যমজ সন্তানের মায়ের অভিজ্ঞতা
সুলেখা ভান্ডারী,
কসবা, বালিগঞ্জ
আমার শ্বশুরবাড়ি বালিগঞ্জ কসবায়। শশুর মশাইয়ের নাম নন্দলাল ভান্ডারী
আর শাশুড়ি মাতা হলেন শান্তিবালা ভান্ডারী। ওঁদের তিন সন্তান। দুই ছেলে
এবং এক মেয়ে।
বড় ছেলে সুকুমার উনি হলেন আমার স্বামী, মেয়ে সাবিত্রী আমার ননদ আর ছোট
ছেলে রাজকুমার আমার দেবর।
ননদের দুই মেয়ে মিঠু ও ময়না। আমার এক মেয়ে সুমনা আর দেওরের এক মেয়ে
স্নেহা। তাহলে সবার তো মেয়ে। এদিকে যা হয় আর কি শ্বশুর-শাশুড়ির একটা
নাতির ইচ্ছা। বংশের বাতি দেবে কে? তা তো কেউ নেই।
আমার স্বামীর একটা ছোট খাটো কারখানা আছে। শশুর শাশুড়ির ইচ্ছে ওঁদের একটা
নাতি হলে ভবিষ্যতে সে বাবার ব্যবসা চালাতে পারবে।
ননদের দুই মেয়ে সে আর নেবে না সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে। যাকে বলন সে
বলে,
-"না না বাবা আজকালকার বাজারে যা খরচা ওই যথেষ্ট আর ছেলের দরকার নেই"।
এবার আমার বলার পালা। আমি প্রথমে একটু না করছিলাম। তারপরে দেখলাম ওনারা
অতো করে বারবার বলছেন আমি ওনাদের মুখের ওপরে বার বার না বলতে পারলাম না।
আমার বড় মেয়ের বয়স তখন ৫ বছর, তারপরে আমরা ডিসিশন নিলাম মা বাবার কথা
রাখতে, যা হয় হবে। তারপর আর কি- আরো একবার গর্ভধারণ করলাম, আর একবার মা
হলাম।
দিন যায় মাস যায়, একে একে আমার শরীরে ওরা বড় হতে লাগলো। আমার পেটটাও
ভীষন বড় দেখাচ্ছে। সবাই দেখলে বলতো - "কি রে দুটো সন্তান আছে নাকি"?
- না না তোমরা সব কি যে বলো তা ঠিক নেই!
আমি আর কি করে জানবো বলো? ডেটে ডেটে ডাক্তার দেখাতে যেতাম, ডাক্তাররাও
কখনো বলেননি যে দুটো সন্তান আছে।
বাড়ির সব কাজ রান্না বান্না কাচাকুচি, ধোয়া মোছা, বড় মেয়েকে স্কুলে
দিয়ে আসা নিয়ে আসা প্রায় সব কাজই করতাম। মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আদ্যা
মায়ের মন্দিরে বসে থাকতাম, ছুটি হলে মেয়ে নিয়ে একেবারে বাড়ি ফিরতাম।
আদ্যা মায়ের কাছে গিয়ে বলতাম মা তুমি আমার পাশে সব সময় থেকো, আমাকে
শক্তি দিও, সাহস দিও।
তারপর এলো সেই ভয়ংকর দিন। সকাল থেকেই অল্প অল্প ব্যথা হচ্ছে। দুপুরবেলা
কোনরকমে একমুঠো মুখে দিয়ে শাশুড়ি আর বর আমাকে নিয়ে হাসপাতালে
গিয়েছিল। ভর্তি করে ওরা রাতে বাড়ি চলে আসেন। এদিকে তো আমার অল্প অল্প
মাঝেমাঝে ব্যথা করছে। আমরা লেবার রুমে ২৫ জন ছিলাম। একটা বেডে দুজন তিনজন
করে ছিলাম।
কি আশ্চর্য! ঐদিন আমার সামনে আমাকে নিয়ে ন'জন মায়ের যমজ বাচ্চা হয়েছে।
তখন আমার একটু জোরে জোরে ব্যথা করছে। ওদের দেখে আমারও খুব ভয় করছিল যে
আমারও কি ওদের মতো যমজ বাচ্চা হবে না কি রে বাবা!
