চিঠি
চিত্তরঞ্জন মন্ডল,
সোনারপুর, কলকাতা
সোমনাথ,
তুই দুঃখ করিস না। জেলের কুঠুরিতে বসে না থাকলে আত্মোপলব্ধি হয় না। শ্রী
অরবিন্দ কারাগারে না গেলে ঈশ্বরদর্শন হতো না। মনকে বারে বারে প্রশ্ন
করছি, আপনজন কেউ তোমায় ছেড়ে গেলে কি করবে। মন জবাব দিল, যে আপন সে কখনও
ছেড়ে চলে যায় না। আর যে যায় সে কখনও আপন হয় না। তুই আমার জন্য উকিল
দিয়েছিস বারণ করা সত্ত্বেও। আমার কৃত কর্মের জন্য তুই কেন কষ্ট পাচ্ছিস।
আমি জানি তোর বন্ধুত্বে কোন খাদ নেই। আমি বিশ্বাস করি, কাছে থাকা নয় পাশে
থাকার নামই বন্ধুত্ব। ফটো তোলার সময় কাঁধে হাত রাখলে নয় বিপদের সময়
একাকীত্বের সময় কাঁধে হাত রাখাটাই প্রকৃত বন্ধুত্ব। তুই বিশ্বাস কর, তোর
মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আমার বিধবা মাকে তুই যথাসাধ্য
দেখিস।
মার জন্য খুব কষ্ট হয়। আর কষ্ট হয় দেবারতির জন্য। তুই তো জানিস ওকে কি
ভীষণ ভালবাসতাম। ভালবাসা হলো চিরন্তন সত্য যা হৃদয়ে সৃষ্টি হয়, হৃদয়েই
থাকে। আমি ভুলবো কেমন করে ওকে? মায়ের অসুখটাকে ও বড় করে দেখল? বাবার
মৃত্যু ওর এতদিনের প্রেম-ভালবাসাকে ভয় পাইয়ে দিল। মানছি যে, 'করোনা' রোগ
ছোঁয়াচে। বাবা লড়াইয়ে হেরে গেলেন। মা জীবনযুদ্ধে জিতে টিকে গেলেন। আমার
তো কিছু হয়নি। তাছাড়া এতে তো আমাদের কারো কোন হাত নেই। তাহলে দেবারতি
আমাদের এতদিনের প্রেমকে প্রত্যাখান করল কি করে? আমরা তো অন্যত্র আলাদা
জীবন গড়ে তুলতে পারতাম। মায়ের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতাম। মা নিজে এ
প্রস্তাব দেবারতিকে দিয়েছিল। পরিষ্কার না বলে দিল আমার মায়ের মুখের
ওপর।
ওর যে করোনা হয় নিবা কোনকালে হবে না তার প্রমাণ কি? মা কাতরস্বরে বলল, ওর
সব টেষ্ট করা হয়েছে। সব ঠিক আছে মা। তুমি কেন মিছে ভয় পাচ্ছ? ওর জন্য
কিছুদিন না হয় অপেক্ষা কর। তাছাড়া, বলা উচিত নয়, তবু বলছি ভগবান না করুন
যদি এই রোগটা তোমাদের পরিবারে কারো হতো তাহলে আমার অনুপম কি তোমাদের
এতোদিনের ভালবাসাকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিত? তুমি একটু
ঠান্ডা মাথায় ভাবো মা। তুমি ছেলের কথায় আমাকে দেখতে এলে। করোনাকে তো ভয়
পেলে না। আমার মাথা ঠান্ডা আছে, ভেবেছিও অনেক। জেনেশুনে বিষ খেতে পারবো
না। আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে পারবো না। আমি চললাম।
এবার তুই বল, এক উচ্চশিক্ষিত মেয়ে 'করোনা' অজুহাত দিয়ে আমার এতদিনের
ভালবাসাকে শেষ করে দিল। অথচ পড়েছিলাম The sun is a daily reminder that
we too can rise again from the darkness, that we too can shine our own
light. এত অমূল্য কথাটা আমার জীবনে কোন কাজে এল না। অক্ষরগুলো যেন আমাকে
অহরহ ব্যঙ্গ করছে।
আমার এত দামী চাকরি, ওর ভাষায় আমার এত Hand-some চেহারা এক 'করোনা' এসে
সব হিসেব উলটে দিয়ে গেলো। আমাদের পৃথিবীতে সবই উলটপুরাণ। মোমবাতি
জ্বালিয়ে মৃত মানুষকে স্মরণ করা হয় আর নিভিয়ে জন্মদিন পালন করা হয়। ভাল
জিনিসের কোন কদর নেই। মদবিক্রেতা একজায়গায় বসেই মদ বিক্রি করে আর গোয়ালা
দুধের বালতি হাতে করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কি
