মূল্যবোধ: দুই ভাই
প্রত্যুষ কুমার(ঝোড়ো হাওয়া),
হাওড়া
রোববারের সকালে ছুটির দিনে দৈনন্দিন জীবনের ব্যস্ততাকে দূরে সরিয়ে, দুই
ভাই মূল্যায়ন ও বোধায়ন খোশ মেজাজে বেশ ভালোই রেওয়াজ চালাচ্ছে।
মূল্যায়ন অর্থাৎ মূল্য বাজাচ্ছে তবলা আর হারমোনিয়ামে গলা মেলাচ্ছে
বোধায়ন অর্থাৎ বোধ। বোধ গাইছে সেই বিখ্যাত কালজয়ী গান "তারে বলে দিও"।
গা মা পা ধরার আগেই মূল্য তবলা বাজানোর সময় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
এমতাবস্থায় বোধেরও গান থেমে যায় এবং মূল্যকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা
করে।
বোধ জিজ্ঞাসা করে,"ভাই, গান থামিয়ে দিলি?"
এমন প্রশ্ন শুনে মূল্য খানিক চমকে যায়।
উত্তর না পেয়ে বোধ আবার জিজ্ঞেস করে,"কি রে বল!"
মূল্য একটু শান্ত হয়ে উত্তর দেয়,"দাদাই আমি পারবো তো? আমার জন্যে সব
ঝুলে যাবে না তো?!"
বোধ পাল্টা জিজ্ঞাসা করে,"পারবি নাই বা কেন?"
মূল্য উত্তর দেয়,"কি জানি দাদাই! শুধু জানিস তো ভয় হয়। এই বোধহয় সব
ঠিক করেও ভুল করে ফেললাম।"
বোধ বলে,"এগুলোর কারণ কী জানিস? তুই ভিতর থেকে দুর্বল তাই এসব
ভাবছিস।"
মূল্য উত্তর দেয়,"না দাদাই তা নয়। হয়তো আমিই কোনো প্রতিযোগিতার যোগ্য
নই।"
বোধ প্রশ্ন করে,"তোকে এই কথাগুলো কে বলেছে?"
মূল্য উত্তর দেয়,"কই কেউ তো বলেনি। তুই গান ধর। চল আবার শুরু করি।"
বোধ বলে,"দাঁড়া। একটুও বায়াতে হাত ঠেকাবিনা। উমম্, ডায়াতেও না। আগে
আমার প্রশ্নের উত্তর দিবি। তারপর গান শুরু হবে।"
মূল্য বলে,"দাদাই আমার কথাটা শোন।"
বোধ উত্তর দেয়," না। কোনো কথা বলবে না তুমি। শোনো, ফাঁকি তুমি কাকে
দিচ্ছো জানো? নিজেকে। সারা সপ্তাহের অফিসের পর, এই ছুটির দিন দেখে একটু
গানবাজনা নিয়ে বসি। পারতাম না আমি, ছুটির দিনে অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত
থাকতে? তোর প্রতিযোগিতার কথা ভেবে আজ আমি এতটা সিরিয়াস। আর শুধু আমি
কেন? মা-বাবা, আম্মা-কাম্মা, জেম্মু, দাদুজান এবং বাড়ির সবাই শুধু তোকে
নিয়ে চিন্তিত। তারাও চায় তুই ভাল করে মন দিয়ে গান টা কর। আমি জানি,
তুই তবলা খুব ভালো বাজাস। যার গলায় সুর-তাল রয়েছে। সে গান করবে না কেন?
ওরে বুদ্ধু গান মনকে ভালো রাখে। এই কথা কি তুই বুঝিস না?
মূল্য একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়,"সব বুঝি। কিন্তু তুই কি এটা জানিস?
যারা তবলা বাজায় তারা কখনো গান গায়না। আর আমার গলা তো তোর মতো কিংবা
অন্য শিল্পীদের মতো সুন্দর নয়। তাই আমি তবলা বাজালেও গান গাইতে পারব
না।"
বোধ মুচকি হাসে এবং রাগতস্বরে জিজ্ঞাসা করে,"এই কথা তোকে কে বলেছে? কি
হলো বল কে বলেছে? শোনো, পৃথিবীতে তুমি সকলকে ফাঁকি দিতে পারো। কিন্তু,
চোখ আর নিজের জীবনকে কখনো ফাঁকি দিতে পারবে না। এবার, সত্যি করে বল তো!
কে এসব মাথায় ঢোকাচ্ছে? রাহুল, নন্দিনী, বংশী ওরা কী কিছু বলেছে?"
