যমজ সন্তানের মায়ের অভিজ্ঞতা(দ্বিতীয় ভাগ)
সুলেখা ভান্ডারী,
কসবা, বালিগঞ্জ
প্রিয় পাঠক ও পাঠিকা আমি আগের গল্পে যমজ মা হওয়ার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে
লিখেছিলাম। জানিনা আপনাদের মনের মধ্যে কতটা দাগ কেটেছে। আমার তো যা মনে
আসে তা আবোল তাবোল লিখে চলেছি। সত্যি কথা বলতে কি আমরা মেয়েরা যারা
চাকরি-বাকরি করি না, চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি বললেই চলে। ইচ্ছা থাকলেও
সব সময় সবকিছু সম্ভব হয় না। কারণ তার জন্য তোমার ভালো বন্ধু অথবা ভালো
প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার। একার দ্বারা কোন কাজ সম্ভব নয়। অনেকের হয়তো
বাপের বাড়িতে এইসবের মানে লেখালেখি বা সংস্কৃতি চর্চার চল আছে, আবার
কারোর শ্বশুরবাড়িতে এগুলো একেবারেই নেই। ইচ্ছে থাকলেও পরিস্থিতির চাপে
তা করা প্রায় অসম্ভব। তবে এসব আগেকার দিনে খুব দেখা যেত। এখন অনেক
পরিবর্তন হয়েছে। এখন মেয়েরা অনেক এগিয়ে আছে। তারা পুরুষদের সাথে সাথে
সব কাজ সমান তালে পা মেলাচ্ছে।
আমি একদিন অনিন্দিতা কে বললাম, লেখা কেমন হচ্ছে রে? ভালো কিনা তা জানি
না। আপনাদের সম্পাদিকা উনি আমার কে হয় জানেন? আমার মেজ দিদির বড় মেয়ে।
আমি ওকে নিজের মেয়ের মতই ভাবি আর ও আমাকে মাসীমণি বলতেই অজ্ঞান।
আমাদেরকে খুব ভালোবাসে। ও একটা রত্ন। অনিন্দিতা আমাকে সব সময় বলে
"মাসীমণি তুমি লিখে যাও, কলম ধরো তোমার মনে যা আসছে তাই তুমি লেখ।" ওর
উৎসাহে আবার আমি কলম হাতে তুলে নিলাম। সত্যি বলতে ছোটবেলায় মা-এর উৎসাহে
সব করতাম। জানেন আমার মা তেমন লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু দেখলে কেউ বলবে
না; মা পড়াশোনা জানে না। মা মা-ই হয়।
সত্যি কথা বলতে শশুরবাড়িতে তেমন ভাবে এইসব লেখালেখি বা সাহিত্য
সংস্কৃতির চল ছিল না বললেই হয়। আর এখন মেয়েদের উৎসাহে একটু একটু করে
আবার নতুন জীবন গড়ে উঠছে। সব কথা একসঙ্গে মনে আসে না। কখনো রান্না করতে
করতে কিছু কথা মনে এলো ছুটে গিয়ে একটু লিখলাম। আবার হয়তো রান্না হয়ে
গেছে, একটু সময় আছে। ওদের খাবার দিয়ে আবার একটু লিখলাম। শুয়ে আছি একটা
কিছু কথা মনে পড়েছে তখন গিয়ে আবার লিখলাম। কখনো খাতা পেন্সিল নিয়ে
নিয়ম করে বসে লিখতে পারিনা। যখন একটু সময় পেয়েছি লিখেছি। আমার আগের
গল্পে কিছু কিছু কথা লেখা হয়নি এই কথাগুলো লিখতে না পেরে অনেক আক্ষেপ
হচ্ছিল। তখন মনে হলো ঠিক আছে আগের গল্পের দ্বিতীয় ভাগ লিখবো।তা হঠাৎ করে
আমার মনে হল যে ৬মাস বাপের বাড়ি ওদের মানুষ করার পরে বাড়িতে এসে ওদের
কেমন পরিস্থিতিতে বড় করলাম তা আপনাদের সাথে একটু শেয়ার করি।
জানেন তো ওদের বয়স তখন পাঁচ মাস, আমার বাপের বাড়িতে চৈত্র মাসে গ্রামের
বাৎসরিক কালীপুজো হতো। তাতে আমরা ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা নাটক যাত্রা গান
