সুখচাঁদ মাতাল

চিত্তরঞ্জন মন্ডল,

সোনারপুর, কলকাতা

হাতিবান্ধা গ্রাম। জেলা মুর্শিদাবাদ, মহকুমা জঙ্গীপুর, থানা-রঘুনাথগঞ্জ। পাঠকদের বিনয়ের সঙ্গে বলে রাখি, এ গ্রামের কথা আগেও আমি অনেক গল্পে উল্লেখ করেছি। আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে গ্রামের এই নামটা আমাকে খুব টানে। শুনেছি বিভিন্ন সূত্রে এর নামকরণের ইতিহাস। সত্যি মিথ্যে জানি না। এই গ্রামের মাঝে নাকি একটা বহু পুরানো বটগাছ ছিল। তার যে কত বয়স কেউ জানে না। তার ঝুরিগুলো এক একটা বড় বটগাছে পরিণত হয়ে গেছে। রাত হলে শয়ে শয়ে বাদুড় ঝুলে থাকত নাকি ঐ গাছে।

তখন ইংরেজ আমল। তখনকার এক নীলকর সাহেব দুটো হাতি এনে নাকি ঐ বটগাছের ঝুরিতে বেঁধে রাখত। সেই থেকে নাকি ঐ গ্রামের নাম হাতিবান্ধা। গ্রামের নাম বাদুড়বান্ধাও হতে পারত কিন্তু তা হয়নি কারণ সাহেবের বন্দুকের ছররায় নিরীহ বটফলভুক বাদুড়গুলোমাটিতে কুপোকাৎ হয়েছে আর সাহেবের উদরজাত হয়েছে। যে কটা কপাল জোরে বেঁচেছে তারা আর ঐ বটগাছে গ্রামের নামকরণের লোভে নাকি কখনও ফিরে আসেনি। তাই জরিপের খাতায় ইংরেজ বাহাদুরের বাইদুরিতে এই গ্রামটা হাতিবান্ধা নামে চিহ্ণিত হয়ে গেল। হারিয়ে গেল আগের সাবেকি নাম যা কেউ এখন আর বলতে পারে না।

আবার, মজার ব্যাপার হচ্ছে হাতিবান্ধা গ্রামের পাশেই হচ্ছে কলাবাগান। অর্থাৎ সাহেবের হাতির খোরাকের জন্য একটা বড় বাগানকে কলাবাগানে পরিণত করা হয়েছিল। এই কলাগাছ কেটে কেটে হাতিকে খাওয়ান হতো। সেই থেকে নাম হয়েছে লাগোয়া এলাকাটার "কলাবাগ" বলে। হাতির খাওয়ার ব্যবস্থা করলে তো হবে না শুধু, করতে হবে চানের ব্যবস্থাও। এ ব্যাপারে সাহেবদের ত্রুটি মেলা ভার। একটা বড় পুকুর কাটানো হলো, হাতির জলের প্রয়োজনে। একদিকে সান বাঁধানো ঘাট মাহুত বা সাহেবদের লোকলস্করদের চান করার জন্য। ঘাটের নামটা অবশ্য জানতে পারি নি। অনেক চেষ্টা করেও। শুধু জানতে পেরেছি সুখচাঁদ মাতাল বলে একজন এই ঘাটের আদি অকৃত্রিম বাসিন্দা। তাকে নিয়েই আমার এ কাহীনির শুরু।

সুখচাঁদের ভাল নাম বা আসল নাম কি তা জানা যায় না। মাতাল তার পদবিও নয়। এত মদ খেত যে সবাই ওকে মাতাল বলে ডাকত। আর সুখচাঁদ নামটা এসেছে এইভাবে যে সে সুখের চাঁদ। তাকে কেউ কাঁদতে বা রাগ অথবা দুঃখ প্রকাশ করতে দেখেনি কখনও।

যা জায়গা জমি আছে তাতে সংসার তার ভাল ভাবে চলে যায়। তার বউ সংসারের হাল ধরেছে প্রথম থেকে। ছেলেরা এখন সাবালক। যদিও এখনও কারও বিয়ে থা হয়নি। বাপকে তারা মদ খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। সুখচাঁদের কথা হলো-