মূল্য থতমত খেয়ে জিজ্ঞাসা করে," তুই কি করে জানলি?"
বোধ উত্তর দেয়,"হুঁম। আমি কি করে জানলাম? এটাই তোর প্রশ্ন তো! তোর চোখ
দেখে। চোখই উত্তর দিয়ে দিলো। আর বুঝিয়েও দিলো তুই কোনো একটা ব্যাপারে
দ্বন্দ্বে আছিস। ভয় নেই তোর যদি মনে হয়। দাদাই কে বললে সমস্যা বাড়বে।
তাহলে বলিস না।"
মূল্য পুরোনো কিছু কথা স্মৃতিচারণ করে বোধের কাছে ক্ষমা চায় এবং তার দোষ
স্বীকার করে জানায় তার ভুল হয়েছে।
প্রত্যুত্তরে বোধ জানায়,"ভুলটা তুমি এখন করো নি। অনেকদিন ধরে করে এসেছো।
এটাই তোমার ভুল যে, তুমি সব কথা আড়ালে রেখেছো। আমাদের পরিবারে তো কোনো
কথা গোপন রাখার প্রচলন নেই। তাহলে এই কথাই বা গোপন থাকবে কেন? এমনকি, যখন
তুই বলেছিলি তোর একটা মেয়েকে পছন্দ যার নাম সঙ্গীতা। আমরা কেউ তো তাতে
আপত্তি করিনি। আমিও তো আমার পছন্দের মেয়ে সুরাঞ্জলি মানে তোর বৌদিমাকে
বিয়ে করেছি। আর সেও তো গানবাজনা পছন্দ করে। আমি তো জীবনে কোনো কথা আড়াল
করিনি। তাহলে তুই ই বা আড়াল করবি কেন? জানিস, মা কি বলে? কখনও নিজেকে
দুর্বল ভাববি না। লড়াই করে যাবি, দেখবি তুই একদিন সফল হবি। সাফল্য আসে
শ্রম থেকে, শ্রম ঝরাতে হয় কর্ম করে। বাবা ঐ জন্যই বলে ময়দান কখনও
ছাড়বি না। তোর জমি, তোকে নিজেকেই ধরে রাখতে হবে। মাটি আঁকড়ে পড়ে
থাকবি, শিরদাঁড়া শক্ত করে। কখনও কারুর মন পড়েছিস? জানি, পড়িস নি।
মায়ের মন টা কেমন জানিস? মায়ের মনটা ঠিক পেঁজা তুলোর মতো। আর বাবার
মনটা ঠিক নারকেলের মতো। বাইরে টা শক্ত, ভিতর টা নরম। তোর বৌদিমা মানে
সুরার মন টা আবার অন্যরকম। ঠিক হারমোনিয়ামের মতো। ঐ জন্যই হয়তো ওর সাথে
আমার মিলে যায়। কারণ আমিও তো গীটারের তারের মতো। পরিস্থিতি অনুযায়ী
বাজতে থাকি। যাই হোক ওসব কথা বাদ দে। প্রসঙ্গ ক্রমশ অন্যদিকে মোড়
নিচ্ছে। পারলে? সব গুছিয়ে তুলে দিস। আমি দেখি, ওদিকে আবার অনেক কাজ পড়ে
আছে।"
মূল্য যেতে বাধা দেয় এবং সে জানায়,"দাড়া দাদাই। আমি সত্যিই লজ্জিত।
অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে আমার। আসলে আমিই ভুল। আমার কোনো কথা চেপে রাখা
উচিত হয়নি। আমি সব বলছি তোকে। প্লিজ আর রাগ করিসনা।"
বোধ উত্তর দেয়,"আচ্ছা ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি বল আমার অনেক কাজ পড়ে
আছে।"
মূল্য বলে," হ্যাঁ বলছি, সব বলছি। সেদিন কলেজের অফ পিরিয়ডে সকলের
অনুরোধে একটা গান শুনিয়েছিলাম। ভাবলাম লোকগীতি গাইলেই ভালো। খাঁচার ভিতর
অচিন পাখি, কেমনে আসে যায়। আমার গান শেষ হল। দু-একজন প্রশংসা করলেও
বাকিরা সবাই ব্যঙ্গ করল।"
বোধ পাল্টা প্রশ্ন করে মূল্যকে,"আর তুই কী বললি?"