তারপর রাতে বেশি নার্স বা ডাক্তার থাকেন না। হাতে গোনা কয়েকজন, একই
ব্যক্তি একবার এ বেডে একবার ও বেডে রোগীর কাছে আসা-যাওয়া করে।
একবার আমাদের বলে এদিকে এসো, আবার কখনো বলে ওই দিকে যাও। ওই যন্ত্রণা
নিয়ে আমাদের এদিক ওদিক করতে হচ্ছিলো।
তারপর বাচ্চাটা হল। বাচ্চা হওয়ার কিছুক্ষণ পর এলেন নার্সরা। এসে আমার
পেট টিপে টিপে বলছেন- "এরও টুইন বেবি"।
শুনেই তো আমি ভয়ে মরি! তারপর আমার হাত পা বেডের সাথে বেঁধে দিল।
অক্সিজেন সেলাইন লাগানো। আমি শুধু গুরুদেবকে ডাকছি সেই মুহূর্তে। তারপরে
কি অসহ্য যন্ত্রণা! তার কিছুক্ষণ পরে আবার একটা বাচ্চা হল। তারপর আর সেই
সেলাইন অক্সিজেন দিতে হলো না নরমালে হয়ে গেল। তারপরে সবাইকে বেডে
দিয়েছে, আমি শুধু একা লেবার রুমে ছিলাম। সে কি ব্লিডিং! বেডের নিচে গোল
করে কাটা আছে। তার নিচে বড় বালতি রাখা ছিল। বালতি ভর্তি হয়ে ঘরের মেঝে
ভেসে যাচ্ছে রক্তে। কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না রক্ত। সব সময় ৩-৪ জন ডাক্তার
আসছেন দেখতে। তারপরে বিকালবেলা রক্ত বন্ধ হল।
ওরা হয়েছে সকালে, এদিকে আমার তো গতোরাত থেকে কিছু খেতেও দেয়নি, জলও না।
তারপরে যখন শুনলাম দুটো মেয়ে তখন আমি আর আমি নেই! আমার শরীরে কোন শক্তি
নেই। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, তার ওপরে অত রক্ত বেরিয়েছে, আমি শুধু
কাঁদছি.........কেউ নেই আমার কাছে!
মনে হচ্ছে শুধু বাড়ির লোকরা এলে কি বলবে আমাকে! একে তো প্রথমে মেয়ে
হয়েছিল। তারপরে ঈশ্বর দিলো তো দিলো আবার দু-দুটো মেয়ে!
কি বলবো সেই ভেবেই আমি সারা হচ্ছিলাম। সেই মুহূর্তে আমার কাছে কোন কাপড়
চোপড় ও ছিল না। তা সব অন্য রুমে ছিল। আমার শরীরে শুধু রক্ত আর রক্ত।
শুধু আমার খোলা শরীর টা উপর থেকে বেডশীট দিয়ে ঢাকা। তখন পুরো শীতকাল,
ডিসেম্বর মাস খুব ঠান্ডা।
আয়া জিজ্ঞাসা করেন-" তোমার বাড়ি কোথায়? বাড়ির লোক কখন আসবে? তোমার
কাছে কোন জামাকাপড় নেই"? ইত্যাদি ইত্যাদি....
আমার বাচ্চা দুটোর গায়ে কোন জামা নেই, শুধু হসপিটাল থেকে দেওয়া পাতলা
পাতলা দুটো টাওয়াল জড়ানো ছিল। ওরা শুধু কাঁদছে, কি ঠান্ডা বাতাস! ওদের
চোখের পাতা পিচুটিতে জুড়ে গেছে।
নার্সরা বলছে-" কি ফর্সা......ওরা কি আমেরিকা থেকে এসেছে"!
ওদের চোখের পাতায় কোনো পলক ছিল না। মাথায় কোন চুল ছিল না। দুধের মতন
সাদা ধপ ধপ করছে। আরেকটি নার্স বলল -"পেটে যখন ছিল তখন তুমি কি খেয়েছো?
যে এত ফর্সা হয়েছে। সবাই দেখতে আসছে দলে দলে। আমি শুধু কাঁদছি। ওদের
দিকেও তাকাচ্ছিনা। শুধু ভাবছি এতক্ষণে বোধহয় বাড়ির লোকেরা প্রথম মেয়ের
পরে আবার দুটো যমজ মেয়ে হবার খবর পেয়ে গিয়েছে, আর তাই তারা আমাকে আর
ফিরিয়ে নেবে না, তবে কি আমি মরে যাব, কারো সাথে দেখা হবে না!
