কালো হিরে
ঝুম্পা মন্ডল,
ডায়মন্ড হারবার, দঃ ২৪-পরগনা
প্রচন্ড রোদের তাপ, বর্ষার আকাশ হলেও বৃষ্টি না হলে সেই সময় টুকু চড়া
রোদ, প্রায় চল্লিশ ডিগ্রির কাছাকাছি রোদের তাপ । ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা অঞ্চলে
জল কাদায় মেশানো পিছল পাঁকের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বুনি , মাথার তেল
হীন বাদামি চুল উঁচু করে চূড় খোঁপা করা, বেশ লম্বা, ছিপছিপে গড়ন ,
শ্যামলা রঙ রোদে আরও চকচক করছে যেন । সারা গা ময়লা, ... দূর থেকে দেখলে
তাকিয়ে থাকার ইচ্ছে হবে ভালো করে দেখার জন্য। কাছে এলে খেয়াল পরবে নাকের
দুই ফুটোর মধ্যি খানে একটা রুপোর রিং মুখের সৌন্দর্যকে অন্যরকম রূপ
দিয়েছে। সেই সঙ্গে তার চোখ দুটো... ঘন পল্লব রাশি উপর নিচে করে যেন কথা
বলে। অনেক মরদ বুনির সাথে কথা বলার জন্য উন্মুখ, কিন্তু বুনির কাছে
পাত্তা পাওয়া দায়। বুনি পিঠে কাপড় বেঁধে কয়লা খনিগুলোর পাশে যে বর্জ্য
পদার্থ গুলো ঢিপি হয়ে আছে, সেখান থেকে পড়ে থাকা কয়লার টুকরো তুলতে ব্যস্ত
, সঙ্গে অবশ্যই আরও দশ পনেরো জন মহিলা আছে, এই কয়লা নিয়ে ঘরে ঘরে বিক্রি
করে সামান্য যা কিছু আয় হয় তাতে তাদের সংসার চলে। এইভাবে দেশের ফেলে
দেওয়া জ্বালানী শক্তিকে তারা কাজে লাগালেও আইনের চোখে কিন্তু তারা
দোষী।তাদের কোনো ক্ষতি হলে সরকারের কোনো দায় নেই। যদিও সেই সব নিয়ে মাথা
ঘামায় না বুনি। কয়লার টুকরো তুলতে তুলতে পিঠে ফেলা ঝুড়ি ক্রমশঃ ভারী
হচ্ছে, ঘাড় টন টন করলেও মুখে হাসি ফুটে ওঠে বুনির। যত বেশি কয়লার টুকরো
ততো বেশি টাকা। গত মাস বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। তখন আবার এইভাবে কয়লার টুকরো
পাওয়া যায়না, সেকয়দিন কোদাল দড়ি বস্তা বেলচা এনে পাহাড়ি ঝর্ণায় মিশে থাকা
কয়লার গুঁড়ো ছেকে নেয় তারা, সেই কয়লা বস্তায় পুরে ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে
দেয়। তাতে সারাদিনে একশো বা দেড়শো টাকা ইনকাম হয়। যে যার পছন্দ মত দামদর
করে বেচে কয়লা গুলো। অনেকের আবার বাঁধা ধরা ব্যবসায়ী থাকে। যেমন বুনিরও
আছে। আধাবয়স্ক মাখনলালই মূলত তার এই কয়লা কিনে নেয়। বুনি সেখানে
গেলেই...তাকে দেখে চোখের ইশারা করে মাখনলাল , সবার গুঁড়ো কয়লা নেওয়ার
শেষে বুনির বস্তায় হাত দেয় সে। ইশারায় ওর দোকানের পিছনের গো ডাউনে দেখা
করতে বলে। বুনি বোঝে আজ বাড়ি ফিরতে রাত হবে, ছেলেটার জন্য মনকেমন করে,
কিন্তু তবুও মানিয়ে নিয়েছে সে। প্রথম প্রথম বুনি মাখনলালকে বিশেষ আমল
দেয়নি। কিন্তু পরে বুঝেছে , বেশি প্রতিবাদে এই কাজে টিকে থাকা দায় হবে,
তারউপর বিশেষ করে যখন মাখনলালের মত মানুষ। এদিকে ঘরের মরদ খাদানে কাজ
করতে গিয়ে এমন পা ভেঙেছে যে সারাজীবন খুঁড়িয়ে চলা ছাড়া গতি নেই , তাই সে
