ইতু পুজো

স্বাতী নাথ,

বর্ধমান

ইতু পূজা বাংলার একটি লোকউৎসব। অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার ইহলোকে শস্যবৃদ্ধি কামনায় এবং পরলোকে মোক্ষ লাভের ইচ্ছায় ইতু বা ইঁয়তি পূজা করা হয়। কার্তিক সংক্রান্তিতে ইতু পূজার শুরু এবং অগ্রহায়ণ মাসের শেষে এই পূজার সমাপ্তি ঘটে।
ইতু শব্দটি মিতু অর্থাৎ মিত্র থেকে এসেছে। মিত্র শব্দের অর্থ সূর্য। অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে অবস্থান করে এবং এই অবস্থানে সূর্যের নাম মিত্র। এই থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে ইতু পুজো শুরু হয়। সুতরাং ইতু পূজা মানে সূর্য পূজা। বাংলার মেয়েরা ইতুকে শস্যের দেবী হিসেবেই পূজা করে থাকে।

বাংলা মেয়েরা নিজেরাই এই পুজো করে থাকেন। ইতুকে সাধভক্ষণের প্রথাও রয়েছে কোথাও কোথাও। সেদিন নতুন গুড় ও চাল দুধ দিয়ে পরমান্ন তৈরি করে নিবেদন করা হয়।
এই অঘ্রাণেই ঘরে আসে নতুন ধান, হয় নবান্ন উৎসব। বাংলার পাড়া গ্রাম এখনও একজোট হয়ে মেতে ওঠেন এই উৎসবে। শুদু নবান্নের স্বাদ পেতেই অনেকে এই সময় বিদেশ বিভুঁই থেকে বাড়িতে ফেরেন। হোলি, খ্রিসমাস, দিওয়ালির ভিড়ে কিন্তু এখনও হারিয়ে যায়নি প্রাচীন গ্রাম বাংলার এই সব উৎসব।

কথায় বলে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। তবে শহুরে উৎসবের ছোঁয়ায় এখনও হারিয়ে যায়নি গ্রামের নিজস্বতা- ইতু পুজোই যার প্রমাণ।
একটি সুন্দর মাটির খোলাতে মাটি ভরে তার মধ্যে মান, কচু, কলমীলতা, হলুদ, আখ, শুষনি, সোনা ও রুপোর টোপর, জামাই-নাড়ু, শিবের জটা, কাজললতা রেখে ফুলের মালা, ধূপ-দীপ-সিঁদুর প্রভৃতি পুজোর উপকরণ ও ফল-মিষ্টান্ন ও নবান্ন সহযোগে ইতু পূজা করা হয়।অগ্রহায়ণ মাসের প্রতি রবিবার পুজো করে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তিতে ইতু বিসর্জন করা হয়। প্রতি রবিবারের ব্রত রাখলে উপহাস অথবা অপারগে ফলমূল/শাকসব্জী ভোজন কর্তব্য।

আমাদের রাজ্যের মেয়েরা অগ্রহায়মাসের প্রতি রবিবার ইতু ঠাকুরের পুজো করে থাকেন। ইতু পুজোর নিয়ম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে কার্ত্তিক মাসের সংক্রান্তি থেকে অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তি পর্যন্ত পুজোর নিয়ম।
প্রতি রবিবার ফল, মিষ্টি, ধান, খই দিয়েই ইতুর পুজো করা হয়। শেষ দিন নবান্ন থেকে পিঠে পুলি সবই বানানো হয়। এখনও গ্রামে সবাই মিলে ভাগ করে খান সেই প্রসাদ। কারোর বাড়িতে ইতু পুজো হলে সেই প্রসাদ সবাইকে ভাগ করে দিয়ে খাওয়া নিয়ম।

ইতুর ঘটের গায়ে পুতুলি আঁকা এবং ভেতরে দেওয়া হয় শস্যদানা ও তৃণগুচ্ছ। খড়ের বিঁড়ের উপরেই ইতুর সরাকে বসানো হয়। এর পর ওই সরাতে দেওয়া হয় মাটি। মাটি পূর্ণ সরার মাঝে ঘট স্থাপন করতে হয়। আর বাকী অংশে থাকে কলমী, সরষে, শুষনীর মূলসহ শাক। এ ছাড়া ধানের বীজ, মানকচুর মূল লাগানো হয়। আর ছোলা মটর মুগ তিল যব সহ আট রকমের শস্যের বীজও ছড়ানো হয়ে থাকে।

এই পূজার সময় বলা হয়
ইঁয়তি ইঁয়তি নারায়ণ,
তুমি ইঁয়তি ব্রাহ্মণ।
তোমার শিরে ঢালি জল,
অন্তিম কালে দিও ফল
অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে।
ইতুকথা একমনে শুন প্রাণ ভরে।।
ইতু দেন বর,
ধনে জনে বাড়ুক ঘর।…. এই হল উতু পুজোর মন্ত্র।
পুজোর পর ব্রতের কথা শোনার সময় ৮টা আতপচাল ও ৮টা দূর্বা জলে ধুয়ে একটা ছোট পাত্রে রেখে হাতে রাখতে হয়।

ইতু পুজো বাংলার একটি লোক উৎসব। মূলত শস্যবৃদ্ধির কামনার প্রতি অঘ্রাণ মাসের রবিবার এই পুজো করা হয়। তবে ইদানিং কালে বাংলার গ্রাম্য দেবদেবীরা যেমন মনসা, ইতু, ভাদু, টুসু, শীতলা- এরাঁ আর তেমন ভাবে পুজো পান না। গণেশ পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো সেই জৌলুস কেড়ে নিয়েছে অনেকটাই।