কাঁটা
ঝুম্পা মন্ডল,
ডায়মন্ড হারবার, দঃ ২৪-পরগনা
নিস্তব্ধ দুপুরে কাঁটা ঝোপের মধ্যে খুঁজে খুঁজে কয়েকটা বোতল পেলো ভোলা ,
শুঁকে দেখলো সে, মদের বোতল। তাদের পাড়ার কিছু ছেলে আজকাল এখানে বসে মদ
গাঁজা খায় সন্ধের পর থেকে। এলাকার সবাই কম বেশি জানে, কিন্তু কেউ কিছু
বলেনা। কাদের ওত সাহস আছে ওদের মুখে তর্ক করবে!! তাই সবাই চুপচাপ থাকে।
নিজেরা সাবধান হয়, ঐদিক এড়িয়ে চলে। ভোলা বোতল গুলো ব্যাগে ভরে , আগেও
এইভাবে বোতল কুড়িয়ে নিতে এসেছে সে, লোহা ভাঙা কড়াই ভাঙার কাছে কাঁচের
বোতল বিক্রি করলে দুই পয়সা আয় হয় তার। কাঁটা ঝোপ সরিয়ে আরেকটু ঝিলের
একদিকে চোখ আটকালো তার। ভুরু কুঁচকে দেখলো ঝিলের একধারে অনেকগুলো ছোট ছোট
মাছ কিলবিল করছে, অবাক হয় সে, একসাথে এতো মাছ? তার চোদ্দ বছর বয়সের
অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারলোনা যে ব্যাপারটা কি? ঝিলের ওইপ্রান্তটুকুই মাছের
এতো আনাগোনা কেন?
যাইপারে হোক, অনেক মাছ ধরতে পারবে এই খুশিতে দৌড়ে যায় সে ঘরের দিকে, ঘর
থেকে ছাকনি জাল এনে ঝিলে ফেলতে গিয়ে জলে নামে ভোলা। ঝিলের এদিকটায় বেশ
গভীর। ধীরে ধীরে নামতে নামতে প্রায় গলা পর্যন্ত ডুবে যায় সে। মাছ গুলো
কিলবিলিয়ে ওঠে। ছাকনি জাল টানতেই একসাথে ওঠে অনেক মাছ, সেই সঙ্গে জলে
নাড়া লাগতেই ভোলা নিজের নাক চেপে ধরে, কেমন যেন পচা দুর্গন্ধ। হঠাৎ ভোলার
মনে হয় তার পা টাতে কেউ কামড়ে টেনে ধরেছে, "ও বাবাগো মা গো " বলে
কোনোরকমে ছাকনি জাল নিয়ে উঠে আসে সে জল থেকে। উঠে এসে ভয়ার্ত চোখে দেখে
পায়ের পেটে কেমন যেন কামড়ানোর দাগ মনে হচ্ছে না? ছাকনির মাছ গুলো তখনও ছট
ফট করছে ছাকনিতে। ভোলা সেগুলো ওখানে ফেলে চেঁচাতে চেঁচাতে সে দৌড়ায় বাড়ির
দিকে। ঝিলের জলে কিছু তো একটা আছে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঝিলের ধারে লোকে লোকেরান্য, পুলিশও আসে, লোকজন জলে
নামে, ডুব সাঁতার দিয়ে তোলা হয় জলে ভিজে ফুলে ঢোল হয়ে যাওয়া সাদা বডিটা ,
জামাকাপড় ছেঁড়া, একটা ভারী পাথর বডিটার গলায় দড়ি দিয়ে বাঁধা। ফিসফিসিয়ে
ওঠে লোকজন, আরে একটা সোমত্ত মেয়ে...।
মাছ গুলো একটা চোখ খেয়ে ফেললেও আরেকটা অর্ধেক খাওয়া চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে
আসছে যেন। গাল হাঁ করা দাঁত গুলো বেড়িয়ে এসে ফুলে ফেঁপে সারা গায়ে মাছে
খুবলে খেয়ে সে এক বীভৎস রূপ।
আশেপাশের এলাকার সবাই ঝাঁপিয়ে এসেছিলো নাকে রুমাল চাপা দিয়ে , উঁকি মেরে
দেখলো খোবলানো যুবতী শরীর, মুখ দেখে কিন্তু কেউ চিনতে পারলোনা মেয়েটাকে।
ছাকনিতে ধরা মাছ তখনও ঝিলের কাঁটা ঝোপের বনে ঘাসের উপরে, ভোলা ছাকনি সমেত
মাছ গুলো ঝিলে ফেলে দেয় ঘেন্নায় আর ভয়ে। পায়ে আটকে যাওয়ার জায়গাটা কেমন
যেন মিসমিস করে তার। চুলকাতে চুলকাতে লাল হয়ে ওঠে জায়গাটা।