তোমরা মদ খেয়ো না, সুখে থাক। আমাকে বিরক্ত করো না। আমি তো কারোর ক্ষতি করিনি। তোমাদের জায়গা জমি সবই তো রয়েছে। আমি নষ্ট করিনি। আমায় গান আর মদ নিয়ে থাকতে দাও। শুধু রাতেরবেলায় একধারে শুতে দিও।

সত্যি সত্যি মদ খেয়ে সুখচাঁদ কখনও কোন হুজ্জতি বাধায়নি। বরং মদ খেলে তার গানের গলা খোলে। পাও চলে। গানের গলাও খোলে। মাতাল হয়ে সে কখনও কাউকে গালও দেয়নি, কারো দোরও ঠেলেনি। চরম শত্রুও তার নামে কোন বদনাম দিতে পারবে না। অথচ কেন যে সে 'সুখচাঁদ মাতাল' খ্যাত হলো আজও সকলের কাছে তা এক দুর্জেয় রহস্য।

এ রহস্যের বেড়াজাল ভেঙে দিতে পারত তার স্ত্রী সাবিত্রি। কিন্তু তার মুখ থেকে কখনও স্বামীনিন্দা শোনা যায়নি। বরং বলত-

কি করব বলো, এ আমার কপাল। তার বিধবা মা ওর হাতে গছিয়ে দিয়েছে আমার আর যাবার জায়গা কোথায়? ছেলে দুটো রোজগেরে হলে আমি একটু হাফ ছেড়ে বাঁচি। ভাগ্যিস আমার মেয়ে নেই। কে ওই মাতালের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে যেত? ঠাকুর আমার ঐটুকু দয়া করেছে।

সুখচাঁদ প্রতি সন্ধ্যায় মদ খেয়ে ঐ ঘাটে বসে গান করত। গরমকালে ওখানেই শুয়ে রাত কাবার করে দিত। শীত-বর্ষায় তবু রাতেরবেলায় বাড়ি যেত। নিজের বাগানের কলা মুলো বাঁশ দু চারটে বেচে মদের খরচ জোগাত। বাগানে কাজ করে দিয়ে বউ এর কাছ থেকে কিছু পয়সা নিত। অন্যদের ফাইফরমাশ খেটে কিছু পয়সা রোজগারও করত। এভাবেই জুটত তার নেশার খরচ।

এই গ্রামেই বিলাসের বাড়ি। মাঝে মাঝে সুখচাঁদের সঙ্গ করত। সেই বিলাসও বউ এর মুখঝামটা খেয়ে দিল্লি চলে গেল সোনার কাজ করতে। সেখানে গ্রামের অনেক ছেলেই সোনার কাজ করে। বছর তিনেক বাদে বেশ ভাল পয়সা নিয়ে দেশে ফিরল বিলাস। এখন ভাল সিগারেট ছাড়া খায় না। বিড়ির কথা ভুলে গেছে। তার প্রিয় সুখচাঁদদার জন্য সে একটা বিলিতি মদের বোতল এনেছে। সত্যি কথা বলতে গেলে বিলাস গান খুব ভালবাসে। কত লোকে তার বউ এর কাছে কানভাঙানি দিয়েছে। আস্তে আস্তে নাকি সুখচাঁদের জন্য সে পাঁড় মাতাল হয়ে যাবে। সংসার বাঁচাতে গেলে তুমি ওকে কড়া শাসনে রাখো। যতই বিলাস বউকে বোঝাবার চেষ্টা করে যে, সে একটু আধটু মদ খায় ঠিক কথা, কিন্তু সে কখনও মাতাল হয়ে উঠবে না। সে সুখচাঁদদাকে খুব ভালোবাসে, সুখচাঁদদাও তাকে সমানভাবে ভালবাসে। মদ খেতে মানা করে। তার মতো হতে মানা করে অথচ তোমরা তাকে দোষ দাও। ওর মতো ভাল চরিত্রের একটা মানুষকে গ্রামে দেখাও দিকি। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। সংসারে অশান্তি এড়াতে মনের দুঃখে সে দিল্লি চলে যায় কাজ নিয়ে। যাবার আগে সুখচাঁদদাকে সব বলেছে। সুখচাঁদদা তাকে বুঝিয়েছে আমার জন্য সংসারে অশান্তি ডেকে আনিস না। একটা মেয়ে আছে তোর। সে বড় হবে। বিয়ে দিতে হবে। যা তুই দিল্লি, মন খারাপ করিস না। ফিরে আসলে তো আবার দেখা হবে। তখন দু' ভাই মিলে গান গাইব। তোর দিল্লির গল্প শুনব। তোর প্রতি আমার টান একটুও কমবে নারে।