এদিকে তো আমার বর আর শাশুড়ি সকাল থেকে চারিদিকে খুঁজছেন, এমনকি আমার
বেডের পাশ থেকেও ঘুরে চলে গেছেন, আমি দেখেছি। কিন্তু ভয়ে ওদের ডাকছি না।
পরে ওনারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতে একজন নার্সের সঙ্গে আমার বেডের পাশে
এসেছেন। বাচ্চাদের দেখে ওনারা তো খুব খুশি!
শাশুড়ি মা সঙ্গে সঙ্গে নিচের চায়ের দোকান থেকে গরম জল নিয়ে এসে আমাকে
ধরে ধরে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে সারা শরীরে রক্তে মাখামাখি সেগুলো সব
পরিষ্কার করে দিয়ে আমাকে কাপড় পড়িয়ে ধরে ধরে এনে বেডে শুইয়ে দিলো।
আমার বর বাচ্চাদের জন্য গরম জামা, টুপি, মোজা ও প্যান্ট এনে পড়িয়ে দিল।
আমার পাশের বেডের মহিলার আগের একটা বড় ছেলে আছে। আবারও ওনার দুটো যমজ
ছেলে হয়েছে। ওনাদের ইচ্ছা ছিল একটা মেয়ে হবে কিন্তু হলো না। ওনারা আমার
শাশুড়িমা কে বলে অদল বদল করে নাও। আমাদের একটা মেয়ে দাও আর আমাদের একটা
ছেলে তোমরা নাও। সেই মুহূর্তে আমার বর ও শাশুড়ি বলল তা হয় নাকি? ঠাকুর
আমাদের যা দিয়েছে তাই থাক। ওনাদের কথা শুনে আমি মনে জোর পেলাম। তখন মনে
হল কে বলে ঈশ্বর নেই! ঈশ্বর আছেন। সব সময়ই আছেন!
যেহেতু ওরা নরমালে হয়েছে সেহেতু একদিন পরে হসপিটাল থেকে আমার ছুটি হয়ে
গেল। তারপরে ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে শিয়ালদহ স্টেশন আর তারপরে ট্রেন ধরে
সোজা ডায়মন্ড হারবার নামলাম। আমার বড় বৌদি, বর ও শাশুড়িকে নিয়ে আবার
ট্যাক্সি ধরে আমার বাপের বাড়িতে গেলাম।
ওখানে যেতেই বাড়িতে আর লোক ধরে না। সবাই বাচ্চা দেখতে এসেছে, দেখে সবাই
অবাক!
মানুর যমজ বাচ্চা হয়েছে। ওদের এক একজনের ওজন ছিল এক কেজি আড়াইশো। দেখে
মনে হচ্ছে ছোট ছোট সাদা বেড়ালের বাচ্চা!
শুধু মনে হতো কি করে ওদের বড়ো করব। ওরা এত ছোট দু হাতের তলুতে বা হাতের
চেটোয় দুজনকে নিতাম। তখন আমার পাশের বাড়ির একটা বৌদির বাচ্চা হয়েছে
খুব বড়সড়ো। দেখে ভাবতাম ওদের বাচ্চাটার মত আমার মেয়ে দুটো কবে ওরকম
বড় হবে। মা বাবা দাদা দিদি সবাই বলতো চিন্তা করিস না হাড় থাকলে মাস
হবে। দেখতে দেখতে ঠিক একদিন বড় হয়ে যাবে।
ওখানে সবাই আমার বাচ্চাদের খুব যত্ন করত, সকালে উঠে বারান্দায় রোদ্দুর
এলে ওখানে তারপরে রান্না ঘরের বারান্দায় ওখান থেকে ছাদে আবার বারান্দার
উঠানে ওদের নিয়ে যেতাম। রোদ্দুর যেখানে যেখানে থাকতো সেখানে সেখানে ওদের
গায়ে তেল দিয়ে শুইয়ে দিতাম। শুধু মনে হতো কি করলে ওরা তাড়াতাড়ি বড়
হবে। এমন করে দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়!
