, তবুও পেরোতে হবে এই সেতু। মন বলছে,
সায়নই অচেনা প্রেরক। বুকে বল এনে লছমন ঝুলায় পা রাখে প্রিয়ম। নীচের
দিকে তাকাতে ভয় হয়। সামনের দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে পার করে ঝুলন্ত
সেতু। কল্যাণ দিয়েছিল আশ্রমের ঠিকানা। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে আশ্রমে
পৌঁছয় প্রিয়ম।
আশ্রমের পরিসর বিরাট নয়, তবে আবহ এতো শান্ত, স্নিগ্ধ যে ব্যাকুল মন
মুহূর্তের মধ্যে শান্ত হয়। আশ্রম প্রাঙ্গণ মনোরম ফুল দিয়ে সুসজ্জিত।
চারিদিকে গেরুয়াধারী মানুষ।
প্রিয়মকে দেখে এক সন্ন্যাসী বলেন, 'আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?'
—- 'সায়ন নামের কেউ এখানে আছে?'
—- 'ক্ষমা করবেন দেবী। এই নামের কেউ এই আশ্রমে থাকে না।'
—- 'আমি আপনাদের মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চাই।'
—- 'আপনি ভালো সময়ে এসেছেন। মহারাজ রোজ এই সময় মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ
করেন।'
সন্ন্যাসী ভিতরে নিয়ে যায় প্রিয়মকে।
একটি ঘরে আসনের ওপর বসে আছেন মহারাজ। তাঁর বর্ণ শুভ্র, গাল ভরা সাদা
দাড়ি, মুখে স্মিত হাসি। প্রথম দর্শনেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জাগে।
মহারাজের মুখোমুখি বসে আছে এক যুবক। তার পরিধানেও গেরুয়া বস্ত্র। ঘাড়
অবধি বিস্তৃত কালো চুল। প্রিয়মের আগমন বোধহয় তাঁরা খেয়াল করেননি।
মহারাজ যুবক সন্ন্যাসীকে বলছেন, 'পূর্বাশ্রমের স্মৃতি অস্থির করে তুললে
সন্ন্যাসের মার্গে এগোনো যায় না। এইবার তুমি মুক্ত বৎস্য। সাধন মার্গে
অগ্রসর হও। ত্যাগ ও মানুষের সেবাই এখন থেকে তোমার জীবনের লক্ষ্য।'
প্রিয়মকে দেখে মহারাজ বলেন, 'আসুন দেবী।'
যুবকটি এক ঝলক প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। তারপর গুরুদেবকে
নমস্কার জানিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ওই এক ঝলকই
তোলপাড় করে দেয় প্রিয়মকে। যুবকের মুখ ভর্তি চাপ ঝোলা দাড়ি। মুখ
স্পষ্টভাবে চিনতে না পারলেও গভীর চোখ দুটো প্রিয়মের ভীষণ চেনা।
প্রিয়ম মহারাজকে বলে, 'এখুনি যিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, আমি একবার
ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।'
—- 'দেবী এখানে প্রত্যেকে পূর্বাশ্রমের মোহ ত্যাগ করে আসে। যাঁকে আপনি
দেখলেন তিনি এখন কোন বহিরাগতের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না। ক্ষমা করবেন।'
আশ্রম থেকে বেরিয়ে আসে প্রিয়ম। মনের মধ্যে তার প্রশ্নের ঝড়। কেন সায়ন
বিশ্বাস করে সৌম্যর অপরাধের কথা প্রিয়মকে বলতে পারল না? যাকে সে আশ্রমে
দেখল সে কি সত্যই সায়ন? মন বলছে, সে সায়ন। কিন্তু সায়ন তো সন্ন্যাস
মার্গে বিশ্বাসী ছিল না। যদি সন্ন্যাসী-ই সায়ন হয়ে থাকে, তবে শুধুমাত্র
নিজের মুক্তির জন্যই সে প্রিয়মকে এসএমএসের মাধ্যমে সব কথা জানালো!
প্রিয়মের কাছে ফেরার কথা কিংবা প্রিয়মের মানসিক পরিস্থিতির কথা সে
একবারও ভাবল না? কিন্তু সায়ন যে বলত, ওদের ভালোবাসা হবে অনন্ত!
উদভ্রান্ত প্রিয়ম আবার পা রাখে লছমন ঝুলায়। কী সত্য তার জানা নেই।
বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মাঝে দোদুল্যমান জীবন নামক সেতুর উপর দিয়ে এগিয়ে
চলে প্রিয়ম।