সন্তোষের সন্তোষ
সুব্রত ঘোষ,
নতুন দিল্লি
নাম সন্তোষ হলে কি হবে ,জীবনটা ওর অসন্তোষে ভরা। এক ফোঁটা শান্তি নেই
মনে। ঘরে বাবা, মা,বড় ভাই, তার বৌ ও ছেলে এবং ও আর ওর বৌকে নিয়ে মাঝারি
সাইজের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাবার পেনশন ,দাদার সরকারি চাকরি ,আর সন্তোষের
নিজের একটা ইলেকট্রিক সরঞ্জামের দোকান। দোতলা বাড়িটা ওদের বাবারই
বানানো। দাদার ফ্যামিলি উপর তলায় থাকে। ভাইয়ে ভাইয়ে সৌহার্দ্য বজায়
রাখতে বাবাই আগে থাকতে এই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। উপর থেকে বোঝা না গেলেও
বাড়িতে দুটো হাঁড়ি চড়ে । দাদার রান্নাঘর উপরে আলাদা। সন্তোষের বৌ নীচে
একটা অন্য রান্নাঘরে মায়ের সঙ্গে রান্নাবান্না করে। দাদার রান্নাঘর
আলাদা হলেও ভালোমন্দ তরিতরকারির এক্সচেঞ্জ চলে রোজই। কারণ বড়বৌমার হাতের
রান্নাই বাবার বেশি পছন্দ। দাদার আবার মায়ের রান্নাকরা আইটেমের কিছু
একটু চাইই রোজ, তা সেশুধু একটু আলুভাতে মাখাই হোক না কেন। তাই আদান
প্রদান চলতেই থাকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে। বাবা পেনশনের টাকা থেকে দাদার
ছেলের পড়াশোনার নামে কিছু দেয় আর কিছুটা সংসারে ঢালে। সন্তোষের
ইলেকট্রিকের দোকানে আয়ের কোনো স্থিরতা নেই আর অনেকটাই সিজন্যাল ব্যাপার।
গরমের সময় আর বর্ষাকালে হাতে কিছু আসে ,তা নয়তো একরকম মাছি তাড়াতে রোজ
দোকানে গিয়ে বসে থাকতে হয়। এটাই সন্তোষের অসন্তোষের বা অশান্তির কারণ।
দোকানে বিক্রিবাটা না থাকলে যাকে সামনে পায় বসিয়ে নিয়ে গল্প গুজবে
মেতে যায় আর সময় হলে দোকান বন্ধ করে ঘরে ফেরে। সেদিনও এইভাবে বিকেল
পর্যন্ত কেটে গেলেও সন্ধ্যার মুখে একটু ব্যতিক্রম ঘটে গেল। সেদিন প্রায়
সন্ধ্যা হয় হয় ,ওদের সোসাইটির বাসিন্দা মিঃ ত্রিপাঠী সস্ত্রীক ওর
দোকানে এসে হাজির হলেন একটা চার সেলের টর্চ কিনতে। ত্রিপাঠী টর্চ কিনতে
চান শুনে একটু আশ্চর্যই হয়েছিলো সন্তোষ। কারণ ওদের সোসাইটিতে তো আর লোড
শেডিংএর ঘটনা ইদানীং ঘটে না। বড় জেনারেটর বসানোর পর থেকে সেই সমস্যা
একেবারেই মিটে গেছে। তাই চার সেলের টর্চ নেবার কি কারণ জানতে চেয়ে
সন্তোষ যা শুনলো তাতে সন্তোষের জীবনের অশান্তি ঘোচাতে যেন বড় টর্চের আলো
পরিষ্কার এক পথের সন্ধান দিলো। ত্রিপাঠী জী জানালেন তাঁর ধরমপত্নী আগামী
কাল ভোরে কয়েকজনের সঙ্গে প্রয়াগে কুম্ভস্নান করতে যাচ্ছেন। যদিও