আর ওই খোঁড়া পায়ে খাদানের কাজ করতে পারেনা, পিছন ঘষে ঘষে ঘরে বসে সে ছেলে
দেখে আর বুনি ফিরলে গাল দেয়। পা গেছে তা কি হয়েছে, মুখের জোর কমেনি তার
মরদের। বুনি এখন আর পাত্তা দেয়না গাল গুলোকে, শুনে শুধু হাসে মুচকি, তাতে
তার মরদের গালে আগুন পরে যেন। আরও জোরে চেঁচাতে থাকে, বাপের চেঁচানো শুনে
বছর ছয়েকের ছেলে ভয় পায় । বুনি দৌড়ে এসে আদর করে দেয় তাকে। তার ফর্সা ছোট
ছেলের চিবুকের ভাঁজ দেখে বুনি হাসে। সেখানে আলতো চুমু খায়। তার মরদ মোটেও
তার হাসি সহ্য করতে পারেনা। তবে খোঁড়া হওয়ার পরে বুনি ছাড়া যে তার গতি
নেই সেটা বুঝেছে। ছেলেটাকে দেখাশোনা করলেও বুনির উপরে রাগে ছেলের উপরে
মাঝে মাঝে যখন কিল বসিয়ে দেয়, সেদিন বুনি মরদের জন্য রান্না করেনা,
ছেলেকে খাইয়ে পাশের বাড়ি বুড়ি মার কাছে রেখে দিয়ে যায়। সারাদিন অভুক্ত
থাকে তার মরদ। হেসেলের চাবি থাকে বুনির কোমরে। যদিও হেসেলে তেমন কিছুই
মজুত থাকেনা। আজকাল বুনির ভয়ে গাল দিলেও ছেলের গায়ে হাত তুলতে সাহস করেনা
তার মরদ। রোজ ভাত পায় তাই সে। বুনি রোজ সকালে ছেলেকে খাইয়ে ইস্কুলে দিয়ে
বের হয়ে কয়লা জোগাড় করতে, সেগুলো বিক্রি করে সেই পয়সায় বাজার করে তবেই
বাড়ি ফেরে। কষ্ট হয় খুব, সারাদিন রোদে জলে পুরে কষ্টের কাজ তাদের, তবুও
এর মধ্যে স্বাধীনতার স্বাদ পায় যেন সে। নিজের স্বাধীনতার কষ্টকে সে
তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে। তার মধ্যে মাঝে মাঝে মাখনলালের এই আবদার। মেঘ
করলে, বৃষ্টি পড়লে যেন আরও... ওনার মুখে হিন্দি টানে "বোনানী" নামটা
শুনতে বুনির ভালোই লাগে, এমনিতে সবাই তাকে বুনি বলেই ডাকে, শুধু
মাখনলালবাবু তাকে আদর করতে করতে অদ্ভুত সুরে বোনানী বোনানী বলে ডেকে
জানায় তার গায়ে নাকি এক অদ্ভুত বুনো গন্ধ আছে, যা নাকি ওনাকে মাতাল করে,
নিজের বাহারি নাম বনানী শুনলে বুনির খুব হাসি পায়, সে আবার মাখনলালের
কাছে আবদেরে বোনানী। নামটা তার মা সখ করে রেখেছিলো, তার মা পোয়াতি
অবস্থাতেও অনেক দূরে জল আনতে গিয়ে দূরের ওই জঙ্গলে নাকি ব্যথা উঠে মেয়ে
জন্ম দিয়েছিলো, নাড়ি নাকি কঞ্চি দিয়ে কেটেছিলো সঙ্গের বয়স্ক ঠাকমা। তাই
মেয়ের বাহারি নাম রেখেছিলো বনানী, যা তাদের ঘরে অচল। তবে তার মা নাকি
ভালো ঘরের মেয়ে ছিলো, তার বাপটা ফুসলিয়ে বে করে এনে অথৈ জলে ফেলেছিলো তার
মা কে। প্রথমে তার মা জানতো তার বর খাদানের ম্যানেজার, বাপটা বিয়ের আগে
তাইই বলেছিলো তার মাকে। বাপের লম্বা চওড়া বুক আর চোয়ারে সুন্দর মুখ দেখে
হয়তো তার মায়ের মন মজে ছিলো। পরবর্তীতে সব মিথ্যে সরে গিয়ে সত্যি যখন
বেরোলো তখন বনানী একবছরের শিশু, মায়ের আর কিছু করার ছিলোনা তাকে মিথ্যে
বলে বিয়ে করে আনার জন্য বরকে ঘৃণা করা ছাড়া। ঝগড়া মনোমালিন্য সেই থেকে