কবিতা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতাম। সেবার আমি যখন ওদের নিয়ে ওখানে ছিলাম,
তখন গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করল যে ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় বিরোচিত 'নরমেধ
যজ্ঞ'- পৌরাণিক যাত্রাপালা টি হবে। গ্রামের ছেলে মেয়েরাই করবে সবাই মিলে
করবে। কে কোন পার্ট করবে সব ঠিক হয়ে গেল, ওই যাত্রায় আমার মেজদি আমার
দাদা আর শিশু শিল্পীর ভূমিকায় অনন্দিতা অভিনয় করেছিল ও বোধহয় তখন
ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ে। পার্ট ভাগাভাগিও হয়ে গেল কিন্তু এখনো যাত্রায়
এমন একজন দরকার যে মা কালীর ভূমিকায় অভিনয় করবে। কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল
না তখন সবাই এসে আমাকে বলল-
- তুই পার্ট টা একটু করে দিবি ? বেশি পার্ট নেই, অল্প পার্ট আছে। আর
মাত্র চার পাঁচবার মঞ্চে প্রবেশ আছে।
আমি বললাম- - তোদের মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? ওরা অত ছোট তারপরে
আমার বুকের দুধ খায়। কি করে? এ অসম্ভব, না না কোনমতেই সম্ভব নয়।
জানেন তখন আমার শাশুড়ি বলল-
- তুমি করো বৌমা, আমি ওদের দেখব।
.jpg)
ওনার সেদিনের সেই কথা শুনে আমার মনে যে কি ভীষণ শ্রদ্ধা ও আনন্দ হয়েছিল
তা আপনাদের বোঝাতে পারবনা।
ঘরে বসে প্রার্ট মুখস্থ করছি আর কখনো কখনো এক-আধবার রিহার্সাল দিয়েছি।
কালীপুজোর দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনে যাত্রা মঞ্চস্থ হয়েছিল। গ্রামের
প্রাইমারি স্কুলের মাঠে মঞ্চ তৈরি হয়েছে, সেখানেই মঞ্চস্থ হবে
যাত্রানুষ্ঠান। মা কালীর ভূমিকায় অভিনয় করব, বুঝতেই পারছ মেকআপ করতে
কতটা সময় লাগবে! মেকআপ করতে করতে আমি বারবার গ্রিনরুমের বাইরে আসছিলাম
বাচ্চাদেরকে দেখার জন্য আর দুধ খাওয়ানোর জন্য। শাশুড়ি মায়ের কাছে
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় মাদুরের উপর প্লাস্টিক বিছিয়ে
ওদের শুয়ে দিয়েছিলাম। যাত্রা শুরু হল আমি একবার করে মঞ্চে প্রবেশ করছি
আর পার্ট শেষ হতেই মঞ্চ থেকে নেমে আবার একবার করে ওদের দেখতে আসছি। কত
লোকেরা এসে ওদের দেখে যাচ্ছে আর বলছে বাবা সত্যিই তোর মা একজন বটে। আমি
একা নই এখানে সবার অবদান ছিল বলেই আমি সাহস করে এগিয়ে যেতে পেরেছিলাম।
যখন আমার বুকে বাগি হয়েছিল তখন ওরা আমার দুধ খেতে পারত না সব সময়
কান্নাকাটি করত তখন আমার মেজ দিদি বলল-
- আমি ওদের নিয়ে যাচ্ছি।
বড়টা যায়নি। ছোটটা অনেক দিন পর্যন্ত আমার মেজদির কাছে ছিল আর আমার মেজ
দিদির বুকের দুধ খেয়ে আমার ছোট মেয়ে বড় হয়েছিল। ও আমার দিদিকে মা
বলতো, আর আমার জামাইবাবুকে বাবা বলতো। এরপর আমি সুস্থ হলে ওর বাবা ওকে
যখন দিদির বাড়িতে নিতে গেল প্রথমে ও কিছুতেই ওর বাবার কাছে আসছিল না।