আমার বুকের দুধ ওরা দুজন খেয়ে অনেক বেশি হত। আমার কাপড় জামা সব ভিজে
যেতো। হঠাৎ একদিন দেখি বাম দিকের বুকে খুব ব্যথা করছে আর লাল হয়ে আছে
হাত ছোঁয়াতে পারছিলাম না এত ব্যথা!
এদিকে তো দুধের যন্ত্রণা, ওরাও খেতে পারছে না! তারপরে ডায়মন্ড হারবার
মহাকুমার হাসপাতালে মেজো দিদি ও আমার বর নিয়ে গেল। ডাক্তার দেখে বলল এ
তো বাগি হয়েছে। এহে, খুব খারাপ অবস্থা! এ যদি নিজে থেকে ফেটে যায় তাহলে
ভালো তা না হলে অপারেশন করতে হবে। শুনে তো আমি অবাক।
একে তো ওরা ছোট তারপরে ওরা কি খাবে? ওরা তো শুধু আমার দুধ খায়। সারারাত
চিন্তায় দু চোখে ঘুম নেই।
তারপরে সকালে উঠে আমার মেজো দিদি আমাকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বলে "দেখি আমি
একবার"।
এসব ব্যাপারে আমার মেজদির অল্পবিস্তর নলেজ ছিল, ওর নার্সিং জানা ছিল।
মেজদি বাবা বামুন গাজীর নাম করে তিনবার ফুঁ দিল তারপরে যেই হাত দিয়ে
একটু চাপলো অমনি ফেটে গিয়ে পুঁজ রক্ত কাকে বলে! গল গল করে বের হচ্ছে- তো
হচ্ছে.......। শেষ আর হয় না, তারপরে দিদি সবাইকে ডাকল দেখো কি অবস্থা।
আমার ব্রেস্টে রীতিমত এক আঙুল গর্ত হয়ে গেছে। সত্যিই ঠাকুর আছে, তাই
জন্য এখনো চন্দ্র-সূর্য ওঠে! দিনরাত্রি হয়!
প্রবাদ আছে না, 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর'। আমাকে আর অপারেশন
করতে হলো না। ঠাকুরের কৃপায় আমি আসতে আসতে ভালো হয়ে গেলাম। ওরাও আস্তে
আস্তে বড় হতে লাগলো।
বাব্বাহ্ ওদের কত না নামের বাহার!
দিম্মা ডাকে তুলসী দুর্বা। দাদু ডাকে গঙ্গা যমুনা। ঠাকুমা ডাকে রুমকি
ঝুমকি, ঠাকুরদা ডাকেন লক্ষ্মী সরস্বতী! আমি ডাকতাম সুপর্ণা সুকন্যা আর
ওদের বাবা ডাকতো সুস্মিতা সুমিতা, মামা ডাকে জংলি আর মংলি। পিসিমণি বলতো
সীতা গীতা আরো কত নাম!
আমার বড় মেয়ে বাড়িতে থাকতো। ওর ঠাকুমা পিসিমণি ছোট মা সবাই মিলে ওকে
দেখাশোনা করত। সবাই খুব ভালোবাসতো ওকে। স্কুলে নিয়ে যেত ঠাকুমা। ও আমার
জন্য খুব কাঁদত, খুব কষ্ট পেত। মাঝে মাঝে ওর ঠাকুমার সাথে ডায়মন্ড
হারবারে আমার ও তার বোনেদের সাথে দেখা করতে যেত।
সত্যি তোমাদের সবার আদর যত্নে ও ভালোবাসায় আমি ওদের তাড়াতাড়ি বড় করতে
পেরেছি। আমি তোমাদের ঋণ কোনদিন শোধ করতে পারব না। আমি যখন বাড়িতে ছিলাম
আমার শাশুড়ি মা বাড়িতে ১৫ দিন থাকতেন আর ডায়মন্ড হারবারে আমার কাছে ১৫
দিন থাকতেন। এই ভাবে আমি ছয় মাস ওদের নিয়ে বাপের বাড়িতে ছিলাম। বাপের
বাড়িতে ওদের মুখে ভাত দেওয়ার পরে শ্বশুরবাড়িতে আসি। এখানেও সবাই আমাকে
খুব ভালোবাসতো এবং ওদেরকেও সবাই খুব আদর যত্ন ও ভালোবাসায় বড় করে তুলল।