প্রথম বৃষ্টি
অনিন্দিতা গুড়িয়া,
নিউ-দিল্লি
আষাঢ় মাস প্রায় শেষ হতে চলল ,এখনো বৃষ্টির দেখা নেই ।প্রচণ্ড গরমে
সকলের হাঁসফাঁস অবস্থা। চা-এর পর্ব শেষে সুবিমল আর কৃষ্ণা সারা সপ্তাহের
গোছান-গাছান ধোয়া মোছার কাজে লেগে পড়েছে। টেবিলের উপরে বই ম্যাগাজিন
গুলো গোছাতে গোোছাতে কৃষ্ণা গুনগুন করে গাইতে থাকে তার খুব পছন্দের
রবীন্দ্র সংগীত-" আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে".............
সুবিমল হঠাৎ বলে ওঠে-
-তুমি এত বেরসিক আগে তো জানা ছিল না!
অবাক হয়ে কৃষ্ণা বলে- আমি বেরসিক? কি বলতে চাইছো ঠিক বুঝলাম না তো !
মুখটা গম্ভীর করে সুবিমল বলে -
এই সময় তোমার গাওয়া উচিত ছিল- " আজি কাঠ ফাটা রোদ্দুর গরমের দিনে" হা
হা হা হা হা হা হা
দুজনেই হেসে উঠলো।
কৃষ্ণা বলল-
সত্যি এ বছর বর্ষার আর দেখা নেই, সবে সকাল আটটা; এর মধ্যে এত রোদ্দুর আর
বিচ্ছিরি গুমোট গরম যে প্রাণ আই -ঢাই করছে। বৃষ্টির যে কবে দেখা পাব কে
জানে ?
'বৃষ্টি '-শব্দটা যেন দুজনের কানে বাজতে থাকে আর তার ঢেউ উন্মত্তের মতো
আছড়ে পড়ে দুজনের বুকের ভিতর। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। শুধু
কৃষ্ণার বুকের গভীর থেকে এক চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ।
বৃষ্টি ওদের একমাত্র সন্তান ,বয়স; পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরের মধ্যে তিন
বছর সে বাবা-মায়ের কাছ ছাড়া । বিয়ের ঠিক দু-বছরের মাথায় এক বর্ষন
মুখর দিনে বৃষ্টির জন্ম হয়েছিল বলে ওর নাম রেখেছিল বৃষ্টি। বৃষ্টির মতোই
সুন্দর আর ছটফটে ছিল সে। মাত্র দশ মাস বয়সে সে হাঁটতে শুরু করে আর কথা
বলত ঠিক যেন বুলি শেখানো তোতা । দু'বছর বয়সেই প্রায় ১০-১২ টা বাংলা আর
ইংরেজি কবিতা মুখস্ত বলতে পারতো । সারাদিনে যতক্ষণ জেগে থাকতো ততক্ষণই
ছোটাছুটি ,হুল্লোড় আর বকবক করে কথা বলা । দু বছরের জন্মদিনের দিন সে
মায়ের থেকে শেখা "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে"- গানটির দুটি লাইন ও
গেয়েছিল সবার সামনে।
ঠিক তার তিনদিন পর থেকে মেয়েটার ভয়ানক জ্বর হয়। এক সপ্তাহ চিকিৎসা
করার পরেও সুস্থ হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বরং দিন প্রতিদিন
মেয়েটা বেশি ক্ষীন হয়ে পড়ছে । শেষে ডাক্তার পরীক্ষা করে জানালো
টাইফয়েড । এরই মধ্যে আবার বৃষ্টির শরীরে পক্স ও দেখা যায়। সুবিমল
কৃষ্ণা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মেয়ে কথা বলে না ,খাবার খায় না, নড়ে না
চড়ে না, মুখে ওষুধ দিলে সিকি ভাগ পেটে যায় বাকিটা কষবেয়ে গড়িয়ে পড়ে
যায় । মাঝে মাঝে ক্ষীন শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য ছোট্ট বুকটা একটু ওঠা নামা
করে এতেই বোঝা যায় সে বেঁচে আছে। কলকাতার সব বড় বড় ডাক্তারকে
দেখিয়েছে কেউ আশার আলো দেখাতে পারে না।
এই সময় সুবিমলের মাসতুতো বোন মনিকা দিল্লি থেকে ফোন করে কুশল বিনিময়ের
জন্য। ফোন ধরেই সুবিমল হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে -
-মনি আমার বৃষ্টি বুঝি হারিয়ে যাবে চিরদিনের মত...............
ওপাশ থেকে মনিকা বলে- কেন কি হয়েছে ?