ওর বাবা যতবার বলছে আমি তোর বাবা হই ছোটটা ততবারই আমার মেজদি আর
জামাইবাবুকে দেখিয়ে বলছে-
- ওই তো আমার মা, ওই তো আমার বাবা।
বড় টা ওর ঠাকুমার কাছে ছিল, ও একটু ঠাকুরমার মত আর বড্ড ঠাকুমা ঘেঁষা
হয়েছে।
.jpg)
ওদের জন্মের আগে যখন আমাকে হসপিটালে নিয়ে যায় তার আগের দিন আমার দাদার
ছোট মেয়েটা বেলেঘাটার আইডিতে ভর্তি ছিল, তারপরে যখন ওরা আমার বাড়িতে
দেখতে আসে তখন আমি হসপিটালে। সেই দিনেই ছুটি হয়ে গেছে। তখন দাদা বৌদি
আমার বর আর শাশুড়ি আমাকে আর আমার যমজ সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি
গিয়েছিল তার এক মাস পরে আমার বৌদির একটা ছেলে হল।
যখন ওদের ছ মাস বয়স তখন ওদেরকে নিয়ে আমি বাড়ি এলাম আর তারপরই শুরু হল
আমার আসল লড়াই। বাড়িতে এসে ওদের নিয়ে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছি। তখন
আমার বরের কাজকর্ম খুব একটা ভালো ছিল না উপার্জনও খুব কম। বাড়িতে একটা
ছোট হ্যান্ড মেশিন ছিল তাতে ছোট ছোট প্লাস্টিকের ঢাকনা তৈরি হতো। তাতে আর
কিই বা ইনকাম। এদিকে আমার বুকের দুধ তেমন হতো না কত দুধ কিনে খাওয়াবো।
কি করতাম জানেন? এক কৌটো দুধ আনত তাতে ময়দা দিয়ে একটু দুধ দিয়ে ছোট
হাঁড়িতে জাল দিয়ে খাওয়াতাম। আমার শ্বশুরের আলু পেঁয়াজ আদা রসুনের
দোকান ছিল। আমাদের এই কসবা বাজারে। বাবার দোকানে বাবাকে সাহায্য করার
জন্য মা চলে যেত। তখন ওই ছোট ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে খুব অসুবিধা হতো।
তবে আমার জা ননদও দেখত। আবার মা দোকান থেকে চলে এলে বাবা-মা সবাই দেখত
সবাই খুব ভালোবাসতো।
তখন তো আমাদের গ্যাস বা স্টোভ ছিল না, ওই মাটির তোলা উনুন ছিল, তাতে
কয়লা দিয়ে রান্না হতো। আবার আঁচ কমে গেলে ছোট ছোট কাঠের টুকরো ডাবখোলা
এইসব দিয়ে রান্না হতো। তখন ঘরে কি ধোঁয়া........ ওরা একদম ছোট, ওদের
চোখে ধোঁয়ায় জলে ভরে যেত আর খুব কান্নাকাটি করতো।
কি করব কোন উপায় নেই! তবে আমাদের একটা অন্য জায়গা ছিল সেখানে বাবা একটা
ছোট্ট বাড়িও করেছিল, সেটা আমাদের এই বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। আমার বর
সেখানে বলপেনের মেশিন লাগিয়েছিল। ওরা যখন একটু বড় হল তখন ওদের দুজনকে
কোলে নিয়ে ওর বাবা আর আমি ওই বাড়িতে প্রতিদিন যেতাম। সেখানে ওদের
দুজনকে প্লাস্টিকের উপরে শুইয়ে দিয়ে রিফিল বানাতাম। তারপর বাড়ি আসতাম
রাত দশটা এগারোটায়। রোজ এমন করে বাড়ি আসতাম যেতাম। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
প্রতিদিনই আমাদের এই রকমই যেত।
.jpg)
আমার বড় মেয়ে তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে, ও বাড়িতে থাকতো পড়াশোনা করতো।
শাশুড়ি ছোটজা তাদের কাছে থাকতো। ওদের থেকে দেড় বছরের ছোট আমার জায়ের
মেয়ে। সবাই ওরা পিঠাপিঠি। বাড়িতে চার- চারটে বাচ্চা, বলো কি অবস্থা!