মূল্য উত্তর দেয়,"কিছু না। শুধু বললাম আমি তো তবলা বাজাই। তোরা অনুরোধ
করলি তাই গাইলাম। ওরা তৎক্ষণাত বলে উঠল ভাই তুই তবলা বাজা। আর হ্যাঁ যারা
তবলা বাজায় তারা গান গাইতে পারে না। পারলে ইউকেলেলে চেষ্টা করিস। ওটায়
গান ভালো হয়। আর একটু হিন্দি গানেরও চেষ্টা করিস। তখনই মনে হলো এক
মূহুর্তের জন্য, আমার গান গাওয়া নিরাপদ নয়।"
বোধ একটু হেসে আবেগের স্বরে বোঝায়,"দেখ ভাই। পৃথিবীতে সবাই সব কিছু শিখে
আসে না। দেখতে দেখতে আর চলার পথে যখন হোঁচট খায়। তখন সে সব শিখে যায়।
তোর বৌদিমা কি বলে জানিস? নিজের ওপর ভরসা রেখে চলো। দেখবে চলার পথ অচিরেই
মসৃণ হয়ে গেছে। আর শোন্ গান গাইতে গেলে অবশ্যই সব গান জানা দরকার। তবে
কী জানিস তো! পরিস্থিতি অনুযায়ী গান নির্বাচন করা উচিত। তুমি কোন
পরিবেশে রয়েছো? তার ওপর নির্ভর করে গান গাওয়া উচিত। আর বাংলা গান
অবশ্যই গাইবি। মায়ের ভাষার গান কেন গাইবি না তুই? কিন্তু পাশাপাশি অন্য
গানও যে শিখতে হবে ভাই। মাটির গানের পাশাপাশি অন্যান্য গানও চর্চা করতে।
আর তার জন্য অনেক শুনতে হবে। কারণ গানের আগে কান আসে। আর তোকে তো শুধু
বলেছে তুই তবলা বাজা। আমি যখন শুরু করি। তখন আমাকে অনেক কিছুই হজম করতে
হয়েছে। একদিন এমনও শুনতে হয়েছিল এক পরিচিত মহলে, তুমি গান গাওয়াটাই
ছেড়ে দাও। তাও দেখ, চাকরী করা সত্ত্বেও যতটুকু সময় পাই। হয় পিয়ানো,
নয় গীটার নিয়ে বসে পড়ি নতুবা কিছু না কিছু যন্ত্র আমার লাগবেই। আসলে
সাধনা যে কখনো শেষ হয়না। জানিস দাদুজান কি বলেন? ঈশ্বরকে পেতে গেলে যেমন
অনেক তপস্যা করতে হয়। তেমন সঙ্গীতের প্রকৃত মূল্যবোধ বুঝতে গেলেও কঠোর
তপস্যার প্রয়োজন। আর দরকার সঠিক অধ্যাবসায়। সঙ্গীত অত সহজ বিষয় নয়।
আর আমাকে কেউ ব্যঙ্গ করলে কি বলি জানিস?"
মূল্য জিজ্ঞাসা করে,"কি?"
বোধ উত্তর দেয়,"আজ যারা হেসেছে, কাল তারা ফেঁসেছে।"
বোধ-মূল্য একে অপরের দিকে চেয়ে হাসাহাসি শুরু করে।
বোধ আবার বলে,"আর যে বলেছে তোকে তবলা বাজালে গান গাওয়া যায় না। এ কথাটা
সম্পূর্ণ মিথ্যা। মানুষ চাইলেই সব করতে পারে। শুধু মনে সেই বিশ্বাস টা
রাখা চাই। আর যেকোনো বাদ্য নিজের হস্ত দ্বারা চালনা করাও অনেক ধৈর্য্য
এবং পরিশ্রমের কাজ। এটা তো কোনো অপরাধ নয় বরং সম্মানের কাজ। শিল্পীরা
চাইলে সব করতে পারে।"
মূল্য প্রশ্ন করে,"আমি শিল্পী?"