শুরু, একদিন বনানীকে রেখে তার মা গলায় দড়ি দিলো। বুনির সেই দিন স্পষ্ট
মনে আছে, ওই দরজার ফাঁক থেকে দেখেছিলো মায়ের পা দুটো ঝুলে ছট ফট করতে,
বুনির বয়স তখন কতই বা হবে!! বছর নয়েক, কি করবে ভেবে না পেয়ে দৌড়ে গিয়ে পা
দুটো জড়িয়ে ধরেছিলো সে। কয়েক মুহূর্ত শুধু পা স্থির হয়ে গিয়েছিলো মায়ের।
বুনির কপালে টপ টপ করে দুই ফোঁটা জল পড়েছিল আজও মনে আছে বুনির। বুনি
চেঁচিয়ে মা বলে কেঁদে উঠতেই আশেপাশের মানুষ জড়ো হয়, বুনি দেখেছিলো তার
বাপ একটুও কাঁদেনি। গম্ভীর হয়ে বসে ছিলো শুধু। তারপরে থেকে মায়ের সাধের
বনানী বাপের হাতে মানুষ হতে হতে বনানী থেকে বুনি হয়ে গেছে কখন বুঝতেই
পারেনি। মায়ের পরে আজকাল মাখনলাল একমাত্র ওই নামেই ডাকে। কেন ডাকে ওই
নামে তা বুনি জানেনা, তবে খারাপ লাগেনা বুনির, কেউতো মায়ের পরে তাকে আদর
দিয়ে ওই নামে ডাকে! মাখনলাল মানুষটা খারাপ না। বনানীকে কোনোদিন বাজে কথা
বলে অসম্মান করেনি। নখ কালো, চুল উস্কো খুস্ক হয়ে থাকলেও উল্টে বুনি যে
এখনও সুন্দর মাখনলাল তা উপলব্ধি করায়। সেইজন্নি মানুষটাকে ভালো লেগেছে
বুনির জীবনের প্রথম কাউকে। বয়স্ক হোক...লম্বা সুদর্শন, আর ওই চিবুকের
ভাঁজটা বুনির বড্ড প্রিয়। দোষের মধ্যে পান চিবোয় দিনরাত। তা হোক এখন ওই
অসহ্য জীবন থেকে অব্যাহতি মিলেছে তার। খাদানে কাজ করে অন্য মরদরা শকুনের
মত বুনির দিকে তাকালেও সাহস পায়না তার দিকে হাত বাড়াতে শুধুমাত্র
মাখনলালের জন্য। ঘরের মরদ তার কোনোদিন কদর করেনি অন্তত অন্যজন করুক।
বাপটা তাকে বারো বছর বয়সে তার মরদের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয় মোটা টাকার
বিনিময়ে, একে মাতাল তারউপর বয়স বেশি।বিয়ে তো নয় এ বিক্রি করার সমান। ছোট
বুনি জ্বালা যন্ত্রনায় দিনরাত কেঁদেছে, কেমন যেন লোকটা কাছে এলেই গা
গুলিয়ে উঠতো তার, বমি পেত ভীষণ, সেইজন্য মারও খেত বিস্তর। কয়েক বছর পরে
টাকার লোভে তার মরদও কম জনের কাছে পাঠিয়েছে বুনিকে!! এই হাত ওই হাত হতে
হতে বুনি মরতেই বসেছিলো যেন। পেটের বাচ্চা কার না কার বলে নষ্টও করে
দিয়েছে দুইবার জড়িবুটি খাইয়ে। মাঝে মাঝে বুনির ইচ্ছে হত মরদকে মেরে জেলে
যায় সে।
সুদিন ফিরলো মরদ খোঁড়া হতে। সত্যি কথা বলতে বুনি তারপরে স্বাধীন হয়েছে
যেন, খোঁড়া হওয়ার পরে তার মরদ আর গায়ে হাত তুলতে পারেনা যখন তখন, বুনি
মাঝে মাঝে ওর গাল দেওয়ার সময় মজা করে কাছে গিয়ে সরে আসে হিহিহি করে হেসে
, এক অদম্য প্রতিশোধ স্পৃহা কাজ করে যেন তার মধ্যে, কিন্তু নিজেকে আটকে
রাখে সে। এখন সে সুখী, মুক্ত আকাশে দম ফেলতে পেরেছে এই কাজে কষ্ট থাকলেও,
টাকা হাতে পেলে নিজের বুকে বল বাড়ে। হোক সামান্য তবুও সৎ পথে রোজগার তার।
এইভাবেই সময় এগোয়, দিন কাটে বুনির তরতরিয়ে। আজ সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার।