কুম্ভমেলায় এবার ব্যবস্থা খুবই ভালো, তবুও যদি কখনো প্রয়োজন হয় ভেবেই
টর্চটা সঙ্গে রাখা। সাবধানের মার নেই। ত্রিপাঠীজীকেও সঙ্গে যাবার জন্যে
সকলেই খুব পীড়াপীড়ি করছে ,কিন্ত সময়ের অভাবে যাওয়া হয়ে উঠবে না।
কথার মধ্যেই শ্রীমতী ত্রিপাঠী বলে উঠলেন 'দেখিয়ে না ভাইসাহাব, তিন দিন
কি তো বাত হ্যায়, কৌন সা ইতনা নুকশান হোগা সাথ যানে সে? ম্যায় অকেলি
যানে সে যিতনা পুণ্য কামাউঙ্গি, জোড়ি মে যাউঙ্গি তো পুণ্য দ্বিগুণা হোগি
ওঁর সাথ হি বৈভব ভি দ্বিগুণা হোগি। ইহ এয়সা কুম্ভযোগ হ্যায় কি জোড়িমে
ডুবকি লগানে সে বৈভব লক্ষ্মীজী খুদ চলকে ঘর মে আয়েগি।
সন্তোষ খুব মনোযোগ দিয়ে ত্রিপাঠী গিন্নির কথা শুনছিলো। একটু থেমে উনি
আবার বললেন, 'আজকা জমানাহি এইসা হ্যায় রুপৈয়া ইয়ানি বৈভব রহনে সে হি
ইজ্জত মিলতি হ্যায় নেহি তো কৌন পুছতা? বৈভব জীন্দগী মে খুশিয়াঁ লে আতি
হ্যায়। সহি বোল রহি হু ন ভাইসাহাব?,
আঁ হাঁ হাঁ, একদম সহি বাত হ্যায় ম্যাডাম জী" সন্তোষ তাল মেলায়। ও জানে
মিঃ ত্রিপাঠীও ঠিক যাবে। সুন্দরী মিসেসকে একলা ছেড়ে দেবে তা হতে পারে
না; যে রকম চক্ষে হারায় সব সময় ! ও ছুটি নিয়েই যাবে। এমনিতেই যথেষ্ট
গুছিয়ে নিয়েছে কোম্পানির মালিকের বাজার সরকার হয়ে, তবু অধিকন্তু ন
দোষায়। মিসেসের সঙ্গে যাওয়াতে যদি বৈভব বাড়ে তাতে ক্ষতি কি? এ ছাড়া
সন্তোষ জানে ত্রিপাঠী গিন্নি সোসাইটির ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিজেকে জড়িয়ে
রেখে মহল্লায় বেশ এস্টাবলিস্ড এখন। রামনবমী বা নওরাত্রিতে মন্দিরে ঢোল
পিটিয়ে দলবলের সঙ্গে গলা ছেড়ে গান করেন। কতো রকম ব্রত উদযাপন করেন, এ
হেন ভক্তিমত্তী মহিলার মুখে বৈভব বানানোর সহজ উপায় জেনে সন্তোষের মাথার
ঘিলু চমকে গেছে। ও অন্য দিনের চেয়ে আধঘন্টা আগেই দোকান বন্ধ করে বাড়ি
চলে এসে প্রথমেই বউকে তিন দিনের মতো শাড়ি ব্লাউজ গুছিয়ে নিতে বললো আর
তার সঙ্গে ওর জন্যও দুসেট প্যান্ট শার্ট , তোয়ালে, দাঁতের ব্রাশ, পেস্ট
,সাবান ইত্যাদিও নিতে বলে দিলো। পরে কি মনে করে তোয়ালের জায়গায় গামছা
নিতে বললো। বৌ যতোই জানতে চায় ওই সব গোছগাছ কেন , কি হবে, কোথায় যাবে
ইত্যাদি, সন্তোষ ততোই চুপ করে থেকে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে কি সব ভাবতে
থাকে। অগত্যা বৌ শাশুড়ির দ্বারস্থ হয়। মা এসে জানতে চান -- হ্যাঁরে
সন্ত, শাড়ি প্যান্ট জামা গুছিয়ে নিয়ে তোরা কোথায় যাবি?
