পরিধি

অমৃতা ব্যানার্জী ,

কলকাতা

'থ্যাংক ইউ ম্যাডাম, এখনও পর্যন্ত মোট তিনবার আপনি আমাকে উদ্ধার করেছেন।' বাক্য সম্পূর্ণ করে মুখোমুখি বসে থাকা জাহ্নবীর দিকে মেরুন রঙের ছাতাটা এগিয়ে দেন তমালবাবু।

ছাতাটা পাশে রেখে কফি কাপের হ্যান্ডেলটা দুই আঙ্গুলের ফাঁকে ধরে স্মিত হেসে জাহ্নবী বলেন, 'ওরে বাবা! উদ্ধার করার মত কোন কাজ করিনি আমি।' জাহ্নবীর হাসি ভারি কমনীয়। হাসার সময় ঠোঁট দুটো সামান্য ফাঁক হয়, দাঁতের ঝলক দেখা যায় মাত্র। হাসির মাধ্যমে জগতের সম্মুখে নিজেকে উজাড় করেন না জাহ্নবী, তবুও ছড়িয়ে পড়ে দ্যুতি।

তমালবাবু কি তাঁর হাসি দেখে স্তব্ধ হলেন? ঠিক বুঝতে পারলেন না জাহ্নবী।

কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে তমালবাবু বললেন, 'উদ্ধার তো অবশ্যই। আমার ঠাণ্ডার ধাত। কিন্তু ব্যাগে ছাতা ঢোকাতে আখছার ভুলে যাই। আপনি যদি ছাতা ধার না দিতেন তাহলে একদম কাকভেজা হয়ে বাড়ি যেতাম। ঠাণ্ডা লাগত কিনা জানি না, কিন্তু মেয়ের বকুনির হাত থেকে বেঁচেছি। অবশ্য পুরো বেঁচেছি বলব না, শার্টটা কিছুটা ভেজা থাকায় ধমক শুনতে হয়েছে।'

—- 'মেয়েকে ভয় পান বুঝি?'

—- 'তা আর বলতে! আমাকে শাসন করার মত একজনই তো আছে।'

—- 'বকুনির থেকে বাঁচার একটা সহজ উপায় আমার জানা আছে।'

—- 'কী বলুন তো?'

—- 'বৃষ্টির সময় একটা ক্যাব বুক করে নিলেই ঝামেলা চুকে যায়।'

—- 'মেয়েও আমাকে ঠিক এই কথাটাই বলে। কিন্তু রাজা-উজিরদের মত গাড়িতে যাতায়াত করা আমার পোষায় না।'

—- 'প্রয়োজনে আমিও ক্যাব ব্যবহার করি, বহু মানুষই করেন। আমার তো নিজেকে রাজা মনে হয় না। যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ক্ষতি কী?'

'যাইহোক, আজ কিন্তু মনে করে ছাতা এনেছি।' ব্যাগের বাইরে বেরিয়ে থাকা ছাতার হ্যান্ডেলটার দিকে ইশারা করেন তমালবাবু।

—- 'দেখলাম। কিন্তু আজ যে আপনাকে রাজা হতেই হবে। বৃষ্টি এখনো পুরোপুরি থামেনি, উপরন্তু যাদবপুরের বাস নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছে বোধহয়, মোবাইলে নোটিফিকেশন ঢুকেছে।'

—- 'তাই মনে হচ্ছে। তবে আবারও আপনার সাহায্য চাই। আমার ফোনে ক্যাব বুকিংয়ের অ্যাপ নেই। আপনি আমার হয়ে একটা ক্যাব বুক করে দিন প্লিজ। পেমেন্ট মোড ক্যাশ দেবেন।'

—- 'বেশ।'
******************

বাড়ি ফিরতে জাহ্নবীর রাত সাড়ে ন'টা বেজে গেল। অ্যাপ অন করে দেখলেন, তমালবাবু এখনও পৌঁছননি। এত রাতে আর রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রেশ হয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে জানালার কাছে চেয়ার টেনে বসলেন তিনি। আজ সন্ধ্যায় বাচ্চাদের পড়াবেন না, মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সব সময়ের কাজের মেয়েটা দু'দিনের জন্য ছুটি নিয়ে বাড়ি গেছে। কেষ্টপুরে একটা ওয়ান বিএইচকে-তে থাকেন জাহ্নবী। গোটা ফ্ল্যাটে এখন তিনি একা, তবুও ভাল লাগছে, বেশ ভাল লাগছে।

বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে। পাতলা মেঘের আড়াল থেকে একফালি চাঁদ আর কয়েকটা তারা উঁকি দিচ্ছে। এখন প্রকৃতি বড় শুদ্ধ। জাহ্নবীরও ভীষণ হালকা লাগছে। বহু দিন পরে, না, বহু বছর পরে এত সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটালেন তিনি। শেষ কবে ক্যাফেতে বসে গল্প করেছেন মনে পড়ে না। স্টুডেন্ট লাইফে বন্ধুদের সঙ্গে আখছার এ'দিক-সে'দিক আড্ডা দিতে যেতেন। স্বপ্নদীপের সঙ্গেও গেছেন বহুবার। তবে তমালবাবুর মত অপরিচিতর সঙ্গে এই প্রথম এতোটা সময় কাটালেন।

তমালবাবুকে এখনও ঠিক পরিচিত বলা যায় না। জাহ্নবীর সঙ্গে অদ্ভুতভাবে তাঁর আলাপ হয়েছিল। আলাপের মাধ্যম একটি ছাতা।

সল্টলেক সেক্টর ফাইভে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ইলেকট্রনিক্সের প্রফেসর জাহ্নবী। রোজের মত দু'সপ্তাহ আগে ছুটির পরে কলেজ মোড় স্টপে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। সাধারণত বাসেই যাতায়াত করেন তিনি। তবে সেইদিন আকাশে কালো মেঘ দেখে সিদ্ধান্ত বদলে ক্যাব বুক করেছিলেন। আকাশে তখন ঘন কালো মেঘ। ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। পথের ধুলো, শুকনো পাতা উড়ে চোখেমুখে পড়ছিল। ক্যাব আসা মাত্রই শুরু হয়েছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। তাড়াতাড়ি ক্যাবে উঠেছিলেন জাহ্নবী, তবে কিছুক্ষণ এগোতে পারেননি। জ্যামে আটকে গিয়েছিল ক্যাব।

থেমে থাকা গাড়ির জানালা দিয়ে তমালবাবুকে প্রথমবার পর্যবেক্ষণ করেছিলেন জাহ্নবী। ভদ্রলোককে আগেও দেখেছেন বাস স্টপে, নিত্য যাত্রী হিসেবে, তবে বিশেষ খেয়াল করেননি। সেদিন ঝড়বৃষ্টির সময় কেউ ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, কেউবা ছুটে ভিড় বাসে উঠেছিলেন। শুধু তমালবাবু অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিলেন, যেন হঠাৎ বৃষ্টি নামায় থতমত খেয়ে গেছেন। অসহায় মানুষটার দিকে তাকিয়েছিলেন জাহ্নবী। মানুষটির চেহারায় কোন বিশেষত্ব নেই, তবুও তাঁর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছিলেন জাহ্নবী। মানুষটির অসহায়ত্ব দেখে তাঁর মনটাও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। ক্যাবের জানালা দিয়ে নিজের ছাতাটা বের করে জাহ্নবী বলেছিলেন, 'শুনছেন, আপনি ছাতাটা রাখুন।'

তমালবাবু অবাক হয়ে বলেছিলেন, 'ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি তো আপনাকে চিনি না। তাহলে…'

'আমিও আপনাকে চিনি না। ছাতাটা রাখুন, বৃষ্টির তোড় বাড়বে মনে হচ্ছে। আগামীকাল ফেরত দিয়ে দেবেন। আমি রোজ এই বাস স্টপেই আসি।'

ছাতাটা নিয়ে 'ধন্যবাদ' বলেছিলেন তমালবাবু। তখনও অবশ্য তাঁরা পরস্পরের নাম জানতেন না। পরিচয় পর্ব শুরু হওয়ার আগেই ক্যাব দ্রুত গতিতে রওনা হয়েছিল।

পরেরদিন বিকেলে কলেজ মোড় বাস স্টপে আবার দু'জনের দেখা হয়েছিল। ছাতা ফেরত দেওয়ার সময় তমালবাবু বলেছিলেন, 'অশেষ ধন্যবাদ। তবে আমাকে সাহায্য করার কারণ বুঝতে পারিনি।'

চোখে চোখ রেখে জাহ্নবী বলেছিলেন, 'মানবিকতা‌।'