ভ্যানে তোলার সময় সাদা কাপড়ে ঢাকা মৃতদেহর বেড়িয়ে থাকা সাদা পায়ের জং ধরে
যাওয়া নকল নুপুরটা দেখা যায় এঁটে বসে আছে ফুলে যাওয়া পায়ের মাংসে।
কে কখন কিভাবে মেরে ফেলে রেখে দিয়েছিল মেয়েটাকে। পোস্টমর্টেম হবে বলে
পুলিশ নিয়ে গেলো। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে হয়তো মর্গেই পচবে শরীরটা।
আশেপাশের গ্রামের লোকেরা আলোচনা করে, কে হতে পারে! কোথাকার মেয়ে! সবার
ঘরের মেয়েরাই তো অক্ষত, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সবাই। মনে মনে ভাবে
নিশ্চই খারাপ বাড়ির মেয়ে, কাদের সাথে এসেছিলো এখানে নিশ্চই নোংরামি করতে
যেমন কর্ম তেমন ফল। যদি'র উপরে ভিত্তি করে নানারকম গল্প ঘোরে আশেপাশের
এলাকার লোকের মুখে মুখে।
কিছুদিন পরে পুলিশের কাছ থেকে খবর আসে পাশের পাড়ার ফুলকি পাগলী ছিলো ওটা।
ঠিক ঠিক, কথাটা শোনার পরে সবার খেয়াল পড়েছিল। পাড়ার ইস্কুল মাঠের মধ্যে
বটগাছের তলায় কাঁথা কানি জড়ো করে শুয়ে থাকা ফুলকি পাগলীকে কোথাও পাওয়া
যাচ্ছে না তো!!
অনেকে ভাবে পা পিছলে পরে গিয়েছিলো হয়তো। কিন্তু ঐযে গলায় বাঁধা পাথরটা?
একটা পাগলী কিভাবে কারোর পথের কাঁটা হতে পারে ভেবে অবাক হয় সবাই।
কোথা থেকে এসেছিলো পাগলীটা কেউ জানেনা, বছর তিনেক হলো ওই বট গাছের নিচে,
ছুটির দিনে স্কুল বারান্দায় থাকতো। দিনরাত হাততালি দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচতো,
গান গাইতো জোরে "তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ।"
ফুলকির সামনের দাঁত গুলো উঁচু বলে ঠোঁট দুটো বন্ধ হতোনা, কথার চোটে থুতু
ছিটকাতো মুখ থেকে। অনেকে খ্যাপাতো ওকে, "ও ফুলকি নূপুর দেবো নাচ দেখা "
নূপুরের কথা শুনলেই ফুলকির চোখ মুখ উজ্জ্বল হতো। কারোর দেওয়া শুধু কালো
নোংরা চুড়িদার পরে হাত পা ছুঁড়ে ঘুরে নাচ দেখাতো সে।
অনেকে সেই নাচ দেখে হেসে গড়িয়ে পড়তো, কেউ মুখ বেঁকাতো, কেউবা লোলুপ
দৃষ্টিতে ফুলকির মধ্যেও কাম খুঁজতো।
নাচ শেষে ফুলকি "নুপুর দে দে না আ আ...."বলে দুই হাত বাড়িয়ে হেসে চোখ গোল
গোল করে এগিয়ে যেত যে বলেছিলো তার দিকে । অন্যরা আবারো নাচ দেখাতে বলতো
তাকে, ফুলকি শরীর মুচড়িয়ে আবার নাচতো নুপুরের আশায়, কিন্তু কেউ তাকে
নুপুর কখনো দেয়নি।
কিন্তু সেদিন ফুলে যাওয়া পায়ে বসে থাকা নুপুরটা!! তাহলে কি নূপুরের লোভ
দেখিয়েই....!! সেকি কাউকে চিনতে পেরেছিলো! তাই পথের কাঁটা সরাতে তাকে
এইভাবে...।
পুলিশের তদন্ত এগোয় না, দরকার নেই বলে, পাগলী গেছে আপদ গেছে। এলাকার সেই
কয়েকটা ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার মুচকি হেসে মদ খায় ঝিলের পাশে
বসে। ভোলা আবারো মদের বোতল জোগাড় করতে যায় কাঁটা ঝোপের ভিতর থেকে।
আশেপাশের বাড়ির লোকেরা নিশ্চিন্তে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তার বাড়ির
মেয়েটা ঠিক আছে ভেবে।।