সাঁওতালদের বিয়ে
স্বাতী নাথ,
বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ
সাঁওতাল সমাজে বারোটি পারিস বা গোত্র বর্তমান, যেগুলি একাধিক খুঁট বা
উপভাগে বিভক্ত। একই পারিসের মধ্যে বিবাহের অনুমতি থাকলেও একই খুঁটের
মধ্যে বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
সাঁওতাল সমাজে বাল্য বিবাহ প্রচিলত নয়। ছেলের বাবা রায়বার বা ঘটকের
মাধ্যমে কনের খোঁজ করেন। কনের মা ও মাসির দক্ষতা ও কর্মকুশলতা কনের গুণ
হিসেবে বিবেচ্য হয়। ছেলে হাট, বাজার, মেলা প্রভৃতি পূর্বনির্ধারিত
স্থানে কনে দেখতে যান। পাত্রের কনে পছন্দ হলে পাত্রের পিতা উপহার নিয়ে
কনের বাড়ি যান। এরপর কন্যাপক্ষ পাত্রের বাড়ি গেলে পাত্র তাঁদের কোলে
বসিয়ে চুম্বন করে উপহার সামগ্রী দেন। পাত্রীর পিতাকে পাগড়ি ও নতুন
কাপড় প্রদান করা হয়। এরপর পাত্রপক্ষ কনের বাড়ীতে গেলে একই রীতি অনুসরণ
করা হয়। কনের বাড়ীতে বিবাহের দিন স্থির করা হয়। বিয়ের যতদিন বাকী
থাকে, একটি কাপড় বা সুতোয় ততগুলি গিঁট বেঁধে শালপাতার পাঁচটি বাটিতে
হলুদ বাটা, দূর্বা ও আতপ চালের সাথে ঘটকের মাধ্যমে একে অপরের বাড়ীতে
পাঠানো হয়।
বিবাহ মন্ডপ তৈরী করার উদ্দেশ্যে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে হাঁড়িয়া মদ
উৎসর্গ করা হয়। পাত্রের পিতা জগমাঝিকে পাঁচজন করে ছেলে-মেয়ে জোগাড় করে
আনতে বলেন। জগমাঝি গোড়েৎ মাঝিকে এই কাজের দায়িত্ব দিলে তিনি এই কাজটি
করেন। ‘’নায়কে’’ বা পুরোহিত মন্ডপের উদ্দেশ্যে একটি খয়েরী রঙের মুরগী
‘’মড়ৈককে’’ বা পঞ্চ দেবতা ও ‘’মারাং বুরুর’’ উদ্দেশ্যে দুইটি সাদা মুরগী
বলি দেন। মন্ডপ তৈরী হলে জগমাঝি মন্ডপের মধ্যে একটি গর্ত খোঁড়ার
ব্যবস্থা করেন। পাত্রের পিতা-মাতা কাঁচা হলুদ, পাঁচটি কড়ি, তিনটি
দূর্বা, তিনটি আতপ চাল হলুদ বাটা দিয়ে মেখে একটি পুঁটলিতে বেঁধে
গর্তটিতে রেখে দেন। এরপর গর্তটিতে একটি মহুয়া গাছ লাগিয়ে খড়ের কাছি
দিয়ে তিন পাক জড়িয়ে গাছের গোড়া মাটি দিয়ে লেপে পাত্র ও পাত্রীর ছবি
আলপনা দিয়ে আঁকা হয়। মন্ডপের কাজ শেষ হলে সকলে মিলে হাঁড়িয়া মদ পান
করেন।
বিয়ের দিন বরপক্ষ থেকে কনের বাড়ীতে অগ্রগামীরা যান। এরপর পাত্রের
বাড়ীর সকলে কোন নদী বা পুকুর থেকে জল আনতে যান। পাত্রের মা একটি ডালায়
আতপ চাল, ধান, দূর্বা, ডিম, তেল, সিঁদুর ও সুতো নিয়ে যান। পাত্রের
কাকীমা একটি তরোয়াল ও পিসিমা তীর ধনুক নিয়ে যান। দুইজন মেয়ে মাথায়
করে সুতোর ওপর শাড়ি দিয়ে ঢেকে কলসী নিয়ে যান। জলে তীর ছুঁড়ে ও
তরোয়াল দিয়ে কুপিয়ে দেওয়ার পর ঐ মেয়েরা কলসিতে করে জল তোলেন।
বরযাত্রীরা যাত্রা করার পূর্বে পাত্রকে তাঁর মায়ের কোলে বসিয়ে গুড়জল
খাওয়ান। পাত্র একটি ধাতু্র মুদ্রা মুখে নিলে তাঁর মা তাঁকে স্তন্যদান
করেন ও পাত্র মাকে মুদ্রাটি উগরে দেন। মেয়েরা গান ধরে[ কোলে করে পাত্রকে
গ্রামের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। বিয়ের সময় পাত্রের ভগ্নীপতি তাঁকে
কাঁধে নিয়ে দাঁড়ান। পাত্রীকে বড় ডালাস বা দেউড়ির ওপর বসিয়ে আনা হলে
শুভদৃষ্টি হয় এবং পাত্র তাঁকে পাঁচ বার সিঁদুর দান করে সমস্ত সিঁদুর
তাঁকে মাখিয়ে দেন। এই বিবাহ পদ্ধতিতে কোন মন্ত্রোচ্চারণ করা হয় না,
শুধু পাত্রী বিদায়ের সময় মাঝি পাত্রকে প্রথামত কিছু কথা বলেন।