এক প্যাকেট সিগারেট
উজ্জ্বল দাস,
কোলকাতা
থানার অফিসার ইনচার্জ মিস্টার সেনকে সঙ্গে নিয়ে পালবাবুর ঘরের দরজাটা
খুলেছিল শিবচরণ আর তার ছোট ভাইপো সত্তু। তখনো শিবচরণ তার সতেরো বছরের
ভাইপোকে শাসিয়ে চলেছে।
“তু এক প্যাকেট সিগারেট হর রোজ পি লেতা থা ক্যায়া?”
বিকাশদার অফিসটা ঠিক ডালহৌসি পেরিয়ে বাঁ দিকে একটা কানাগলির মুখেই তিন
তলায়। প্রায় উনিশ বছর ধরে এই একই সংস্থায় চাকরি করছেন বিকাশদা। আগামী বছর
শীতেই অবসর। সাতান্ন বছর বয়সী এই মানুষটার শারীরিক কোনো সমস্যাই তেমন
নেই। দোষের মধ্যে তিনি এক সূর্যে একটা গোটা প্যাকেট সিগারেট শেষ করে
ফেলেন যত্ন সহকারে।
বিকাশদা ভীষণ মিশুকে প্রকৃতির বলে সবাই একটু ডাক খোঁজও করে। আর পাঁচটা
নিত্য যাত্রীর যেমন অভ্যাস দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেই দোকানদার এক
প্যাকেট সিগারেট ধরিয়ে দেয় রোজকার মতো। এভাবেই একদিন কথায় কথায় অফিস
ছুটির পর দোকানদার শিবচরন, ভালো মানুষ বিকাশদাকে একটা প্রপোজাল দেয়।
- আজ প্রায় সতেরো আঠের বছর হবে আপনি আমার দোকান থেকে প্রত্যেক দিন এক
প্যাকেট করে সিগারেট নিচ্ছেন। সেদিন জানতে পারলাম সামনের বছর আপনার
রিটায়ারমেন্ট। এত বছরের এই সম্পর্কের আমারও কিছু প্রতিদান দেবার থেকে
যায় পালদা। তবে সবার জন্য তো পারবোনা।
বিকাশবাবু জানতে চায় শিবচরণ ঠিক কী বলতে চাইছে। শিবচরণ ব্যাপারটাকে আরো
খোলাসা করে বলে যে তার ইচ্ছে, রিটায়ারমেন্টের পর বিকাশদাকে আজীবন একটা
করে সিগারেটের প্যাকেট প্রত্যেকদিন তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে চায় সে,
কিন্তু বিনা পয়সায়।
বিকাশদা কল্পনাও করতে পারেননি যে একজন ছোট গুমটির দোকানের মালিক তাকে
এতটা ভালোবেসে এতবড় একটা কথা বলতে পারে। যেমন কথা তেমনি কাজ। রিটায়ার
হয়ে যায় বিকাশ দা। শিবচরণ তার কথা রেখেছিল। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের
হাঁটা পথ বিকাশদার অফিস। অবিবাহিত বিকাশ কুমার পালের পিছুটান তেমন একটা
ছিল না বললেই চলে। শিবচরণ তার ভাইপোকে দিয়ে রিটায়ারমেন্টের পরদিন থেকেই
বিকাশদার বাড়িতে বিনা পয়সায় পৌঁছে দিত এক প্যাকেট করে সিগারেট। এভাবেই
প্রায় চলছে কম করে সাত বছর তো হবেই।
গত পরশুদিন শিবচরণ, বিকাশদারই এক অফিস কলিগের থেকে জানতে পারে যে মাস
ছয়েক আগে নাকি বিকাশদার হঠাৎই একটা মাইল্ড হার্ট অ্যাটাক করে। সঙ্গে
সঙ্গে চিকিৎসা শুরু হলে হয়তো বা এ যাত্রায় রক্ষা পেতো পালবাবু। কিন্তু
একা মানুষের যা হয়, বুকে যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় শুয়ে একাই কাতরাচ্ছিল
এ কথা সহজেই বোধগম্য হয় সকলের। আশেপাশে পাড়া-প্রতিবেশী কেউ খবর না
পাওয়াতে সময়মতো চিকিৎসা হয়নি। পরের দিন সকালে প্রচন্ড বৃষ্টি। বাড়িতে
যিনি কাজ করেন, অনেকবার কলিংবেল বাজানোর পরেও যখন কেউ দরজা খোলে না, তখন
পাড়ার ক্লাবকে খবর দেন তিনি। ক্লাবের ছেলেরা এসে পৌঁছলে ততক্ষণে সব শেষ
হয়ে গেছে। আদ্যোপান্ত পুরো ঘটনাটা শোনার পর শিবচরণের চক্ষু চড়কগাছ
তাহলে কী তার ভাইপো সত্তু এক প্যাকেট করে সিগারেট বিকাশ বাবুর বাড়িতে
দিয়ে আসার নাম করে নিজেই ফুঁকে উড়িয়ে দিতো ! নাকি অন্য কিছু আছে এর
পেছনে! ভাবতে থাকে শিবচরন!