বলতে নেই ওরা ছোট থেকে যখন একটু বড় হলো মানে দুধ ছাড়া অন্যান্য শক্ত
খাবার খেতে শিখলো তখন ওদের যা খাওয়াতাম তাই খেত। যা দিয়ে ভাত খাওয়াতাম
তাই খেত, অন্য বাচ্চাদের খাওয়াতে গেলে কত কি বায়না করতো, কেউ
কান্নাকাটি করত আর কাউকে কাক বক কুকুর বেড়াল ও দেখাতে হতো। কেউ মুখে ভাত
নিয়ে কেবল নাড়াচাড়া করত, খেত না। কিন্তু সত্যি বলতে ওদের এসব
বায়নাক্কা ছিল না। আমার জায়ের মেয়েকে কত কষ্ট করে খাওয়াতে হতো। শুধু
বমি করে দিত। ওকে খাওয়াতে গেলে এক ঘন্টা লেগে যেত। আমার জা বলতো-
- দিদিরা দেখ তো কেমন ভালো, ওদের যা দেবে তাই দিয়ে কি সুন্দর করে খেয়ে
নেয়।
তারপরে ওদের একটু একটু করে শেখাতাম, তোমার মাথা কই? হাত কই? চোখ কই? আবার
একটু বড় হতে অ আ ই ঈ। ছোট ছোট ছড়া বলতে বলতে কোলে নিয়ে চাঁদ দেখিয়ে
ঘুম পাড়াতাম। আমাদের সময় বর্ণমালা ছিল একরকম,এখনকার মত নয়। তখন পড়েছি
-
-"অ" এ অসৎ হলে কথায় কাজে দুঃখ পাবে জগৎ মাঝে।
"আ" এ আদেশ করলে গুরুজনে পালন কর ভালো মনে।
"ক" এ কটু বাক্য ছাড়তে হবে বিদ্যা অর্জন হবে তবে।
"খ" এ খলনা করা স্বভাব যাদের সুখ শান্তি কভুনা রয়ে।
আর এখন- "অ" এ অজগর আসছে তেড়ে।
"আ" এ আমটি আমি খাব পেড়ে।
"ক" এ কাকাতুয়ার মাথায় ঝুটি।
"খ" এ খেঁকশিয়ালি পালায় ছুটি।
.jpg)
আমার ছোটবেলায় আমি কেমন বই পড়েছিলাম সেইসব আমার মেয়েদের কাছে গল্প
করতাম। তারপরে আমাদের ছোটবেলায় কত মজার মজার গল্প খেলা সেই সব ওদের কাছে
বলতাম। সেইসব দিনগুলো যেন আজও মনের মধ্যে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
মেয়েরা বলতো তোমরা কত কি করেছ, আর আমরা এসব দেখিনি। তারপরে ওরা স্কুলে
ভর্তি হল। ওদের স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা আবার বাড়িতে রান্না বান্না,
কাজকর্ম।
এরপর ওর বাবা কারখানার জন্য একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সেমি অটো মেটিক মেশিন
কিনলো, সাথে আরও দুটো ম্যানুয়াল মেশিন কিনলো। তখন কারখানায় দু তিনজন
ছেলে কাজ করতো। তাদেরকে বাড়ি থেকে রান্না করে ভাত দিতে হতো। সংসারে
এতগুলো লোকের রান্না বান্না, সংসারের অন্যান্য কাজকর্ম, তার ওপর
বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা.........এই ভাবেই চলছিল
দিনগুলো।
ওদের অনেক ছোটবেলা থেকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলাম। প্রথমে একটা