পরিচয় পর্ব সম্পূর্ণ হয়েছিল। জাহ্নবী জেনেছিলেন তমালবাবু সেক্টর ফাইভে একটি সরকারি অফিসের বিজ্ঞান বিভাগে কাজ করেন।

তিনদিন পরে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছিল। ক্যাবে ওঠার সময় ছাতাটা তমালবাবুকে দিয়েছিলেন জাহ্নবী। প্রথমদিনের মত আশ্চর্য হননি তমালবাবু, তবে একটু ইতস্তত করেছিলেন। তৃতীয়বার অবশ্য তিনি নিজেই এসেছিলেন, 'আজকেও আপনার ছাতাটা ধার পাওয়া যাবে ম্যাডাম?'

আজ ছাতাটা ফেরত দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল, কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি নামায় দু'জনেই আটকে পড়েছিলেন। বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার জন্যই মূলতঃ ক্যাফেতে ঢুকেছিলেন তাঁরা।

তমালবাবুকে বেশ লেগেছে জাহ্নবীর। ছিমছাম কথাবার্তা, বক্রোক্তিবিহীন। জাহ্নবীর মনে হয়, দিনগত পাপক্ষয়ের মাঝে একটা সন্ধ্যায় অন্তত কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে পারলেন তিনি। এই সন্ধ্যার রেশ রয়ে যাবে অনেকদিন।
******************

পেরিয়ে গেছে দু'মাস। এই দু'মাসে জাহ্নবী ও তমালবাবু আগন্তুক থেকে বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। সেইদিন ক্যাফেতে পরস্পর ফোন নম্বর বিনিময় করেছিলেন। পরেরদিন সকালে একগুচ্ছ ফুলের ছবিসহ 'গুড মর্নিং' জানিয়েছিলেন তমালবাবু। জাহ্নবীকে সাধারণত কেউ এই ধরণের মেসেজ পাঠায় না। তিনি পছন্দ-ও করেন না। কিন্তু তমালবাবুর মেসেজটা দেখে কোন অজ্ঞাত কারণে খুশি হয়েছিলেন। উত্তরে ছোট্ট করে লিখেছিলেন, 'সুপ্রভাত'। প্রত্যুত্তরে তমালবাবু বলেছিলেন, 'যাক নিশ্চিন্ত হলাম। পরিচিতদের সুপ্রভাত জানানো আমার অভ্যাস। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো অসন্তুষ্ট হবেন।'

সেই শুরু হয়েছিল কথা। তারপর থেকে গান, কবিতা, গল্প, সিনেমা, কারেন্ট নিউজ - সব বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনা হয় উভয়ের মধ্যে। বাস স্টপে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে গল্প হয়। দু-তিনবার ক্যাফেতে বসেও গল্প করেছেন দু'জনে। জাহ্নবীর বদ্ধ জীবনে তমালবাবু একমুঠো মুক্ত বাতাস। অবশ্য দু'জনের মধ্যে কোন ব্যক্তিগত আলোচনা হয় না। তমালবাবু তবু মাঝেমধ্যে মেয়ের কথা বলেন। জাহ্নবীর সে কথা বলার কোন সুযোগ নেই।

আজকাল জাহ্নবীর নতুন করে জীবনটাকে সাজাতে ইচ্ছে করে। হোক না বয়স বিয়াল্লিশ, আজকাল তো মানুষ ষাট পেরোনোর পরও নতুন করে বাঁচছে। তমালবাবু কোনদিন ইঙ্গিত দেননি। ওঁর মনে কী আছে, তা জাহ্নবীর অজানা। কিন্তু জানার চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? তিনি নিশ্চয়ই বিনা কারণে এতো গল্প করেন না। ভদ্রলোক বারবার মেয়ের কথা বলেন। বলেন, মেয়ে তাঁর একার হাতে মানুষ; অর্থাৎ তিনি বিপত্নীক অথবা ডিভোর্সী। তবুও তমালবাবুর মেয়েকে নিয়ে জাহ্নবীর মনে সংশয় ছিল। মেয়ে কি মানতে পারবে বাবার দ্বিতীয় সম্পর্ক? অবশ্য তমালবাবু বলেন তাঁর মেয়ে আধুনিকা। কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে একজন মহিলার বিয়ের খবর ভাইরাল হয়েছিল। ছেলে তার বিধবা মায়ের বিয়ে দিয়েছিল। বহুলোক ছেলেটির মানসিকতার প্রশংসা করেছে। তমালবাবু সেই বিয়ের কিছু ফটো দেখিয়ে বলেছিলেন, ছেলেটি তাঁর মেয়ের বন্ধু। ওদের বন্ধু গ্রুপ ভীষণভাবে এই বিয়েকে সমর্থন করেছে। জাহ্নবীর সংশয় অনেকটাই কেটে গেছে এরপর।


