পুণ্যভূমি হালিশহর

অমৃতা ব্যানার্জী,

কলকাতা


তীর্থ ভ্রমণ জাগ্রত করে চেতনা। দৈনন্দিন জীবনের ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ মন নতুন উদ্যমে পথ চলার প্রেরণা পায়। তীর্থক্ষেত্রের সঙ্গে যদি জড়িয়ে থাকে মহাত্মাদের কাহিনী, তবে জীবন পায় নতুন দিশা।

অফবিট স্থানে ভ্রমণ আমার পছন্দ। অগত্যা একটু পড়াশোনা করে হালিশহর ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম।
কিছু কাজের জন্য হুগলির অন্তর্গত ব্যান্ডেলে ছিলাম। ৬ই আগস্ট, ২০২২ আমাদের যাত্রা শুরু হল।

পশ্চিমবঙ্গে অনেক তীর্থক্ষেত্র আছে। কিন্তু অন্যতম সাধনপীঠ হালিশহর আজও অবহেলিত। এই শহর সাধক রামপ্রসাদ সেন, রানী রাসমণি, শ্রীপদ ঈশ্বরপুরী, স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির মতো মানুষের স্পর্শধন্য।

ব্যান্ডেল চার্চ থেকে সাধক রামপ্রসাদের ভিটের দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। গাড়ি করে পৌঁছতে প্রায় ৪০ মিনিট মতো সময় লাগে। ব্যান্ডেল চার্চের সামনে থেকে জি.টি.রোড পের করে কল্যাণী ব্রিজের ওপর দিয়ে পৌঁছলাম হালিশহর।

উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত গঙ্গা তীরবর্তী স্থান হালিশহর। শহর জুড়ে এখনও আটপৌরে ছাপ। প্রকৃত গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের শস্য শ্যামলা রূপ এখানে বিরাজমান।

গুগল নেভিগেটরের সহায়তায় পৌঁছলাম আমাদের প্রথম গন্তব্য সাধক রামপ্রসাদের ভিটায়।

১১২৭ বঙ্গাব্দে হালিশহরে(তৎকালীন কুমারহট্ট) জন্মগ্রহণ করেন রামপ্রসাদ সেন। বাংলা সাহিত্যে ছিল তাঁর পাণ্ডিত্য। তবে তাঁর জীবন মা জগদীশ্বরীর চরণে সমর্পিত ছিল। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রচিত শ্যামা সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে রাজকবির পদ এবং জমি প্রদান করেন। সাধক শুধু গ্রহণ করেন জমি। সেখানে 'পঞ্চবটী' এবং 'পঞ্চমুণ্ডাসন' স্থাপন করে শুরু করেন মাতৃ আরাধনা। রচনা করেন অজস্র সঙ্গীত, যা বাংলার ইতিহাসে রামপ্রসাদী সঙ্গীত নামে চিরস্মরণীয়। এই স্থানেই একদিন মা জগদীশ্বরী তাঁকে কন্যারূপে দর্শন দেন।

সাধক রামপ্রসাদের মৃত্যুর পরে তাঁর ভিটে অবহেলিত অবস্থায় পড়েছিল ৭৩ বছর। ১৮৫৪ সালে স্থাপিত হয় The Goodwill Fraternity, যা আজও রক্ষণাবেক্ষণ করে চলেছে সাধকের স্মৃতি।

বর্তমানে এই স্থানের কেন্দ্রে রয়েছে শ্বেতপাথরের মন্দির, যার গর্ভগৃহে বাস করেন মা জগদীশ্বরী। মূল মন্দিরের চারিধারে সবুজের সমাহার এবং রয়েছে একটি পুষ্করিণী। মন্দির চত্ত্বর বেশ পরিষ্কার।


আমরা যখন মন্দিরে পৌঁছলাম তখন বেশ বৃষ্টি পড়ছে। ভোগ নিবেদনের জন্য দেবী দর্শন কিছু সময়ের জন্য বন্ধ। আমরা পুষ্করিণীর পাশে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। বৃষ্টিভেজা দিনে রামপ্রসাদের ভিটায় মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছিল। তারপর মন্দির কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ভোগ গ্রহণ করে পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য রানী রাসমণির ঘাট। রানী রাসমণি, যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির, যেখানে মাতৃ আরাধনা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সেই রানীমার জন্মস্থানও এই হালিশহর।

রামপ্রসাদের ভিটা থেকে রানী রাসমণি ঘাটের দূরত্ব প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। গুগল নেভিগেটর ঘুরপথ দেখানোয় স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞাসা করে পৌঁছলাম গন্তব্যে।

বিস্তীর্ণ গঙ্গা। উপযুক্ত ঘাটের অভাবে এই গঙ্গাতেই পা পিছলে পড়ে প্রাণ হারাতেন অনেক দরিদ্র মানুষ। তৎকালীন জমিদাররা সাধারণ মানুষের মঙ্গলের কথা ভাবেননি। রানী রাসমণি জমিদারদের বিরোধিতা করে নির্মাণ করেছিলেন এই ঘাট।

ঘাটের তীরেই দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের আদলে মা ভবতারিণীর মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। দোতলায় প্রতিষ্ঠিত দেবী মূর্তি এবং তার পাশে শিব মন্দির।

আমরা দুপুর দেড়টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম। দেখলাম তিনজন মহিলা মন্দিরে বসে অবিরাম শ্যামা সঙ্গীত গাইছেন। মায়ের প্রতিকৃতি অপূর্ব, সদা হাস্যময়ী।

মাকে প্রণাম জানিয়ে নেমে এলাম।

বর্ষায় টইটুম্বুর জাহ্নবী। ঘাটে দাঁড়িয়ে দু’চোখ ভরে উপভোগ করলাম জাহ্নবীর শোভা, বহু কল্প ধরে ভারতভূমি যাঁর কৃপাধন্য।

ঘাটের ওপরে এসে খেলাম ফুচকা। হালিশহর এখন বিখ্যাত ফুচকা গ্রাম। এখানে বিভিন্ন ধরণের ফুচকা পাওয়া যায়।

গঙ্গার ধার দিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম। মন তখন একান্তে গুনগুন করছে,

“মন রে কৃষিকাজ জান না।
এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।।“

(সমাপ্ত)