আন্টি ছিল তারপরে বড় হতে একজন স্যারের কাছে ভর্তি করে দিলাম। জানেন
ছোটবেলা থেকে আমার খুব ইচ্ছা ছিল নাচ শেখার। তখন তো আমি পারিনি। তাই আমার
অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো আমি আমার মেয়েদের মধ্যে দিয়েই পূরণ করার চেষ্টা
করছিলাম। আর আমার বড় মেয়ে সুমনা ওর গানের গলা খুব ভালো ছিল। ও গান
শিখতো আর আমার যমজ মেয়ে দুজনে নাচ করত। স্যার ওদের খুব ভালোবাসতেন।
স্যার ওদের একজনকে ডান হাত আর একজনকে বাম হাত মনে করেন। মন প্রাণ দিয়ে
ওদের শেখাতেন। প্রায়শঃই প্রোগ্রাম লেগেই থাকতো বললেই হয়। ওরা দুজন
আইডেন্টিক্যাল যমজ, একই রকম দেখতে আর খুব ভালো নাচতো বলে স্যার ওদের
লাইনের সামনে দিতো। ওদের সঙ্গে আমাকে সব জায়গায় যেতে হতো। আর যা ওদের
ওখানে খেতে দিত মানে প্রোগ্রামের সময় গেলে যেসব রিফ্রেশমেন্ট ওরা পেত
প্রোগ্রাম হয়ে গেলে অন্য বাচ্চারা সবাই খেয়ে নিতো, ওরা কিন্তু খেত না।
রিফ্রেশমেন্ট এর প্যাকেট এনে আগে ঠাকুমাকে দেবে, ঠাকুমাকে খাবারের
প্যাকেটটা দিয়ে বলতো-
- তোমার যেটা খুশি সেটা খাও। তারপরে আমরা খাব।
ঠাকুমা বলতো-
.jpg)
- তোরা একটুও খাসনি?
-না আগে তুমি খাও, তারপরে আমরা খাব।
যা কিছু নাচের পোশাক গহনা সব আগে এনে ঠাকুমাকে পরাবে, পরিয়ে ছবি তুলবে।
পুজোতে নিজেদের নতুন পোশাক জামা জুতো ব্যাগ সাজ সরঞ্জামের জিনিস সব এনে
আগে ঠাকুমাকে পরাবে তারপরে ওরা পড়বে। ওদের ঠাকুমাও তেমন, ওদের বাধ্য
মেয়ের মত ওদের কাছে বসে যা সাজাতো তেমনি সাজতো, আবার পোজ দিয়ে ফটো ও
তুলত। ঠাকুমাকে ওরা খুব ভালোবাসতো। ভালবেসে ঠাকুমার জন্মদিনও পালন করত।
ঠাকুমার সাথে লুডো খেলতো। আমার শাশুড়ি মা ও ওদের খুব ভালবাসতেন। কোথাও
গেলে কেউ খাবার দিলে ওদের জন্য সেই খাবার ঠিক আঁচলে বেঁধে নিয়ে আসতেন।
যেমন ভালোবাসতেন তেমন খুব কড়া শাসনও ছিল। তারপরে ওরা স্কুলের গণ্ডি
পেরিয়ে কলেজে প্রবেশ করল। কলেজে পড়ার পাশাপাশি আরো অনেক কিছু করেছে।
রাইফেল শুটিং, স্পোকেন ইংলিশ, সুইমিং, কম্পিউটারে ডিপ্লোমা করার,
পাশাপাশি ছবি আঁকাও শিখতো। আমার দুই মেয়ে নাচে গ্র্যাজুয়েশন পাশ করলো।
আর আমার যমজের বড় মেয়ে সুস্মিতা রাইফেল শুটিংয়ে রাজ্যস্তরে ৫ বার
সোনার পদক জয়ী হয়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ওর নাম সহ
ছবি। ওর বাবা ওদেরকে সবকিছুই শিখিয়েছে। মেয়ে বলে কোন কিছু থেকেই ওদেরকে
বঞ্চিত করেনি, ওরা যা শিখতে চেয়েছে যা পড়তে চেয়েছে সবকিছুতেই ওদেরকে