******** ফোনটা রাখার পরে বেশ খুশি মনে সোফায় বসলেন জাহ্নবী। আগামীকাল নিজের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তমালবাবু নিমন্ত্রণ করেছেন। উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, 'আগামীকাল আমি হাফ সেঞ্চুরি কমপ্লিট করছি। আপনাকে আসতেই হবে।' উনি নিজে আমন্ত্রণ জানালেন! জাহ্নবীর মনে হয় প্রকৃতি যেন তাঁকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

টেবলের ওপর রাখা ছাতাটা দেখে হাসেন জাহ্নবী। ভাবেন, আবার ছাতার মাধ্যমে তৈরি হতে চলেছে একটি সম্পর্ক।

সতেরো বছর আগের কথা। মাস্টার্স শেষ করে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সদ্য জুনিয়র লেকচারার রূপে জয়েন করেছিল জাহ্নবী ও স্বপ্নদীপ। সেদিন দুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। জলমগ্ন হয়ে গিয়েছিল কলকাতা শহরের বিভিন্ন এলাকা। পথে যানবাহন প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না। জাহ্নবীর একটা ছাতার ভরসায় কলেজ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল দু'জনে, বাড়ির পথে। ছাতার হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরেছিল দু'জনে। হঠাৎ স্বপ্নদীপ জাহ্নবীর গালে এঁকে দিয়েছিল চুম্বন, জীবনের প্রথম চুম্বন। কোন উত্তর দিতে পারেনি জাহ্নবী। সারা রাস্তা ঘোরের মধ্যে হেঁটেছিল সে। পরে স্বপ্নদীপকে জিজ্ঞাসা করেছিল, 'তুই আমাকে ছাতার তলায় প্রপোজ করলি কেন?'

উত্তরে স্বপ্নদীপ বলেছিল, 'এক ছাতার তলায় থাকা মানুষের চেয়ে আপন কেউ হয় না। সমস্ত পরিস্থিতি ভুলে মানুষ এক ছাতার তলায় আসে। ছাতার তলায় কাটানো সময় ভীষণ আপন হয়, ব্যক্তিগত। সেদিন ছাতার তলায় তোকে যতটা আপন করে পেয়েছিলাম, আগে কোনদিন পাইনি।'

বিয়ের পরের কিছু সময় উন্মাদনার মধ্যে কেটে গিয়েছিল। তারপর অবশ্য সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছিল। স্বপ্নদীপ চাকরি ও রিসার্চ নিয়েই বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিত। জাহ্নবীর কিছুটা সময় কাটত চাকরি নিয়ে, বাকিটা স্বপ্নদীপের অপেক্ষায়। ছ'বছর আগে রিসার্চের কাজে আমেরিকা গিয়েছিল স্বপ্নদীপ। তখন থেকে কথা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।

একদিন জাহ্নবী নিজেই কথাটা তুলেছিলেন, 'আমাদের কি আইনিভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত?'

মুহূর্তের মধ্যে উত্তর দিয়েছিল স্বপ্নদীপ, 'আমার তাই মনে হয়।'

কিছুদিনের জন্য দেশে এসেছিল স্বপ্নদীপ। মিউচুয়াল সেপারেশন হয়ে গিয়েছিল।

কেষ্টপুরের ফ্ল্যাটটায় শিফ্ট করেছিলেন জাহ্নবী। এমনিতে কোন অসুবিধা হত না, তবে রাতের দিকে ফাঁকা ফ্ল্যাটে ভীষণ মন খারাপ হত। বুকের ভিতর জমা চাপা কষ্ট কান্না হয়ে বেরোতে চাইত। একাকীত্ব দূর করার জন্যই চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক রেখেছিলেন তিনি। তাছাড়া সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যায় অ্যাপার্টমেন্টের কয়েকটি বাচ্চাকে অংক করান।
******************

রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ির থেকে নামলেন জাহ্নবী। হাতে ধরা একটা ফুলের তোড়া আর একটা বড় চকোলেট বক্স। একটি গার্ডেন রেস্টুরেন্টে পার্টির আয়োজন করেছে তমালবাবু্র মেয়ে।

চারিদিক ভাল করে দেখলেন জাহ্নবী। ছিমছাম, সুন্দর পরিমণ্ডল। বেশি লোকজন দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় নিকট কয়েকজনকে নিয়ে এই আয়োজন। একটি গার্ডেন আমব্রেলার নিচে দাঁড়ানো তমালবাবুকে দেখে এগিয়ে যান জাহ্নবী।

উপহার এগিয়ে দিয়ে বলেন, 'হ্যাপি বার্থডে। ভীষণ ভাল থাকুন। মনের আনন্দে থাকুন।'

সজোরে হেসে তমালবাবু বলেন, 'থ্যাংক ইউ সো মাচ। আপনি এসেছেন দেখে ভীষণ খুশি হলাম।'

তমালবাবুর নিকটজনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরে খুশি জাহ্নবীও।

—- 'আপনার মেয়ে কই?'

পিছন দিকে তাকিয়ে তমালবাবু বললেন, 'ওই যে এসে গেছে।'

গার্ডেন আমব্রেলাটির নিচে এসে দাঁড়ায় এক সদ্য যুবতী। তার হাতে ধরা হুইলচেয়ারে বসে আছেন এক প্রৌঢ়া।

তমালবাবু বললেন, 'আলাপ করিয়ে দিই। এই হল আমার একমাত্র মেয়ে ইন্দিরা।' তারপর প্রৌঢ়ার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, 'ইনি আমার স্ত্রী সুনন্দা।'

দুলে ওঠে জাহ্নবীর পৃথিবী। মাথা ঝিমঝিম করে। উত্তর দিতে পারেন না তিনি।

তমালবাবু বলেন, 'আপনি অবাক হচ্ছেন তো? ইন্দিরার জন্মের এক বছর পরে একটি দুর্ঘটনার ফলে সুনন্দা প্যারালাইজড হয়ে যায়। কথাও বিশেষ বলতে পারে না। অনেক চিকিৎসা হয়েছে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। সাধারণত আমি ওর কথা কাউকে বলি না। বাঁকা মন্তব্য সহ্য হয় না।'

কোনরকমে নিজেকে সামলে জাহ্নবী বলেন, 'আপনার প্রতি আমার সম্মান বহু গুণ বেড়ে গেল।'

—- 'আপনি বসুন প্লিজ।'
*****

একটি গার্ডেন আমব্রেলার নিচে বসে আছেন জাহ্নবী। নিজের ওপর ঘৃণা হচ্ছে তাঁর। কেন বাকি সকলের মত তিনিও নারী-পুরুষের সম্পর্ককে সেই একই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখলেন? তমালবাবু স্ত্রীর কথা জানাননি। তিনি নিজেও তো স্বপ্নদীপের কথা বলেননি।

মাথা উঁচু করে ভাবলেশহীন দৃষ্টি নিয়ে বৃত্তাকার ছাতাটিকে দেখেন জাহ্নবী। এক ছাত্রীর মা মেসেজ করেছে, 'ম্যাডাম, মেয়ে বৃত্তের পরিধির ফর্মুলা লিখেছে 2πr. ঠিক লিখেছে?'

'2πr' এর উপর জাহ্নবীর দৃষ্টি আটকে যায়। 'π' ইনফাইনাইট নাম্বার। তবুও অঙ্কের ফর্মুলায় তার প্রয়োজন সর্বাধিক। অসীমের ওপর ভরসা করে মানুষ সীমা নির্ধারণ করে। স্বপ্নদীপ বলত, 'ছাতার তলা ভীষণ ব্যক্তিগত।' ছাতার দিকে তাকিয়ে জাহ্নবীর মনে হয়,একটি ছাতার পরিধির ভিতর অসীমের ডানায় ভর করে অজস্র ব্যক্তিগত স্বপ্ন বোনে মানুষ। কিন্তু ছাতার নির্ধারিত পরিধি অতিক্রম তার নিষিদ্ধ।

পাশে অপর একটি ছাতার তলায় ফটো তুলছে একটি সুখী পরিবার। সেদিকে তাকাতে জাহ্নবীর ভয় হয়, যদি তাঁরই লোলুপ নজর বয়ে আনে অভিশাপ!