-- বলবো বলবো, আগে যাবার ব্যবস্থাটা করে ফেলি তারপর বলবো।' -- কোথায়
যাবি সে কথা যখন বলবি না, তখন যেতে হয় তুই যা। বৌমা যাবে না । ওকে কেন
টানছিস? পাঁচ মাস শেষ হয়ে ছয়ে পড়েছে এখন ওকে নিয়ে টানা----। বাবা
ভদ্রোলোক এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলেন , এবার সীনে অবতীর্ণ হলেন
---একটু ঝেড়ে কাশো তো বাবা, কি করতে চাও। কোথায় যাবে তুমি ?
এবার সন্তোষকে সব খুলে বলতেই হোলো। জানালো টাকা পয়সা বেশি কামাতে হোলে,
ঘরে বৈভব বাড়াতে হোলে ওদের দুজনকে প্রয়াগে গিয়ে মহাকুম্ভে ডুবকি
লাগাতেই হবে। বাবাকে মিসেস ত্রিপাঠীর কথা সব খুলে বললো। আর বললো ওর
বিশ্বাস ঘরে টাকাকড়ির আমদানী বাড়াতে হলে বৈভব বাড়াতে হলে ওকে বৌ নিয়ে
জোড়িতেই কুম্ভস্নান করতে হবে। আর ও ঠিক করেছে ও জোড়িতেই যাবে। তাই যেতে
যে হবে এটা নিশ্চিত। ট্রেনে গেলে ধকল কম হবে। গোছানো থাকলে টিকিট করে
কালকের ট্রেনে বেরিয়ে পড়বে।
বৈভব অর্থাৎ ফাইনান্স বা টাকা পয়সার সঙ্গে বাড়ির সকলের সুখ, আনন্দ
আহ্লাদ, এক কথায় সর্বাঙ্গীন ডেভলপমেন্টের ব্যাপার জড়িত এই সত্যিটা
বোধগম্য হওয়াতে বাড়িতে রান্রেই কনফারেন্স বসলো। দাদা বৌদিও তাতে যোগ
দিলো। ঠিক হোলো বাবা -মা যেহেতু জোড়ি এবং ওনারাও বাড়ির বৈভব বাড়াতে
সক্ষম, সেহেতু ওনারাও কুম্ভস্নানে যাবেন। সন্তোষের সুবিধাই হোলো। বৌয়ের
দায়িত্ব বাবা মার উপরেই থাকবে, সেদিক থেকে ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে।
বৌদি একবার 'আঁমিও যাঁবো' সুর তুলতেই বাবা জানিয়ে দিলেন বাড়ি খালি করে
যাওয়া ঠিক হবে না আর যারা পুণ্য করে আসবে, তাদের পুণ্যেই বাড়ির সকলের
পুণ্য হবে, মঙ্গল হবে ।
শুভক্ষণে দুর্গা দুর্গা করে সন্তোষরা ট্রেনে চেপে কুম্ভমেলায় যখন পৌঁছলো
তখন কাক পক্ষী জেগে গেছে। নিজেদের জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করে ভোর ভোরই
সন্তোষ বৌকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে দূজনে মিলে ডুব দিয়ে এক প্রস্থ
স্নান সেরে নিল। কারণ ও ভেবে দেখলো ওদের বয়স কম, ধন দৌলত বা বৈভব যাই
বলো যদি সত্যি সত্যিই ওদের ভাগ্যে জোটে, তাহলে তা ভোগ করার সুযোগ তারা
তাদের জীবনে পাবে। আর বাবা মা তো অনেকদিন ধরে অনেক কিছু ভোগের পর জীবনের
চৌকাঠ ডিঙোতে পা বাড়িয়েই রেখেছে। তা ছাড়া এই কুম্ভস্নান থেকে যতটা