অদ্ভুত ব্যাপার না! ভাবলে মাথা ধরে যায়।
সে যাইহোক, আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না বলে ওদের বাড়িতে শেষ বোঝা পড়া
করার জন্য যাই। ওর কঠোর প্রত্যাখানকে সহ্য করতে না পেরে হাতের কাছে যা
পেয়েছিলাম তাই দিয়ে আঘাত করেছি। ওর চিৎকারে পাড়ার লোক জড়ো হয়ে গণ-ধোলাই
দিয়ে থানায় তুলে দিয়েছে। অভিযোগ, মারধর, গয়নাগাটি ছিনতাই। আমার
চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য ভাল যে শ্লীলতাহানির চেষ্টা বা রেপের চেষ্টার অভিযোগ
আনে নি। ওর বাবা প্রচন্ড বুদ্ধিমান এবং প্রভাবশালী। জানে ঐ কেস আনলে
ভবিষ্যতে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না। এই বর্তমান সমাজ ভাল চোখে নেবে
না।
এই সব মেয়েদের সভ্য মানুষেরা করুণা দেখাবে। হয়ত দু-চার পয়সা অনুদান দেবার
ফিকির খুঁজবে কিন্তু কখনও তারা তাদের ঘরে বউমা করে আনবে না। কোন উদার
ছেলে বিয়ে করলেও শ্বশুরবাড়ির লোকের কটুক্তি আর গঞ্জনার জ্বালায়
আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। তাই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে
আমাকে অল্পে দেবারতির পরিবার রেহাই দিল। তবুও তো ভালবাসার জন্য দাগরাজি
হয়ে গেলাম আমি। পুলিশের খাতায় সমাজবিরোধী হিসেবে চিরদিনের জন্য চিহ্নিত
হয়ে গেলাম। কথায় বলে বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা।
আমাদের দেশের পুলিশ প্রশাসন সমন্ধে মানুষের এত খারাপ ধারণা যে পুলিশ
শব্দটা উচ্চারণ করলে বেশিরভাগ মানুষের ঘৃণায় নাক সিঁটকে ওঠে। আজও পুলিশ
সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে বন্ধু হতে পারল না। সব পাখি মাছ খায়,
মাছরাঙার দোষ হয়। সরকারি সব দপ্তরে নাকি চলে ঘুষের কারবার। ঘুষ না দিলে
লাল ফিতের বাঁধন খোলে না। ফাইল নাকি নড়ে না। আর ঘুষ দিলে নাকি ফাইল
লাফাতে লাফাতে এক টেবিল থেকে উপরের আর এক টেবিলে চলে যায়। শুধু পুলিশকে
ঘুষখোর বলে লাভ কি? অফিসে আসার পথে ট্রেনের মধ্যে তর্কাতর্কিতে শুনছিলাম
একজন বলছে, পুলিশ ঘুষ খাবে না তো কি ঘাস খাবে? দাদারা কাটমানি খেলে দোষ
হয় না আর সেই দাদাদের দেহরক্ষী, তাদের পরিবাররক্ষী সমাজরক্ষী পুলিশ
কাটমানি নিলে যত দোষ! এখন তো কেউ ঘুষ বলে না, বলে এটা আমরা পেয়ে থাকি।
আমরা কিছু না পেলে আপনারও কিছু
পাওয়ার থাকবে না। কিন্তু একদিন না একদিন আমি জেল থেকে ছাড়া পাবই সোমনাথ।
কিন্তু মাঝখান থেকে আমি সরকারি এত দামী চাকরিটা হারালাম। ফেরত পাব কিনা
জানি না। আজ মনে হয়
ভালবাসাটা বোধহয় অপরাধ! আজ যদি দেবারতিকে ভাল না বাসতাম তাহলে হয়ত এক
দরিদ্র ঘরের মায়ের পছন্দের কোন অল্পশিক্ষিত মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে
পেতাম। বাংলার ঘরে ঘরে তো ভালবাসার বিয়ে আকছার হয় না। দেখাশুনা করে
বিয়েটা হয় বেশি। আজ একটা দামি কথা মনে পড়ছে সোমনাথ, কোথায় পড়েছি মনে নেই
যতই নূপুরের দাম ১০০০ টাকা হোক তার স্থান পায়ের তলায়। টিপের দাম ১ টাকা,
কিন্তু তার জায়গা কপালে। কি আর বলব তোকে। 'করোনা' সকলকে করুণা করুক এই
কামনা করি। সবার অমঙ্গল দূর হোক।
তোর অনুপম।