ছেলেরও শরীরটা খারাপ, জ্বর জ্বর ভাব। ফেরার পথে ওষুধ আনতে ভেবে বুনি
এগিয়েছে ঝোড়া পিঠে নিয়ে। গতকাল অল্প বিস্তর বৃষ্টি হয়েছে। আজ অল্প ঝোড়ো
হাওয়া। সারাদিন খাদান খুঁজেও বেশি কয়লা পায়নি সে। অথচ আজ তার ঘরে ওষুধ
কিনে নিয়ে যেতেই হবে। একবার ভেবেছিলো মাখনলাল বাবুর কাছে চাইবে। কিন্তু
গত কয়েকমাস হলো মাখনলাল বাবুর নতুন পছন্দের মেয়ে বদলেছে, বুনিকে এখন
ইশারা না করে রেশমিকে নিয়ে গো ডাউনে চলে যায় বুনির সামনে দিয়ে। যেন
কোনোদিন বুনির অস্তিত্বই ছিলো না। বুনি জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় মাখনলাল
বাবুর দিকে, কিন্তু মেনে নেওয়া ছাড়া কিচ্ছু করার নেই তার, এসব এখানকার
জলভাত, তবে দীর্ঘ এতো বছরের সম্পর্ক সে যেমনই হোক, বুনিকে বাঁচিয়ে
রেখেছিল যেন। আজকাল সে মাখনবাবুর কাছে গেলেও শুধু মাত্র হিসেবের টাকা
নিয়ে চলে আসে ঘরে, রাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। চিবুকের ভাঁজে চুমু দেয়
বারবার।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। অল্প কিছু কয়লা নিয়ে খাদানের পাশে জলকাদা
আর পাঁকে পা আটকে যাওয়ায় আগে বুনি দ্রুত পা চালায়। বৃষ্টি আসার আগে তাকে
বাড়ি পৌঁছাতে হবেই। ঘরে তার অসুস্থ ছেলে। খাদানের বর্জ্য পদার্থ থেকে
কয়লা তোলা বন্ধ করে সে, অন্যান্যরাও এগিয়ে গেছে কিছুটা দূরে। বুনি
তাড়াতাড়ি ফিরতে গিয়েও বড় টনের ডাম্পার ট্র্যাককে আসতে দেখে। থমকে দাঁড়িয়ে
যায় কিছুক্ষণ, একটু অপেক্ষা করলেই অনেক গুলো কয়লার টুকরো, ছেলেকে ডাক্তার
দেখিয়ে ওষুধের দামটা উঠে যাবে তাহলে। বুনি অপেক্ষা করে। খাদানের ধারে এসে
ট্র্যাক খনি থেকে তোলা উপরের মাটির মত বর্জ্য ঢেলে দেয় হুহু করে। কালো
মাটির গুঁড়োর সাথে কালো কালো খন্ড ঝরে পরে নিচে, বুনি লোভ সামলাতে
পারেনা। ভাবে বেশ কিছু কয়লা পেতে পারে সে। দ্রুত হাত চালিয়ে যদি নিতে
পারে...মেঘ ডেকে উঠলো একবার, বুনি স্পষ্ট কালো কয়লা দেখতে পাচ্ছে
অসংখ্য।একবার ঢালের উপরের দিকে তাকালো, ট্র্যাকটা ফিরে যাচ্ছে, দূরে ওটা
কে?? ওখানে কি মাখনলাল দাঁড়িয়ে!! থাকুক, তার কি তাতে!! এখন তার অসুস্থ
ছেলের ওষুধ জোগাড় করার তাড়া শুধু। সে কাপড়টা কোমরে বেঁধে এগিয়ে যায় আরও
কিছুটা, পিছনের মেয়ে গুলো কেন যেন তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো আতঙ্ক মাখা
স্বরে। বুনি শুনতে পেলেও কোনো দিকে তাকায় না, পাগলের মত কয়লার টুকরো
কুড়িয়ে ঝুড়ি ভরতে থাকে সে খাদানের বর্জ্য পদার্থের মধ্যে দিয়ে, হঠাৎ তার
গায়ের উপরে ঝরে পরে কয়েক টন বর্জ্য,উপর থেকে পরা কালো টুকরো কয়লার আঘাতে
কিছু বোঝার আগে ঘটনার আকস্মিকতায় একশো কুড়ি টনের ডাম্পার ট্র্যাকের তলায়
বুনি তলিয়ে যায় বেহিসাবীদের মৃতদের দলে চিরদিনের মত।।
