মেয়েটা

অনিন্দিতা গুড়িয়া,

নিউ-দিল্লি

-বিইয়েছো তো একটা কালো কুচ্ছিত মেয়ে, তার আবার অন্নপ্রাশন! ভুলে যাও ওসব, ওর যদি দুধে পেট না ভরে তবে ঘরে তো ভাত মুড়ির অভাব নেই খাইয়ে দিলেই পারো ।
বাইরে থেকে ন-জেঠীর গলা পাওয়া গেল।
-ওকি নারান কি সব বলছিস তুই ? বৌমা তো ঠিকই বলেছে। দেখতে দেখতে মেয়ে তো ছয় পেরিয়ে সাত মাসে পড়ল তার অন্নপ্রাশন করাতে হবে না ?
-কি যে বলো ন-জেঠী; এই মেয়ের জন্য এই মাগনির বাজারে ভূত ভোজন করাতে বলছো?
-ছিঃ নারান; হলেও বা মেয়ে ভুলে যাস না ও তোর প্রথম সন্তান।
এইবার ঝংকার দিয়ে উঠলো ছোট বউ নারানের মা। যে তিন তিনটি পুত্র সন্তান হারান নারান আর পুরানের জন্ম দেবার গর্বে গরবিনী।
-বলি তোমার এত দরদ কেনো ন-দি? এই আবাগীর বেটি নারানের বউটা হারান পুরাণের বউদের মত দুটো করে না হোক অন্তত একটা ছেলেরও তো জন্ম দিতে পারতো? এত বছর যখন ছেলেপিলে হলো না তখন না হয় বাঁজ হয়েই থাকতো, তা নয়। একটা কালো কুচ্ছিত মেয়ে মানুষের জন্ম দিয়েছে, আবার সাধ করে নাম রেখেছে কৃষ্ণাঙ্গি। বলিহারি বটে.....

কৃষ্ণাঙ্গির জন্ম এবং অন্নপ্রাশন নিয়ে যত কলহই হোক না কেন শেষ পর্যন্ত কেমন করে না জানি মেয়েটার অন্নপ্রাশন হয়েছিল, জ্ঞাতি কুটুম্বুরাও এসেছিল, পাতপেড়ে খাবার ও খেয়েছিল কিন্তু সেই পর্যন্তই।
এরপর কত বছর পেরিয়ে গেল ,পেরিয়ে গেল কত জন্মদিন। কোন উৎসব হলো না। কেউ একটা শুভেচ্ছা ও জানালো না । শুধু মা পায়েস রেঁধে খাইয়েছে আর সবার চোখের আড়ালে মাথায় ধান দুর্ব দিয়ে আশীর্বাদ করেছে
-অনেক বড় হও, তোমার স্বপ্ন পূরণ করে সবার মুখ উজ্জ্বল কর।

এই মা আর মেয়ে কখন খায় কখন ঘুমায় কেউ তাদের খবরও রাখে না । সবাই খেয়ে উঠে গেলে মা-মেয়েতে রান্নাঘরে বসে খাবার খায়। বাবা নারাণ চন্দ্র ঘুমলে তবেই ঘরে শুতে যায় আবার বাবার ঘুম ভাঙার আগেই উঠে চলে যায় পড়ার ঘরে। কত অসহ্য গরমে ভয়ঙ্কর বর্ষায় কিম্বা ভীষণ শীতের রাতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে পড়ার ঘরের টেবিলে মাথা রেখে। বাবা নারাণ চন্দ্রের বই পড়ার শখ । তাই কত রাতে বেচারি বার বার দরজার আড়াল থেকে ফিরে গেছে।
ঠাকুমার ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে দেখেছে বাবলু ডাবলু বুবুন তুতুনদের খেলা। ওরাও তো তারই আপন খুড়তুতো ভাই তবুও এত বিভেদ! ঠাকুমা পান ছেঁচে ওদের হাতে দিয়ে নিজেও মুখে পুরে আয়েশ করে চোখ বন্ধ করে চিবোয়। কি সুন্দর গন্ধ আসে মৌরি এলাচ আর পানির মিলিত সুগন্ধ। মেয়েটা একদিন ঠাকুমার ফেলে দেওয়া পান মুখে দিয়ে অনুভব করেছিল সেই নৈসর্গিক আঘ্রাণ আর স্বাদ যা সে দেখেছে ঠাকুমা বাবলু ডাবলু আর বুবুন তুতুনদের চোখে মুখে।
বাড়িতে এত লোকের মাঝখানে তারা দুই মা মেয়ে যেন বড় বেমানান। তারা থাকে লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মত। মেয়েটার জন্ম দেবার পর নারানের বউ আর কোন বাচ্চার জন্ম দিতে পারেনি তাই তো সে এই সংসারে এত হেয় অপাংতেও । দাসী চাকরের মতন খাটে সংসারের জন্য। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সবাই ঘুমলে মা মেয়েতে যায় ছাদে, নির্জনে দুজনে কি যে পরামর্শ করে তা একমাত্র তারাই জানে।
বাবলু ডাবলু বুবুন তুতুন মাধ্যমিকের গণ্ডি টাও পেরোতে পারলো না । এখন তারা পৈতৃক চাল ডালের আড়তে বসে আর প্রায় প্রতিদিনই নেশা করে বাড়ি ফেরে। এ নিয়ে কেউ কিছুই বলে না । যেন এটাই হবার ছিল ।
একে একে কেটে যায় একুশ টা বসন্ত । অবশেষে এলো সেই দিন সত্য হলো মায়ের আশীর্বাদ, সত্য হলো মেয়ের স্বপ্ন, সত্য হলো অন্নপ্রাশনে পৌরহিত্য করতে আসা গুরুসদয় চক্রবর্তীর কথা। সেই দিন চক্কোত্তী ঠাকুর সবাইকে ডেকে বলেছিলেন
-এই মেয়ে বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।
এই কথা শুনে ঠাকুমা মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল
- কবে কোন কালে কোন মেয়ে বংশদ্ধার করে শুনি? আমার চার চারটে নাতি আছে তারাই আমার চারটে শক্ত লাঠি, তারাই আমার বংশদ্ধার করবে।
কিন্তু সেই চার নাতি এই পাঁচ বছরে নেশা করে আর নিজেদের মধ্যে লড়াই করে করে পৈত্রিক ব্যবসার প্রায় আশি ভাগ নষ্ট করেছে, বাকি কুড়িভাগ নিজেদের মধ্যে ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছে। এমনকি ঠাকুমার ঘরের দখল নিতে ঠাকুমাকেও তার ঘর থেকে পালং শুদ্ধ ঠাঁই করেছে রান্না ঘরের দাওয়ায়।
আর এই মেয়ে সবার অলক্ষে প্রতিবছর স্কলারশিপ নিয়ে পাশ করে করে আজ সে লাল বাতি লাগানো সরকারি গাড়ি চড়ে আর্মস গার্ড সাথে নিয়ে এবং অনেক মিষ্টি নিয়ে মায়ের সাথে ঠাকুমাকে প্রণাম করে দাঁড়ালো । আজ সে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কৃষ্ণাঙ্গী মৈত্র। মায়ের চোখে জল মুখে জয়ের হাসি। আর বাড়ির বাকি সবাই ঝরঝর করে কাঁদছে ,কে জানে খুশির নাকি অনুতাপের কান্না!
শুধু ন জেঠী ছুটে ঠাকুর ঘর থেকে শাঁখ এনে পোঁ পোঁ করে বাজাতে লাগলো। যেটা তার জন্ম ক্ষনেও বাজে নি, মেয়ে বলে। ।