সাপোর্ট করে গেছে সব সময়। কলেজের গণ্ডি পেরোনোর পর ওরা দুজনে একই সাথে
একই জায়গায় চাকরি ও পেল।
ছোটবেলা থেকে দুজনেই সব ক্লাসে একসঙ্গেই পাস করেছে। যা যা শিখেছে সবকিছুই
একসাথে। একজনের জ্বর হলে আর একজনের ঠিকই জ্বর হতো, একজনের কাশি সর্দি হলে
ঠিক আর একজনের হবেই। এমনকি অবাক কান্ড একজনের গলার চেইন হারিয়ে গেছে,
পরে দেখছি অন্যটারও সেই একই রকম দেখতে গলার চেইনটা হারিয়ে গেছে, এটা
কিন্তু গল্প কথা নয়। ওর নুপুর হারিয়ে গেছে তো সেই আবার অন্যটির নুপুর
টা ভেঙে গেল। মোট কথা দুজনেই পরতে পারবে না। এর যা হবে তাই আর একজনেরও
ঠিক হবেই।
আগে লোকের মুখে শুনতাম বিশ্বাস হতো না, আজ আমার নিজের যমজ সন্তান হওয়ায়
তা আমি উপলব্ধি করছি।
.jpg)
তিন মেয়ে, শশুর ,শাশুড়ি, বর, কারখানার আরো ৪-৫ জন ছেলে, জা, দেওর, ওদের
মেয়ে, আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের এত সব রান্নাবান্না করা, ওদের বড়
করা, পড়াশোনা, তার বাইরে ছবি আঁকা, নাচ, গান, কম্পিউটার, সুইমিং, রাইফেল
সুটিং এইসব নানান সাত-সতেরোর ঝামেলার মধ্যেও অনেক কষ্ট করে ওদের বড়
করেছি। শশুর মশাই ওদের খুব ভালবাসতেন। ওদের জন্য জামা কাপড় ফল মূল
আনতেন। আমাদেরকেও খুবই ভালোবাসতেন। তারপর একদিন শ্বশুরমশাইকে একটি গাড়ি
ধাক্কা মারে। তারপর উনি অনেকদিন হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। তারপর কিছুটা
সুস্থ্য হতে বাড়িতে আনলো আমার বর। সেবা যত্ন করতাম কিন্তু অবশেষে
বাঁচাতে পারলাম না উনি চলে গেলেন।
একটা নাতনির ও বিয়ে দেখে যেতে পারলেন না। তারপর আমার শাশুড়িরও আস্তে
আস্তে অনেক বয়স হতে লাগলো, ওনার অনেক সুগার ছিল। রোজ দুবেলা ইনসুলিন
দিতে হতো। উনিও চলাফেরা করতে পারতেন না, খুব কষ্ট হতো। প্রায় চার পাঁচ
বছর বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। ওনাকে স্নান করিয়ে দিতে হতো, খাইয়ে
দিতে হতো, বিছানায় পায়খানা প্রসাব করলে পরিস্কার করে দিতাম। সময় সময়ে
ওষুধ খাবার ইত্যাদি খাইয়ে দিতাম। আমার মেয়েরাও করতো। এমন কি ঠাকুমাকে
সেই অবস্থাতেও জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতো। তারপরে আস্তে আস্তে ওনার শরীরের
সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অচল হয়ে পড়ল। তখন খাওয়া দাওয়া ভালো করে করতে
পারতেন না। একদিন আমাকে বললেন-
- আমাকে একটু ভাত খাওয়াবি?