পুণ্য বাবা মা অর্জন করবে, তার হকদার হবে দাদা বৌদিরা যা নিয়ে সন্তোষের
কোনো মাথাব্যথা নেই ; তার ওপর ওর তেমন কোন লোভও নেই। যাই হোক ,ওরা স্নান
সেরে আসার পর বাবা মায়ের জোড়িও কুম্ভে ডুব দিয়ে পুণ্য অর্জন করে ফিরে
এলো। তারপর সারাদিন বিভিন্ন তাঁবুতে ঘুরে ঘুরে সাধুসঙ্গ করলো চারজনে
মিলে। দুপুরের দিকে জলে নেমে একটা এক্সট্রা ডুব দিয়ে নিজের পুণ্যটা আরোও
একটু বাড়িয়ে নিলো সন্তোষ। রাত্রে বাবা মা আর বৌকে নিজেদের ডেরায় পৌঁছে
দিয়ে তাদের বিশ্রাম করতে বলে ও নিজে গাঁজা আর ধুনি জ্বালিয়ে
ঘৌয়াচ্ছন্ন করে রাখা সাধনমার্গে বিচরণ করা ছাইভস্ম মাথা নাগা
সন্ন্যাসীদের তাঁবুতে ঢুকে তাদের সামনে হাতজোড় করে বসে থাকলো। মাঝে মাঝে
ও সন্যাসীদের নিভে যাওয়া কল্কেতে টিকে গাঁজা গুঁজে তাতে আগুন ছুইয়ে মুখ
দিয়ে টেনে ঠিকমতো জ্বালিয়ে ছিলিমটা তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেশ রাতে
হষ্টচিত্তে নিজের ডেরায় ফিরে গেল। একদিনে অনেক পুণ্য সঞ্চয় করতে পেরে
মনে মনে সন্তোষ খুব খুশি থাকায় আর গাঁজার নিজ মাহাত্মে খিদে বেড়ে
যাওয়ায় বৈষ্ণব ঢাবায় বেশি করে দেশী ঘি লাগানো রোটি - সব্জি -ডাল খেয়ে
ঘুমিয়ে নাগা সন্যাসীদের সঙ্গে স্বপ্নে বরফের পাহাড়ে ঘুরে বেড়ালো।
সন্তোষ ছোটবেলায় ভাঁড়ে করে নানান রকম বোতলের রঙ দিয়ে ঘষে গুড়ো করা
বরফ খুব খেয়েছে, কিন্ত দেখলো এ বরফ তার থেকে অনেক নরম আর অনেক ভূসভুসে।
পা ফেলতেই প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ঢুকে যাচ্ছে, আবার সহজেই উঠে আসছে।
চমৎকৃত হয়ে ও চারদিক দেখতে দেখতে নাগা সন্যাসীদের মাঝে শার্ট প্যান্ট
পরে আনন্দে হেঁটে যাচ্ছে চারপাশে দিগম্বর সন্যাসীদের অবলীলায় হঁটতে দেখে
সন্তোষও অনুপ্রাণিত হয়ে নিজের ফুলপ্যান্ট আর শার্ট খুলে দুহাতে দুটোকে
ঝুলিয়ে হাঁটতে লাগলো। সঙ্গে চলা সাধুরা ওর দিকে ফিরে তাকাতে ও হাসি হাসি
মুখে তাদের দিকে তাকালো কিন্তু ওর মনে হোলো সঙ্গের সাধু সন্যাসীদের খুব
একটা ইস্প্রেস করতে পারেনি। তখন সন্তোষ আরও এক ধাপ এগিয়ে ওর গেঞ্জি খুলে
ফেললো। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ও দেখলো বরফের মধ্যে থেকেও ওর একদম ঠান্ডা
লাগছে না। তাতে আরোও বেশি অনুপ্রাণিত হয়ে সন্তোষ শরীরের শেষ
লঙ্জাবস্ত্রটাও নিজের হাতে খুলে ফেলতে চাইলো। কিন্ত এতটা লঙ্জা শরমের
