হায়দ্রাবাদের ডায়েরি
সুপ্রভা আদক,
হায়দ্রাবাদ
Hi আমি সুপ্রভা, আজকে আমি আপনাদেরকে যে গল্পটা শোনাবো তা আজ থেকে প্রায়
ত্রিশ বছর আগের কথা। বর্তমানে আমি থাকি হায়দ্রাবাদ কিন্তু আমার ছোট বেলা
কেটেছে কলকাতায়।
বিয়ের পরে পরেই আমাকে হায়দ্রাবাদে চলে আসতে হয়, কেননা আমার বর মশাই
কর্মসূত্রে হায়দ্রাবাদে থাকতেন। বিয়ে হয়ে নিজের পরিবার পরিজন নিজের
লোকালয়ের চেনা গন্ডি ছেড়ে স্বামীর সাথে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চলে
এলাম আমি।
প্রথম প্রথম ভীষণ অসুবিধা হতো, কেননা আমরা বাঙালী আর আমাদের খাওয়া, পরা,
ভাষা, জল- হাওয়া এই রাজ্যের থেকে অনেক আলাদা। এখানে আসার পর প্রথমে বলতে
গেলে আমি একরকম বোবা হয়েই থাকতাম।
আশেপাশে কোন বাঙালি নেই যে মন খুলে কথা বলব। সকালবেলা আটটার সময় বর মশাই
নিজের ডিউটিতে বেরিয়ে যেতেন আর ফিরতে ফিরতে সেই রাত্রি ন'টা!
যে বাড়িতে আমরা ভাড়ায় থাকতাম সেই বাড়ির মালিকও তেলেগু আর আশে পাশের
পাড়া-প্রতিবেশী ও সবাই তেলেগু। তাদের না একটা কথা বুঝতে পারি আর না তো
নিজের কথা বুঝিয়ে বলতে পারি।
এ যে কি বিষম কষ্ট সে বলে বোঝাতে পারবো না। যৌথ পরিবারে মানুষ হওয়া অনেক
মানুষের সাথে হাসি ঠাট্টা কথাবার্তা খেলাধুলা করে বড় হওয়া আমি মানুষটা
কথাবলার ইচ্ছা হলেও কারুন সাথে কথা বলতে পারতাম না, তাই সব সময় মন খারাপ
করে থাকতাম।
বরের অফিস থেকে মাঝে মধ্যে অনেকেই দেখা করতে আসতো কিন্তু তখন আমি না
পারতাম হিন্দিতে কথা বলতে আর না পারতাম তেলুগুতে কথা বলতে। ওরা এলে
নমস্তে করতাম, Hai Hello করতাম ব্যস এই টুকুই। আমার বর বেশ বুঝতে পারতো
যে আমি মন খারাপ করে আছি। একদিন আমাকে বললো তুমি মন খারপ না করে একটু
মার্কেট থেকে ঘুরে আসতেও পারো তো! আমি মুখে কোন কথা না বলে চোখে মুখে
একরাশ ভয়, উৎকণ্ঠা নিয়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গিয়েছিলাম। ওরে বাবা! এ
যে আমার কাছে কি ভীষণ ব্যাপার সে আমি আমার নতুন বিয়ে হওয়া বর মশাই কে
লজ্জায় বোঝাতে পারছি না, হয়তো ভেবে বসবে মেয়েটা বোকা!
কিন্তু ঈশ্বরের মর্জির ওপর কারুর মর্জি খাটে না।
বিয়ের প্রায় মাসখানেক পরে বর মশায়ের অফিসে একটা বিশেষ কিছু কাজ থাকায়
বর মশাইকে কোন রকম ছুটি ছাড়াই লাগাতার ১৫ দিন ডিউটি করতে হয়েছিল।
সেই সময় রাত্রিবেলা নটা মানে অনেক রাত, আশেপাশের বাজার দোকান সব বন্ধ
হয়ে যেত। তাই আমার বর মশাই সপ্তাহে একদিন ছুটির দিনে সারা সপ্তাহের
বাজার করে রাখতেন। সেটা চাল ডাল আটা তেল নুন হোক বা সবজি পাতই হোক।
বর মশাই তো সারা সপ্তাহের কথা চিন্তা করে বাজার করে আনতেন কিন্তু ওনার ১৫
দিন ডিউটি ছিল আর ঘরে দ্বিতীয় সপ্তাহের জন্য কোন বাজার ছিল না। তাই
বাধ্য হয়েই সাহসে ভর করে আমাকে বাজার যেতে হয়েছিল।
সেই প্রথম আমি বাজারের জন্য থলে হাতে করে বাড়ির বাইরে বের হলাম। ভিতরে
ভিতরে ভীষণ রকম ভয় আর উৎকণ্ঠা কাজ করছিল। কিভাবে কি বলবো, কি করব, কিছুই
বুঝতে পারছি না। এদিকে রাস্তাঘাট ও তেমন চিনি না। তবুও যেমন তেমন করে
বাজার পর্যন্ত পৌছালাম। রিক্সাওয়ালা কে মার্কেট বলাতে সে বাজারে পৌঁছে
দিয়েছিল।
কিন্তু এবার যে আসল কাজ করতে হবে! আমার কর্তামশাই কোথা থেকে বাজার করতেন
আমার জানা ছিল না। এখানে আমি যে বাজারে গিয়েছিলাম অর্থাৎ রিক্সাওয়ালা
আমাকে যে মার্কেটে পৌঁছে দিয়েছিল সেই বাজারে দোকানের বাইরে কোনরকম সবজি
পাতি আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে দোকানের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে
বিভিন্ন সবজির ছবি দেখতে পাচ্ছিলাম, আর তাতে করে বুঝতে পারছিলাম যে এই
দোকানে সবজি পাওয়া যাবে। প্রথমেই আমি দোকানির সাথে কথা বলার চেষ্টা
করলাম আর তাকে বোঝাতে চাইলাম যে আমি সবজির মধ্যে কি কি চাই। কতটা পরিমাণে
চাই এবং দাম কত!