ভালো করে বলতেও পারতেন না। ওই আমার কাছে শেষ ভাত খেয়েছিলেন। উনার শেষ
দিনটা ভীষণ কষ্টের ছিল, সারারাত আমাদের কারোর চোখে ঘুম নেই। মুখের দিকে
শুধু তাকিয়ে আছি, উনার সাথে সাথে আমরাও সবাই খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম সেইদিন।
ওনার গলায় ঘরঘর আওয়াজ হচ্ছিল। এই ভাবে সারাটা রাত কেটে গেল। সকালে ওনার
বিছানা ছেড়ে একটু বাথরুমে গিয়েছি, মেয়েরা যে যার মুখ হাত ধুচ্ছে। মাকে
একটু ধাতস্থ দেখে ওনার বিছানা ছেড়ে সবাই চলে গিয়েছিলাম যে যার কাজে। এক
মেয়ে ছুটে এসে বলল-
- মা দেখো ঠাকুমা কেমন করছে। ছুটে এসো সবাই।
সবাই এসে ওনার গালে একটু করে গঙ্গাজল দিলাম, আমার তিন মেয়ে আমি ও আমার
বর আমরা সবাই ওনার গালে জল দিলাম। সবার হাতের জল খেয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করলেন। সকালবেলা আমরা যখন ওনার বিছানা ছেড়ে চলে গেলাম তখন উনিও
আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেলেন। ওনারও আক্ষেপ রয়ে গেল নাত জামাই দেখা হলো
না।
.jpg)
তার ঠিক কয়েক বছর পর আমার দুই যমজ মেয়ের একসাথে একই দিনে বিবাহ ঠিক
হলো। খুব ধুমধাম করে বিয়ে হল। তার ঠিক ২ বছর পর বলতে পারেন লকডাউনের
সময় আমার বড় মেয়ের বিয়ে হল। আমার বড় মেয়ের একটা পুত্র সন্তান
হয়েছে তার বয়স এখন এক বছর নয় মাস, খুবই দুষ্টু হয়েছে। আমি ওকে অংশু
বলে ডাকি, ওর ভালো নাম তীর্থঙ্কর।
আমি যা বলব যা করব ও ঠিক তাই করবে। আমি পুজো করবো, শাঙ্খ বাজাবো, প্রদীপ
দেখাবো, ও ও ঠিক সেটাই করবে। টিভিতে নাচ হলে ঠিক দেখে দেখে নাচ করবে। আমি
ব্যায়াম করলে ও ঠিক দেখে দেখে ব্যায়াম করবে। কারোর যদি ফোন এসেছে আমার
হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে নিজে কি সুন্দর করে ফোনটা কানে ধরবে। কি পাকা
আজকালকার বাচ্ছারা।
আগে ছিলাম মেয়ে, তারপরে হলাম বৌমা, তারপর হলাম মা, এখন হলাম দিদিমা। নয়
নয় করে ৫০ বছর পেরিয়ে চলে এসেছি। এখন আমার তিন মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে
তারা এখন যে যার সংসার করছে। আমি এখন আমার যোগা ক্লাস, বন্ধুবান্ধবদের
সাথে সময় কাটে। আমার বাড়ির বারান্দায় একটি ছোট্ট ফুলের বাগান আছে। আমি
নিজের হাতে সেগুলি পরিচর্যা করি। সমস্ত সবজির খোসা, ডিমের খোসা, পাকা
কলার খোসা রৌদ্রে শুকিয়ে মিক্সিতে গুঁড়ো করে সেগুলি গাছের জৈব সার
হিসেবে ছড়িয়ে দিই। পেঁয়াজের খোসা ও রসুনের খোসা অনেকটা একসাথে জমিয়ে
সেগুলি আগের দিন রাতে জলে ভিজিয়ে পরদিন সকালে সেই জলটা ছেঁকে নিয়ে গাছে
ছড়িয়ে দিই। তাতে গাছের পাতা সবুজ হয় ও গাছের পোকামাকড় মরে। এইসব বলতে
পারেন আমার গাছের খাবার। জানেন একদিন যদি জল দিতে দেরি হয়েছে ওমনি দেখব
ওরা যেন মাথা নুইয়ে আমার উপর অভিমান করেছে। আমি দেখে বলি-
- বাবু আমি তোমাদের খেতে দিতে দেরি করেছি?