বোধ উত্তর দেয়,"হুঁম। শিল্পকে যারা ভালোবাসে, তারাই শিল্পী। শিল্প জগতে
বয়সের কোনো মাপকাঠি নির্ণয় করা হয় না। তুমি চাইলেই যেকোনো বয়স থেকে
শুরু করতে পারো। আর শিল্পী একমাত্র শুধু শিল্পেরই বন্ধু হতে পারে।"
কথাগুলো শোনামাত্রই মূল্যর মনে শিহরণ জেগে ওঠে।
মূল্য বলে,"তুই ঠিকই বলেছিস। আমি সত্যিই বিষয়গুলো এতটা ভেবে খুঁটিয়ে
বিশ্লেষণ করিনি।"
বোধ জানায়,"বিশ্লেষণের সময় আসুক, তখন তুই নিজেই সবটা বুঝতে পারবি। আসলে
কি জানিস তো? অনেক জেনেও সেই অজানা থেকেই যায়। তুই যে পথ দিয়ে হাঁটা
শুরু করবি। দেখবি, তার বাইরেও আরও অনেক পথ খোলা আছে। কোনটা সহজ, কোনটা
জটিল? সেটা তোকে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। একটা সময় ছিল যারা স্টেজে গান
গাইতেন। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি হারমোনিয়াম, তবলা সঙ্গদে
থাকতই। অনুষ্ঠানগুলোও খুব আবেগপ্রবণ হতো। ছেলেরা পড়ত ফতুয়া কিংবা শার্ট
আর তার সাথে ধূতি। মেয়েরা পড়ত স্পষ্ট পাটে সুন্দর শাড়ি। এখনও অনুষ্ঠান
হয়। কিন্তু সেই আবেগ টা যেন হাতে গোনা কয়েকজনের মধ্যেই খুঁজে পাই। এই
দেখ না, সামনে আমারও প্রোগ্রাম আছে। কিন্তু সবাই আগে নিজস্বী তোলার জন্য
মুখিয়ে থাকবে। কেউ অটোগ্রাফ চাইবেই না। আর যারাও বা চাইবে সেটাও খুব কম
সংখ্যক মানুষ। তাই যুগের সাথে যে তাল মিলিয়ে চলতেই হবে ভাই। আধুনিকতাকে
যেমন গ্রহণ করতে হবে। তেমন পুরাতনকে ভুলে গেলে চলবে না। তাই ইউকেলেলে
যেমন থাকবে পাশাপাশি তবলার বোলও থাকবে। আর আপনার প্র্যাকটিসও থাকবে। এবার
চলুন দয়া করে।"
মূল্য জিজ্ঞাসা করে,"এই যে বললি, তোর কাজ আছে।"
বোধ উত্তর দেয়,"সে তো আছেই। তবে একটা কথা সবসময় মাথায় রাখবি।
প্রতিযোগিতাকে কখনও যুদ্ধ নয়, ভালোবাসা মনে করবি। একটা ভালোবাসা জিততে
গেলেও অনেক খাটতে হয়। আর গানবাজনাও তো একপ্রকার ভালোবাসা। আর এই শিল্প
জগতে পরম মিত্র খুব কম সংখ্যকই হয়। যাই হোক, ভাই আমার। এবার কথা টা
থামিয়ে আবার রেওয়াজ শুরু করি।"
কথামতো আবার রেওয়াজে বসে মূল্য এবং বোধ।
মূল্য বলে," দাদাই গানটা ধরো"।
বোধ গান টা পুনরায় শুরু করে,"তারে বলে দিও, সে যেন আসে না, আমার
দ্বারে।"
মূল্য জিজ্ঞাসা করে," একি দাদাই! শুরু থেকে ধরলে?"
বোধ উত্তর দেয়,"কোনো জিনিস অধরা রাখতে নেই। শুরু থেকে করা ভালো বুঝলি!
নে শুরু কর, শুরু কর। আর শোন্ আমার হয়ে গেলে, তুই বাজিয়ে গাইবি। আর
তবলাটা আমায় দিবি। নে বাজা এবার।"
আবার তবলা বাজানো শুরু করে মূল্য। এবং গান ধরে বোধ।
বোধ গায়,
"তারে বলে দিও
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও
ওই গুন গুন সুরে মন হাসে না
ওই গুন গুন সুরে মন হাসে না
তারে বলে দিও
সে যেন আসে না আমার দ্বারে
তারে বলে দিও
গা মা পা
মা গা রে"
গানের মাঝে আবার তবলা থামায় মূল্য। তবে এবার অন্যমনস্ক হয়ে নয়। গান
অনুযায়ী সে থামিয়ে দেয়।
বোধ বলে," কি ভায়া, থামলে কেন? বাজাও।"
পুনরায় তবলা বাজাতে শুরু করে মূল্য এবং বোধও বাকি অংশ গাইতে শুরু করে।
ব্যস, এভাবেই চলতে থাকে দুজনের সঙ্গীত চর্চা।
[[লেখনীর প্রায়শই চরিত্র সম্পূর্ণভাবেই কাল্পনিক। বাস্তবের সহিত যদি
মিলে যায় তা নিছকই অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। কখনও নিজেকে দুর্বল ভাববেন
না। আপনার মধ্যেও লুকিয়ে আছে ভালো একটা আমি। পারলে সেটাকে প্রকাশ
করুন।]]
~ শুভম(মধুরেণ সমাপয়েৎ) ~