লাভ ইউ মা
উজ্জ্বল দাস,
কোলকাতা
- এই, কিরে খেয়েছিস?
- হ্যাঁ মা, জানো তো আজ আমি কৌশিকের টিফিন খেয়েছি। আমারটা ওকে দিয়ে
দিয়েছি। তুমি কী’সব দাও সেই একই, এক ঘেয়ে। ধুর, ওদের মা’রা বেশ ভালো ভালো
খাবার করে দেয় জানো। মা তুমি খেয়েছো?
- হু। চল চল জলদি চল। মেলা কাজ পড়ে আছে। আজ পড়া পেড়েছিস সব?
স্কুলে পড়ার সময় রোজ মায়ের একই প্রশ্ন। আজ বহু বছর পর যখন চাকরি করি তখনও
মায়ের একই প্রশ্ন। সিলেবাস কি তিরিশ বছরেও পাল্টায় না। কী অদ্ভুতরে বাবা।
মা একই থাকলেও আমি কিন্তু আজ পাল্টে গেছি। আমার উত্তরটা পাল্টে গেছে। আজ
আমার উত্তরটা একটু আলাদা।
- কী বিরক্তিকর মা। রেগুলার ফোন করে বিরক্ত করো না’তো। আমি মিটিংয়ে থাকি।
কাজের খুব প্রেসার বোঝো না নাকি একটুও বলোতো। আশ্চর্য্য। প্লিস স্টপ দিস
মা, বোরিং।
- আচ্ছা বাবা, হয়েছে। খয়ে নিস। বললেই তো হয়।
-না, তুমি এই রেগুলার এক ঘেয়ে ফোন করবে নাতো। আমি খেয়ে নেব ঠিক।
- আচ্ছা। বাবা, আচ্ছা।
বলে মা যখন ফোনটা রেখে দিল, তখন মনে হলো, মায়ের খাওয়া হয়েছে কিনা জানতেও
চাইলাম না। আজ আমি কত পাল্টে গেছি। না হয় মা একবার জানতেই চাইলো। তাতে
কী। যদিও আবার পরের দিন নিয়ম মেনে একই সময়ে ফোনটা বেজে ওঠে।
কখনো হয়তো অনেকটা দেরি হচ্ছে বাড়ি ফিরতে। ডট রাত নটায় মা ফোন করবেই।
- কীরে কত দূরে।
- উফফ আশ্চর্য্য। চাকরি ছেড়ে কী ঘরে বসে থাকবো নাকি বলোতো ! আসছি আসছি।
বলে মুখের উপর ফোনটা ফট্যাং করে কেটেই দিলাম আমি।
পরে বাড়ি ঢুকে দেখলাম হয়তো মায়ের একটা দুটো ওসুধ শেষ হয়ে গেছে সেটাও বলার
ছিলো। মুখের ওপর ফোন কেটে দেওয়ার চোটে মা আর ফোন করতে সাহস পায়নি।
কিন্তু সেই কথাটা ঢেকে দেওয়ার জন্য উল্টে মাকে বলে দিলাম "ফোন না করে
সকালে বেরোনোর সময় বলে দিতে পারো না নাকি। ঠিক আছে, কাল এনে দেবো"
কিন্তু এটা বুঝলাম না, যে ওষুধটা একেবারেই শেষ। ওটা না খেলে অনেকটা গ্যাপ
পরে যাবে। আর মায়ের ঘুম হবে না। আর শরীর খারাপ বাড়বে। যেটা মা আমাকে
কখনোই মুখ ফুটে বলবে না। আসলে সারাদিন বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। কখন
আমার মুখটা দেখবে।
যদিও কাল সকাল থেকে পঞ্চাশ বার ওষুধের কথা মনে করাবে।
অথচ কখনও ভেবে দেখা হয়নি ছোটবেলায় মায়ের খুব শরীর খারাপ স্বত্তেও ভোরবেলা
মা রান্নাঘরে। আমার ঘুম ভাঙা আদুরে ডাকে মা এসে মুখ মুছিয়ে দিত। বলতো "ওঠ
বাবা, স্কুল আছে না আজ"।
যদিও আমার কপালে এরকম দিন খুব কমই জুটেছে। আশ্রমে থাকার সুবাদে এই
রসাস্বাদন থেকে আমি বেশ ভালো মাত্রায় বঞ্চিত।
বাথরুম অব্দি মা কোলে করে নিয়ে যেত।
সেই ঘোর শরীর খারাপ নিয়েও কখনো স্কুল জীবনে, কখন চাকরি জীবনে আজও মায়ের
সিলেবাস না পাল্টানো একটাই উত্তর,
- না না কই, আমি তো ভালো আছি, এই তো এইবার কাপড়টা শুকোতে দিয়েই একটু
বসবো, তুই সময় মতো খেয়ে নিস কিন্তু, কেমন।
মিথ্যা কথায় মায়েদের জুড়ি মেলা ভার। সকাল থেকে পরিপাটি করে সমস্তটাই রেডি
করে ফেলেছে। আজ মায়ের হাত পায়ের যন্ত্রনা, ভয়ঙ্কর বাতের প্রবলেম
ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয়নি। শুধু কী তাই। কথায় কথায় "হ্যাঁ খেয়েছি, হ্যাঁ
ঘুমিয়েছি" আরও না জানি কত মিথ্যা "হ্যাঁ" শুনেছো সবাই।
এভাবেই নিত্যদিনের কথোপকথন আর আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনা মায়েরা আসতে আসতে
সমাজে অপাংক্তেয় হয়ে ওঠে। সারাক্ষন বাড়িতে একা একা থাকতে হয় বহু মায়েদের।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপায় না থাকলেও তাঁদের দিকে একটুখানি তাকিয়ে দেখার
সময়টাও আমাদের আজ নেই। আমরা এতটাই ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম আজ। নাকি মায়েদের
সঙ্গে, মায়েদের সেকেলে মানসিকতার সঙ্গে আজ আর মেলে না আমাদের। তবে এটাও
কিন্তু ঠিক, তাইই যদি হবে তাহলে আমাদের ও সেকেলে হয়ে যেতে আর বেশিদিন
বাকি নেই কিন্তু।
না মা, শুধু আজ নয়। জীবনের প্রত্যেক দিন তোমার। আজ একটু বিশেষ ভাবে মনে
করতে চাইলাম তাই হাবিজাবি একটু লিখলাম। ভালো থেকো মা। সব মায়েদের ভালো
থাকার জন্য আমার অন্তরের শুভ কামনা রইলো। ধনীর মা, গরিবের মা, স্নেহময়ী
মা, ঘরের মা, বৃদ্ধাশ্রমের মা- ভালো থেকো মা।
"সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা"
লাভ ইউ মা