ও মা!!! না তো সে আমার কথা বোঝে না আমি তার কথা বুঝি, আমি যতবার দোকানিকে
বলি,
-'আলু চাই",
ততবারই দোকানি বলে,
-'আলুগাড্ডা'!
আমরা বাঙালিরা গাড্ডা বলতে বুঝি গর্ত। আমি ভাবছি এ বলতে কি চাইছে? সব আলু
গর্তে পড়ে গেছে! নাকি দোকানে কেবল গর্তওয়ালা আলুই আছে! বা আলুগুলোতে
গর্ত হয়ে পচে গেছে! আমি তাকে বারবার বলছি,
-"আরে না না ভাই গর্তওয়ালা আলু আমার চাই না। আমাকে ভালো আলু দাও"।
সে ততবারই বলে,
- "আলু গাড্ডা, আলু গড্ডা"।
প্রায় ১০ মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও আমরা কেউ কাউকে কিছু বোঝাতে পারছি না।
আমার তো বাজারের মধ্যে প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।
এমতাবস্থায় সেই সময় ভাগ্যচক্রে সেই বাজারে এসেছিলেন একজন প্রবীণা
বাঙালি মাসিমা। তিনি দীর্ঘ দিন হায়দ্রাবাদে বসবাস করার দরুন তেলেগু
ভাষাটা বেশ ভালই রপ্ত করেছেন আর তারই বদান্যতায় সেদিন আমি বাজার করে
বাড়ি ফিরেছিলাম, পরে অবশ্য সেই মাসিমার সাথে কৃতজ্ঞতা বসত আমাদের বেশ
ভালই আলাপ পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। এবং যতদিন আমরা ওই পাড়ায় ভাড়ায়
ছিলাম মাসিমার সাথে প্রায়ই আসা-যাওয়া করতে করতে আমি মাসিমার থেকে
হিন্দি এবং তেলেগু টা বেশ ভালই শিখে নিয়েছিলাম।
আর এখন তো জীবনের প্রায় অর্ধেক বসন্ত আমি কাটিয়ে ফেললাম হায়দ্রাবাদে,
আর তাই আমার মনে হয় স্থানীয় কিছু হায়দ্রাবাদীর থেকেও একটু বেশিই ভালো
তেলেগু বলতে পারি আমি।
তবে এই ভাষাটা নিয়ে শুরুতে আমার মধ্যে যে ভয় এবং উৎকণ্ঠা কাজ করতো সেই
সব দিনের কথা ভাবলে আজকে আমার নিজেরই ভীষণ হাসি পেয়ে যায়।
তবে যাই বলুন এখানকার ভাষায় ফল সবজি পাতিকে কি কি বলে তা জানলে আপনারাও
কেউ না হেসে পারবেন না। অবশ্য ডাক্তাররা বলেন হাসলে নাকি হার্ট ভালো
থাকে, তাই আপনাদের একটু হাসির ওষুধ বলুন বা যাই বলুন, আমি নিচে কিছু
বাঙালি সবজি এবং হায়দ্রাবাদি সবজির নামের পরিচয় দিলাম।
কলা - আরেটি পাণ্ডু
বেদানা - দানিমা পাণ্ডু
সবেদা - সাপোটা পাণ্ডু
আম - মামড়ী পাণ্ডু
জাম - নেরেড় পাণ্ডু
পেঁয়াজ - উলিপাই
রসুন - এলিগাড্ডা
আদা - আল্লাম
আলু - আলুগাড্ডা
কচু - চামাগাড্ডা
উচ্ছে - কাকর কাই
সিম - চিক্কুর কাই
ঢেঁড়স - ভিন্ডাকাই
কুঁদরী - দন্ডাকাই