মাথা খেতে হয়তো ওর মন সায় দিল না, কি রকম বাধো বাধো ঠেকলো। ও
তাড়াতাড়ি কোমরের উপর থেকে হাত উঠিয়ে নিল। পরের দিন খুব সকাল সকাল ঘুম
ভেঙ্গে গেল সন্তোষের। বাইরে বেরিয়ে দেখলো অন্ধকার তখনো ভালোমতো কাটেনি।
কুয়াশার একটা পাতলা চাদর যেন হাওয়ায় ভাসছে। হঠাৎ চোখে পড়লো নাগা
সন্ম্যাসীদের বিরাট একটা দল হৈ হৈ করতে করতে স্নানের জন্য কুম্ভের দিকে
ছুটছে। কি মনে হতে ও ভিতরে গিয়ে গামছাটা টেনে নিয়ে আন্ডারওয়ারের উপর
মালকোঁচা মেরে ছোট করে পরে খালি গায়ে পুলিশ কর্ডন ভেদ করে ছুটে গিয়ে
সন্যাসীদের দলটার সঙ্গে জলে নেমে পড়লো। একটা ডুব দিয়ে মাথা তুলতেই এক
নাগা সন্গ্যাসী তার একটা হাতের থাবায় ওর মাথাটা চেপে ধরে আরোও দু তিনবার
জলে ডুবিয়ে দিলো। তারপর হাঁফাতে থাকা সন্তোষের কাঁধে হাত রেখে হাসতে
হাসতে পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলো --- এইভাবে না হলে কি কুম্ভ স্নান
পুরোপুরি হয়? অন্ততঃ তিনবার ডুব না দিলে কি পুণ্য হয়? মুক্তি হয়?
সন্তোষ সন্যাসীর স্পর্শ পেয়ে গদগদ হয়ে বলে --ঠিক বলেছেন বাবা, কয়েকটা
ডুব না দিলে এই কুন্তস্নান অপূর্ণই থেকে যাবে, পুণ্য বা বৈভব কিছুই মিলবে
না'। বলেই সন্তোষ আরোও তিনটে ডুব দিয়ে নিলো। সন্যাসী হাসিমুখে ওর দিকে
তাকিয়ে বললেন --- তুমি কি বৈভবের জন্য কুম্ভে এসেছো? তা কি ধরনের বৈভব
চাও? টাকা পয়সা প্রতিপত্তি না কি মনের বৈভবে ধনী হতে চাও? ঘর সংসারের
মায়ায় মুখ জুবরে পড়ে থেকে ধনদৌলতের কাদা পাঁকে ডুবে থেকে সারা গায়ে
পাঁক মেখে জীবনটা কাটালে কি শান্তি পাবে , না কি সেই চিন্তা করবে যাতে
মোক্ষ প্রাপ্তি করে উদ্ধার হবে? পৃথিবীর জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে?
তোমার কি মনে হয় বেটা? জীবনে সেই প্রাপ্তিটাই তো আসলি -সন্তোষ ।
বিহ্বল সন্তোষের মুখে কথা সরে না। হাত জোড় করে বারবার 'বাবা' বাবা, করে
জলের মধ্যেই নেতিয়ে পড়ে সন্যাসীর পা ছোঁয়। ভাবে দুজনে দুজনকে এর আগে
কোনদিন দেখে নি, তবুও এই নাগা সন্যাসী ওর নাম নিলেন! সন্যাসী ওর নাম
জানলেন কি করে? ইনি তো তাহলে অন্তর্যামী!
সন্তোষের মাথা বারবার জলের দিকেই নুইয়ে পড়তে থাকে। সন্যাসী এবার
জিজ্ঞাসা করেন ---কি করা হয়? সন্তোষ গলতে গলতে জবাব দেয় ---আমি
ইলেকট্রিকের কাজ করি বাবা ।
---তার মানে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ?