সেই বিলাস কি করে ভুলবে তার সুখচাঁদদাদাকে। সন্ধ্যাবেলায় সে কলাবাগের পুকুরের ঘাটে হুইস্কির বোতল আর বাদামভাজা নিয়ে হাজির। দেখল তার সুখচাঁদদা হাসিমুখে বসে আছে তার দিকে তাকিয়ে। বোতলটা এগিয়ে দিল সুখচাঁদদার দিকে। বলল, আমি আজ একটুও খাব না। শুধু তোমার জন্য ওটা এনেছি। তুমি খাবে আর গান করবে। কতদিন তোমার গান শুনি নি।

হবে হবে সব হবে। আগে তোর দিল্লির জীবনটা বল।

দাদা, দিল্লি মনের মত করে ঘুরেছি। প্রচুর টাকাও কামিয়েছি। মেয়ের বিয়ের জন্য আর আমার চিন্তা নেই । বউ খুব খুশি। তুমি কেমন আছ বলো?

দেখতেই তো পাচ্ছিস। আমি তো সব সময় ভাল থাকি। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ওপরওয়ালা ভরসা। তোর খুশি দেখে আমিও খুব খুশি হয়েছি।

এবার গান ধরো। একটু একটু খাও আর গান গেয়ে যাও। আরে বিলাস, ধেনো পেটে ইংরেজি মালে কি আর ভাল গান বেরোয়? তুই এত কষ্ট করে ঐ মাল এনেছিস। আজ একটু আরাম করে খাই। আমার তো আর কেউ খোঁজ নেয় না রে। তুই তবু আমাকে মনে রেখেছিস।

সেদিন সন্ধ্যায় একটা গানই খুব দরদ দিয়ে গাইল সুখচাঁদ। মান্না দে'র সেই বিখ্যাত গান – "ওগো তোমার শেষ বিচারের আশায় আমি বসে আছি"।

তারপর বিলাস যথারীতি বাড়ি ফিরল রাত ন'টায়। বউ ভাবল অনেকদিন বাদে গ্রামে ফিরেছে তাই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডা মেরেছে।

পরের দিন গরম গরম তেলেভাজা নিয়ে হাজির হল সে কলাবাগের ঘাটে তার প্রিয় সুখচাঁদদার কাছে। আজ আর বলতে হল না কিছু। সুখচাঁদ মাতাল একের পর এক গান গেয়ে যাচ্ছে। আর মাঝে মাঝে তেলেভাজা সাবাড় করছে। নির্জন পুকুরঘাটে নীরব শ্রোতা একা বিলাস। কিভাবে যে রাত দশটা পার হল কে জানে। ঘড়ি দেখে চমকে উঠল বিলাস। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল। সুখচাঁদ তাকে এগিয়ে দিল খানিকটা পথ। বলল, তুমি যে আমার কাছে রোজ আসছ কাউকে বলার দরকার নেই।

কেন দাদা?
মাতালের কাছে কি রোজ রোজ কেউ যায়? নাকি এটা বলার মত কোন কথা?

বাড়িতে ঢুকে দেখল বিলাস, বউ এর মুখভার। একটু হেসে আদর করে বলল, অত রাগ করতে হবে না তোমার। কাল ঘেকে আর রাত হবে না। আসলে গানে এমন মজে গিয়েছিলাম যে সময়জ্ঞান ছিল না।

কোথায় জলসা হচ্ছে? আমাদের নিয়ে গেলে না কেন?

বলছি বলছি। আগে খেতে দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। খেতে খেতে সব বলব।

খাওয়ার মাঝখানে আপনমনে হেসে ফেলল বিলাস। তার হাসি দেখে ওর বউ তো অবাক। বলল, তুমি একা একা ওভাবে হাসছ কেন?

আরে, শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। কি গান না গাইল দাদা আমার। মন ভরে গেল। আগের চেয়ে দাদার গলা যেন আরো সুরেলা আরো মিষ্টি হয়েছে। কলকাতার ভাল সুরকারের নজরে পড়লে দাদার অনেক ক্যাসেট বেরিয়ে যেত নির্ঘাত।

কোন দাদার কথা বলছ সেটা তো বলবে।

আরে তোমার মনে নেই সুখচাঁদ-দার কথা। সবাই থেকে মাতাল বলে ডাকে। ভাবো তো কান্ডটা। /ওকে

ওনাকে তুমি কোথায় পেলে?

