কর্ণগড়ে কিছুক্ষণ
অমৃতা ব্যানার্জী,
মেদিনীপুর শহর
আমার মনের ভিতরের ছোট্ট পাখিটা মাঝেমধ্যেই নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের বাইরে
যাওয়ার জন্য ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। কিন্তু সবসময় তো দূরে যাওয়া সম্ভব
নয়। তাই নিজের আশেপাশেই মুক্তির ঠিকানা খুঁজতে হয়। রবি ঠাকুরের কবিতার
অবলম্বনে বলি, সত্যি বিদেশ ভ্রমণের লালসায় আমাদের ঘরের আশেপাশের
সৌন্দর্য্য অবহেলিত রয়ে যায়।
জুলাই, ২০২৩, অফিসের কাজের চাপে আমার নাজেহাল অবস্থা। কিন্তু মন-পাখিটা
ডানা ঝাপটাচ্ছে ক্রমাগত। হঠাৎ মাথায় এল কর্ণগড়ের কথা। আমার বাড়ি
মেদিনীপুরে। কর্ণগড় আমার বাড়ি থেকে খুব একটা দূরে নয়। অগত্যা কর্ণগড়
যাওয়াই ঠিক হল।
১৫ই জুলাই, ২০২৩ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে রওনা হলাম আমি, মা, বাবা। আগে
থেকে গাড়ি বুক করা ছিল। কয়েক মিনিট পরে মাসিমণির বাড়ির সামনে গাড়ি
দাঁড়াল। মাসিমণিও হল আমাদের সঙ্গী।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার শালবনীর অন্তর্গত একটি ছোট গ্রাম কর্ণগড়।
মেদিনীপুর শহর থেকে দূরত্ব প্রায় বারো কিলোমিটার।
শহর অতিক্রম করে গাড়ি চলেছে। কিছু বছর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে
এসেছিলাম কর্ণগড়ে। তখন আমরা খড়্গপুরে থাকতাম। জঙ্গল মহল তখন উত্তপ্ত।
সেই সময় কর্ণগড় যাতায়াতের রাস্তাও ছিল অত্যন্ত খারাপ। কিন্তু এখন
চালচিত্র বদলে গেছে। মসৃণ পথ ধরে চলেছি আমরা। দু’ধারে ঘন সবুজ বনভূমি।
আজকাল সচরাচর এতো সবুজ চোখে পড়ে না। চোখ ও মন জুড়িয়ে গেল।
কর্ণগড় ঐতিহাসিক স্থান। বহু বছর ধরে সদগোপ রাজারা এইখানে রাজত্ব
করেছিলেন। কর্ণগড়ের শেষ রাজা অজিত সিং নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি মৃত্যুর
আগে সমস্ত সম্পত্তি তাঁর দুই রাণী - রাণী ভবানী ও রাণী শিরোমণির হাতে
তুলে দেন। ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম বৃহৎ কৃষক আন্দোলন চুয়াড় বিদ্রোহের
নেত্রী ছিলেন রাণী শিরোমণি।
কর্ণগড়ে আজও আছে রাণী শিরোমণির প্রাসাদ। তবে সংরক্ষণের অভাবে আজ তা
ভগ্ন, জীর্ণ। ধীরে ধীরে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে বঙ্গভূমির উজ্জ্বল
ইতিহাস।
বর্তমানে কর্ণগড়ের মূল আকর্ষণ দেবী মহামায়ার মন্দির। আধ ঘন্টার মধ্যে
আমরা মন্দিরের সামনে পৌঁছলাম। আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন মন্দিরের আশপাশের
দু-একটি ঝুপড়ি দোকান ছাড়া আর কিছু ছিল না। মন্দিরের বাইরের রাস্তা ছিল
পাথুরে, ভাঙাচোরা। খালি পায়ে হাঁটার সময় লাগছিল খুব। এইবার দেখলাম
মন্দিরের চারিদিক পুরো পাল্টে গেছে। বাঁধানো চাতালের ওপর সারি দিয়ে বেশ
কয়েকটি দোকান। মন্দিরে প্রবেশের পথও বাঁধানো, পরিষ্কার।
সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত একই প্রাচীরের মধ্যে আনন্দলিঙ্গ দণ্ডেশ্বর
মন্দির ও তার বাম দিকে ভগবতী মহামায়ার মন্দির। শিব মন্দিরে কোন
প্রতিকৃতির পূজা হয় না। সবার বিশ্বাস ৮ ফুট গভীর গর্তে শিবলিঙ্গ আছে এবং
সেইখানে মহাদেবের বাস। মহাদেবকে কেন্দ্র করে দুই নাগের বাসও আছে। এই
স্থান "যোনিপিঠ" নামে পরিচিত। বামদিকে খড়গেশ্বর শিবের লিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত
আছে। মন্দির প্রাঙ্গণে আছে নাটমণ্ডপ। সম্পূর্ণ প্রাঙ্গণ ওড়িশা স্কুল অফ
আর্টসের আদলে নির্মিত।
আমরা বেশ সকাল সকাল পৌঁছনোর ফলে মন্দির প্রায় খালি পেলাম। প্রথমে গেলাম
মহামায়া মন্দিরে। মহামায়াকে পুজো দিয়ে, তাঁর সামনে করজোড়ে নিজের
আকুতি জানিয়ে গেলাম আনন্দলিঙ্গ দণ্ডেশ্বর মন্দিরে। মহামায়া মন্দিরের
মুখোমুখি গুরুদেবের মন্দির। আনন্দলিঙ্গ দণ্ডেশ্বর মন্দির অদ্ভুত ঠাণ্ডা।
এসি হার মানে এই মন্দিরের কাছে।
সমগ্র মন্দির প্রাঙ্গণ জুড়ে অদ্ভুত প্রশান্তি ছড়ানো। চারিদিক অজস্র ফুল
গাছ দিয়ে সুসজ্জিত।
মন্দির প্রাঙ্গণে ফটো তোলা নিষিদ্ধ। তাই বাইরে বেরিয়ে কয়েকটা ফটো তুলে
ফেরার পথ ধরলাম। মন-পাখিটা শান্ত হল। ক্ষুদ্র অথচ কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পেয়ে
সে যে বড্ড খুশি।
(সমাপ্ত)