---না বাবা, আই টি আই এ ট্রেনিং নিয়েছিলাম। ইলেকট্রিক্যাল ডিপ্লোমা আছে।
একটা দোকান দিয়েছি ইলেকট্রিক্যাল গুডসএর।
--- তাই বুঝি? আরে আমিও তো বায়োটেক ইঞ্জিনিয়ারিং করেছিলাম,
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ছিলাম। কিন্ত সে জীবন ভালো লাগলো না -নাগা
সন্ন্যাসী হয়ে গেলাম খুব ভালো আছি এখন'। একটু থেমে সন্যাসী আবার বলেন '
আজই ফিরে যাবে তো? ওই যে একুশ নম্বরের তাঁবু ওটাই এখন আমার আস্তানা। আর
তিন দিন পরে তো কুম্ভ যোগ শেষ। যাই আমি স্নানটা করি। ফিরে কি করবে ভেবে
দেখ' বলেই নাগা বাবা ঘুরে গিয়ে ভিড়ে মিশে গেলেন। সন্তোষ আর তাঁকে দেখতে
পেল না। সকলেই নাগা ,সকলেরই দাড়ি আছে। অনেক চেষ্টা করেও সন্তোষ তাঁকে
চিনতে না পেরে আস্তে আস্তে জল থেকে উঠে পড়লো। ও নিজের ডেরায় যখন
পৌঁছিলো , ততক্ষণে ভালো রকম সকাল হয়ে গেছে। নানান্ চিহ্নধারী নানা
সম্প্রদায়ের সাধুসন্তদের পূণ্যস্নান শুরু হয়েছে। সাধারণ পুণ্যার্থীরাও
জলে নেমে গেছে। সন্তোষ যেহেতু স্নান সেরে এসেছে, সেইহেতু ও ছাড়া বাকি
তিনজন স্নান করতে গেল। ও সকালে স্নান করে ফিরে আসার পর থেকে কি রকম গুম
মেরে রয়েছে দেখে ওকে বেশি না ঘাঁটিয়ে তিনজনে স্নান সেরে এলো। তারপর
জলখাবার খেয়ে চারজনে মিলে কুম্ভমেলা ঘুরে দেখতে বেরলো। নাগা
সন্ন্যাসীদের তাঁবুগুলোর সামনে দিয়ে যাবার সময় সন্তোষের চোখ একুশ
নম্বরটা খুঁজতে লাগলো। চোখে পড়ামাত্রই বাবা মা আর বৌকে দূরে রাস্তায়
দাঁড় করিয়ে রেখে ছুটে গিয়ে তাঁবুর ভিতরে মুখ বাড়িয়ে সেই নাগাবাবাকে
দেখতে পেল, ছাই মেখে পদ্মাসনে বসে আছেন। ওকে দেখতে পেয়ে দূর থেকেই বলে
উঠলেন 'বৈভব ! দৌলত ! শোহরত !-এখনো তিনদিন এখানে আছি। বাবা - মায়েদের
সঙ্গে করে আগে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে তো ,না কি?' বলে হাত নেড়ে ওকে চলে
যেতে বললেন। সন্তোষ হে হে করে ওখান থেকেই ফিরে এলো। ভিতরে যেতে সাহসে
কুলালো না। তবে ও আরো একবার ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। ওর ধারণা আরোও বদ্ধমূল
হলো যে এই সন্যাসী অনেক উচ্চমার্গের এবং সত্যিই অন্তর্যামী। তা না হলেকি
করে জানলেন যে ওর বাবা-মা আর বৌ সঙ্গে রয়েছে ?ওর মাথার ঘিলু বেশ ভালোরকম
চমকে গেছে মাথায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে তড়িঘড়ি ওদের তিনজনকে নিয়ে ও
এগিয়ে গেল।
ট্রেনে উঠে সকলে যখন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেড়ার মতো
কুম্ভমেলা-দেখা-ভাগ্য নিয়ে নানান আলোচনায় মত্ত, সন্তোষের মন জুড়ে তখন