.jpg)
ওরা যেন আমার সন্তান। ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে আমি খুব খুশি হই। যখন গাছে
সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটে দেখে মনটা আমার আনন্দে ভরে ওঠে। আমি সবসময় যা
কিছু করি, ভালো কিছু দেখি, বাড়িতে পুজো করি, নতুন কিছু রান্না করলে সব
সময় ফটো তুলে তা সবাইকে পাঠিয়ে দিই। আমার খুব ভালো লাগে। আমাদের সময়
এত মোবাইল ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ এসব ছিল না, এখন টাচ ফোন আছে। মেয়েরা
শিখিয়ে দিয়েছে তাই একটু-আধটু চেষ্টা করি। এতে আমার সময় কাটে। অনেক
কিছু জানতে পারি, শিখতে পারি। শেখার তো কোন শেষ হয় না। কাউকে কিছু
পাঠালে সে যদি লাইক বা কোন কমেন্ট করে তাহলে খুব ভালো লাগে। আমার বর খুব
সাদাসিধে মানুষ। খুব কম কথা বলেন। সব সময় নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
কিন্তু আমাদের কোনো কাজে কখনও বাধা দেন না। আমাদের মধ্যে কখনও ঝগড়া
হয়েছে বলে তেমন মনে পড়ে না।
এখন ওনার জন্মদিন, মেয়েদের জন্মদিন, আমাদের বিবাহ বার্ষিকী সব পালন করি।
আমার বরের জন্মদিন একটি বিশেষ দিনে পালিত হয়। ২৩শে জানুয়ারি।বলতে পারেন
নেতাজির পরে ওনার স্থান। । আমাদের ঘরের একজন অন্যতম নেতাজি। আমাদের বিবাহ
বার্ষিকীও একটি বিশেষ দিনে পালিত হয় তা ১৪ই ফেব্রুয়ারি। তাই বিবাহ
বার্ষিকীর পাশাপাশি আমাদের ভ্যালেন্টাইন্স ডেও উদযাপন করা হয়ে যায়।
আমার মেয়ে জামাইরা, জা দেওর, ননদ ভাগ্নীরা সবাই আসে। সেদিন আমরা কেক
কাটি, নাচ গান করি একসাথে খাওয়া দাওয়া করি। শেষে সবাই আমাদেরকে উপহারও
দেয়।
জানেন তো আমি ও আমার পরিবারের প্রায় সকল সদস্যরা একটি সংস্থার সাথে
যুক্ত আছি। সংস্থাটি "মাদার আর্থ ফাউন্ডেশন" নামে পরিচিত। এখানে বিভিন্ন
ধরনের সমাজ সংস্কারক মূলক কাজ হয়। বৃক্ষরোপণ, নাচ-গান আবৃত্তি পাঠ, কুইজ
কম্পিটিশন ও আরো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এসবের মধ্যে সময় কেটে
যায়। পাশাপাশি রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, মাঝে মাঝে আলপনা দেওয়া, ঘরে
বসে বসে গল্পের বই পড়া, খবরের কাগজ পড়া, ছবি আঁকা, গান গাওয়া, যোগাসন
করা, গাছেদের দেখাশোনা, অল্প বিস্তর পূজা পাঠ, দাদা দিদি আত্মীয়
পরিজনদের সাথে ফোনে কুশল বিনিময় এইসব করি। তার মধ্যে তো শরীরে নানা রকম
অসুখ বিসুখ লেগেই আছে। শরীর থাকলে অসুখ তো হবেই। তোমাদের আশীর্বাদে এখন
আমি আমার সমস্ত পরিবার ও বর্ণে বর্ণে পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে খুবই
ভালো আছি। শুধু তোমরা পাশে থেকো।
প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যায় মা-বাবা ও ঈশ্বরকে প্রমাণ করে বলি যদি আমি কিছু
ভুল ত্রুটি করে থাকি আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমাকে সঠিক রাস্তা দেখিও।
তোমাদের আশীর্বাদের হাতটা আমার মাথায় রেখো তাহলে শত বাধা বিপত্তি এলেও
ভালো থাকবো ও সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টা করব।
.jpg)