সব শুনে বলে- তোমরা একটু আর দেরি না করে দিল্লিতে এসো। আমার বাড়ির কাছেই
অল ইন্ডিয়া মেডিকেল সাইন্স, এখানেই বৃষ্টির চিকিৎসা করাবো, আশা করি ও
সুস্থ হয়ে উঠবে ।
দুজনে আশায় ভর করে মৃত প্রায় মেয়েটিকে বুকে নিয়ে দিল্লিতে এসে
পৌঁছয়। এরপর এইমস এ চলতে থাকে তার চিকিৎসা। প্রায় মাসখানেক জমে মানুষে
টানাটানির পর বৃষ্টি সুস্থ হয়। ডাক্তার বাবুরা চিকিৎসা করে বৃষ্টির
প্রান তো রক্ষা করেছেন কিন্তু হারিয়ে গেছে তার মুখের কথা, কোমরের নিচ
থেকে শরীরের বাকি অংশ কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। আর্তনাদ করে ওঠে
কৃষ্ণা- হে ভগবান তুমি একি করলে ! এর চেয়ে তো ভালো ছিল একেবারেই নিয়ে
নিতে । ফিরিয়েই যদি দিলে তবে আগের মতই দিলে না কেন?
সান্তনা দেন সুবিমল- ঈশ্বর যখন প্রাণভিক্ষা দিয়েছেন তখন চেষ্টা করলে ও
আবার আগের মত হতে পারবে।
কোন দেব-দেবী তীর্থস্থান মন্দির মসজিদ গির্জা ডাক্তার কবিরাজ বাদ রাখে না
ওরা। যে যেখানে বলেছে ছুটে গেছে দুজনে। অবশেষে ওরা হরিদ্বারে এক আশ্রমে
রেখে এসেছে বৃষ্টিকে। আশ্রমের সেবক সেবিকা এবং বাবা ও আশ্বাস দিয়েছেন
-সুস্থ হয়ে যাবে বৃষ্টি তবে ধৈর্য ধরতে হবে, সময় লাগবে।
প্রায় তিন বছর হয়ে গেল এখনো বৃষ্টি সেই আশ্রমে আছে। এক সপ্তাহ পরে
বৃষ্টির পঞ্চম জন্মদিন। পাঁচ বছর পূর্ণ করবে বৃষ্টি । পাছে বৃষ্টির প্রতি
স্নেহ মমতা কমে যায় এই ভয়ে ওরা আর দ্বিতীয় সন্তানও নেয়নি এতদিন
পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় পরিজন সবাই বলেছে -বৃষ্টিতো চিকিৎসাধীন আছে
তোমরা তো আর একটা সন্তান নিতে পারো। তোমাদের বৃষ্টির অভাব যে পূর্ণ করে
দেবে।
তবুও ওরা রাজি হয়নি । দুজনের পূর্ণ বিশ্বাস 'বৃষ্টি কখনো স্থির হতে পারে
না, বৃষ্টি যে ছটফটে দামাল'।
তিন মাস আগেও যখন ওরা হরিদ্বারে গিয়েছিল বৃষ্টিকে দেখতে, তখন আশ্রমের
বাবা বলেছিলেন খুব তাড়াতাড়ি বৃষ্টি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরতে পারবে
বৃষ্টি।
হঠাৎই দুজনের চিন্তার ছেদ টানে ফোনের ঘন্টা। টেবিলের কাছে ছিল বলে
কৃষ্ণাই ফোনটা রিসিভ করে।
- হ্যালো
- ওপাশ থেকে শব্দ আসে-
- হ্যালো মিসেস মজুমদার, মে হারিদুয়ার সে বোলে রাহি হু
কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর আবারও ফোনের ওপার থেকে শব্দ ভেসে আসে-
আপ লোগো কে লিয়ে এক সন্দেশ থা, লিজিয়ে আপ বাত কিজিয়ে
ফের কিছুক্ষণ চুপচাপ , এদিকে কৃষ্ণার চিন্তার পারদ হু হু করে বাড়ছে।
মুখটা ফ্যাটাসে হয়ে আসে, ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ, আড়ষ্ট হয়ে আসে জীভ। এই
সময় হরিদ্দার থেকে ফোন করেছে! কি খবর? সে কি বলতে চায় ?কৃষ্ণোর অবস্থা
দেখে সুবিমল ইশারায় জিজ্ঞাস করেন, কে ?কোথা থেকে?
শুধু কৃষ্ণার ঠোঁট নড়ে, শব্দ বেরয় না কিছু।
বুদ্ধি করে ফোনের স্পিকারের বটনটা অন করে দেয় সুবিমল আর প্রায় সঙ্গে
সঙ্গে দুজনে শুনতে পায় কচি গলার আধো শব্দ -মা বাবা,কবে আসবে? আমি ভালো
আছি । আমি বাড়ি যাব..
কৃষ্ণার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে -'বৃষ্টি'......গলা ধরে আসে।
দুজনের চোখ বেয়ে শ্রাবণের ধারার মতো ঝর ঝর ঝরে পড়ে অশ্রু বৃষ্টির ধারা।
আর সঙ্গে সঙ্গে বাইরে ও তুমুল জোরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে -বর্ষার প্রথম
বৃষ্টি।