আর বিকাশদা যেহেতু প্রায় ছয় মাস আগে মারা গেছে। হিসেব মত ছয় মাসে
তিরিশ দিন করে হলে একশ আশি প্যাকেট সিগারেট। মাঝখানে প্রচন্ড বৃষ্টির
জন্য দুদিন যেতে পারেনি সত্তু । তারমানে একশ আটাত্তর প্যাকেট সিগারেট,
গেল কোথায়? মাথায় রক্ত উঠে যায় শিবচরনের। ডাক পড়লো ভাইপো সত্তুর।
ভয়ানক রেগে জানতে চাইলো সব। সন্দেহ হয় তার।
-সত্তু তুঝে পাতা থা বিকাশদা গুজার গ্যয়া?
-ক্যায়া চাচা! আজভি সিগারেট দে কে আয়া।
-সাচ বোল সত্তু। তুপি লেতা থা ক্যায়া?
-নেহি নেহি চাচা। ম্যায় তো...
বলতে বলতেই বিকাশদার বাড়ির সামনে এসে থামে পুলিশের ভ্যানটা। শিবচরন,
সত্তু, থানার অফিসার ইনচার্জ সঙ্গে তিনজন কনস্টেবল। সত্তুকে বিশ্বাস করবে
নাকি করবে না এসব ভেবেই পরিচিত ইন্সপেক্টর মিস্টার সেনকে সবটা জানিয়ে ফোন
করে দোকানদার শিবচরন। পুলিশকে খবর দেবার কারণ, সত্যটা আসলে কী সেটাই
জানতে চায় সে।
এ কথা সে কথা বলতে বলতে দরজা খুলে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ে সবাই। একটা ভ্যাপসা
গন্ধ নাকে এসে লাগে। চোখেমুখে জড়িয়ে যায় ঝুল। অন্ধকারে দমবন্ধ হয়ে আসার
জোগাড়। চারদিকে নিকশ কালো ঘুটঘুটে অন্ধকার। যে কেউ ঢুকলেই ভয় পেয়ে যাবে।
বাঁ দিকটা তাকাতেই চকিতে সবার গায়ের রোম খাড়া যায়। খাটের সাইড টেবিলে
রাখা একটা মোটা ফ্রেমের চশমা, যেন এইমাত্র খুলে রাখা। একটা শরৎ সমগ্রের
দুশ তিরানাব্বই পাতায় “মেজদিদির” ওপর তখনও পড়ে আছে সম্ভাব্য সদ্য নেভা
সিগারেটের এক টুকরো ছাই,
আর?
আর খাটের পাশে রাখা ইজি চেয়ারটা ক্যাঁচ... কুচ... ক্যাঁচ... কুচ শব্দ করে
তখনও দুলে চলেছে আপন মনে। এক্ষুনি যেন কেউ চেয়ারে বসে দুলে দুলে বই পড়ছিল
যার ডান হাতে ছিল জ্বলন্ত সিগারেট। অ্যাস্ট্রেতে সবে মাত্র নিভিয়ে ফেলা
সেই সিগারেটের গরম ফিল্টারের শেষটুকু মুখ থুবড়ে ঘাড় গুঁজে পড়ে আছে। সেখান
থেকে সরু হয়ে উঠছে নিভু নিভু ধোঁয়া। ঘরময় সিগারেটের বেশ জোরালো গন্ধ। ওপর
দিকে চোখ পড়তেই দেখা গেল তিনটে সাদা ধূমায়িত রিং সিলিঙে গিয়ে ঠেকছে।
বাইরের দরজার গায়ে তখনও রাখা আছে একটা ঝোলা ব্যাগ। যার মধ্যে সত্তু রেখে
গেছে আজকের সকালের সিগারেটের প্যাকেটটা।