ওই এম এন সি র মোটা মাইনের চাকরি হেলায় ছেড়ে দিয়ে চলে আসা অন্তর্যামী
নাগা সন্ন্যাসী |
রাত্রে ট্রেনের গতির সঙ্গে তাল রেখে ওর চিন্তার গতিও বাড়ে। একসময় ঘুমের
মধ্যে স্বপ্ন দেখে সে ওই নাগা সন্ন্যাসীর সামনে গায়ে ছাই মেখে নাঙ্গা
হয়ে বসে আছে গাঁজার কলকে হাতে। আবার কিছু পরে ওই সন্যাসীর হাত ধরে
সন্তোষ তুরীয় আনন্দে সাধনমার্গের বিভিন্ন স্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মনে ওর
কোনো দ্বন্দ, দ্বেষ ঈর্ষা, প্রলোভন, মাতৃসর্য্য, রাগ, অনুরাগ, বিরাগ,
বিরহ, বিচ্ছেদ, বেদনা, দুঃখ, কষ্ট, কিছুই নেই কেবল আনন্দই আনন্দ! কিসের
আনন্দ সেটা ঠিক বুঝে উঠতে না পারলেও, সেই তুরিয় আনন্দ গলা থেকে ভক্ ভক
করে অদ্ভুত আওয়াজ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নাগা সন্ন্যাসী ওকে
বোঝাচ্ছেন ---পৃথিবীর ধনদৌলত, বৈভব, শোহরত দিয়ে এই অপার আনন্দ কি তুমি
পেতে সন্তোষ? নাকি এই অনন্ত বিরাজিত শান্তি তুমি অনুভব করতে পারতে? এই
বৈভব যে হাসিল করতে পেরেছে, সেইই তো আসল দৌলতদার আদমী এই দুনিয়ায়, তাই
না বেটা? সন্তোষ সন্যাসীর পা দুটো জড়িয়ে ধরে গদগদ হয়ে বলতে যায়
---আপনি আমাকে বাঁচালেন বাবা। আপনি না পথ দেখালে রাস্তা ভটকে কোথায় যে
চলে যেতাম! এখন থেকে আমি আপনার---- কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ট্রেনের লাইন
চেঞ্জের আওয়াজে ওর ঘুমটা চটকে যায়। স্বপ্নের আবেশ নিয়ে স্মিত হাসি
হাসি মুখে সন্তোষ চলন্ত ট্রেনের কামরায় চোখ বোলায়। পারিপার্থিক
অবস্থাটা বুঝে উঠতে একটু সময় নেয়। তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে জানালা দিয়ে
মুখ বাড়িয়ে দেখে সকালের আলোয় ট্রেন নিউ দিল্লি স্টেশনে ঢুকছে। ট্রেন
থামতে সকলকে নিয়ে প্ল্যাটফর্মের বাইরে বেরিয়ে ক্যাব ঠিক করে বাবা, মা
আর বৌকে বসিয়ে নিজে বসতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে বলে ---বাবা তোমরা বাড়ি
চলে যাও। আমার এখন বাড়ি যাওয়া হবে না। আমাকে এখুনি আবার ফিরে যেতে হবে।
বাবা কিছু বলার আগেই মা আর বৌ একসঙ্গে প্রশ্ন করে --কোথায়? কেন?
মুখে এক টুকরো হাসি এনে সন্তোষ বলে ---আসলি বৈভব লক্ষ্মীর খোঁজে। তারপর
বাবার হাতে একটা পাঁচশো টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে ক্যাবের ড্রাইভারকে বলে
--- আপ ইন সবকো লেকর পৌঁহছো জী। বলে বাবামা বৌ আর তার মাধ্যমে মাত্র পাঁচ
মাসের মধ্যে আসন্ন সেই বিরাট সৌভাগ্যের কথা ভুলে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে
স্টেশনের টিকেট বুকিং কাউন্টারের দিকে হাঁটতে থাকে হন হন করে ।