কেন? যেখানে পাওয়া যায়। কলাবাগের পুকুরঘাটে।

কি আবোল তাবোল বকছ তুমি?

ঠিকই তো বলছি। এই দু'দিন তো ওর কাছে সময়টা কাটালাম। আজ আবার মাঝপথ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। বলল, গ্রামের কেউ নাকি আর ওর খোঁজ নেয় না।

লোকে কি করে খোঁজ নেবে? তুমি দিল্লি চলে যাবার পর ঐ পুকুরে জলে ডুবে মারা গেছেন উনি। ভয়ে কেউ ওই পুকুরমুখো হয় না। সন্ধ্যার পর তো নয়ই নয়। আর তুমি বলছ তার গান শুনেছ!

সত্যি গো সত্যি। কিন্তু এটা কি করে হয়। ওই ঘাটে গতকাল ন'টা পর্যন্ত আর আজ দশটা পর্যন্ত আড্ডা মেরেছি গল্প করেছি তার গান শুনেছি। অবিকল আগের মতই আছে সুখচাঁদদা। সামনা সামনি বসে গল্প করেছি । একেবারে মানুষের অবয়ব, মানুষের কণ্ঠস্বর।

তুমি বিশ্বাস করছ না যখন পাশের বাড়ির সবাইকে ডাকছি।

ঘুম থেকে উঠে পাড়াপড়শিরা জড় হল বিলাসের বাড়ি। বিলাসের বউ এর কথা সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এইবার বিলাসের গায়ে ভয়ে কাঁটা দেখা দিল। না জেনে এই দুদিন সে ভুতের সঙ্গ করেছে। তাও আবার যে সে নয় জ্যান্ত ভুত।পরেরদিন বিলাস একা গেল দুপুরবেলা সুখচাঁদদার বাড়ি।

কিছু জিগ্যেস করার দরকার হল না। বউদির পরনের থান কাপড় আর শাঁখা পলা বিহীন হাত আর সিদুর ছাড়া সিঁথি সব অকাট্য প্রমাণ দিয়ে দিল। বউদি দুঃখ করে বলল তুমিও কাজে বাইরে গেলে আর তোমার দাদাও ঐ অপঘেটে কলাবাগের সাহেবদের পুকুরে মাতাল অবস্থায় জলে ডুবে মারা গেল। বলে সে কি কান্না বউদির।

বিলাস কোন কথা বলতে পারল না । কান্নার মাঝে বউদি বলল -

তিন চারদিন কোন খোঁজ পাই নি। তারপর খুঁজতে খুঁজতে ঐ পুকুরে ফুলে ঢোল হওয়া ওর পচা লাশ দেখতে পেলুম।

বলে আবার চিল চিৎকার করে কান্না। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মানুষটা মদ খেত ঠিক কথা, কিন্তু অন্য কোন দোষ ছিল না। আমার শিবের মত স্বামী আমাকে ফেলে অকালে চলে গেল।

সময় দিলে শোকও পাথর হয়ে যায়। কান্নাকাটি থামার পরে সে বেরিয়ে আসল ঐ বাড়ি থেকে। ভাবতে লাগল। একি করে হয়? সুখচাঁদদা চাইলে তো তাকে মেরে ফেলতে পারত। তা তো করেনি। লোকের ঘাড়ে যেমন ভুত চাপে তার ঘাড়ে তো চাপতে পারত। তাও তো করে নি।

যা হয় হবে, আজ সন্ধ্যেয় আবার ঐ ঘাটে যাবে সে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এবং সিদ্ধান্তমতই বিলাস ভর সন্ধ্যেয় হাজির পুকুরঘাটে। হাসতে হাসতে আপ্যায়ন করল তাকে সুখচাঁদ মাতাল।

কোন কথা নেই দুজনের মুখে। দুজন দুজনকে দেখছে অপলক দৃষ্টিতে। একজনের মুখে হাসি আর একজন হতভম্ব।

ভয় পাচ্ছিস কেন তুই? আমি কি তোর ক্ষতি করতে পারি? যা শুনেছিস সবই সত্যি। তারপরও যে তুই সাহস করে এখানে আসবি, আমি ভাবতেই পারি নি। তুই যে এখানে আসিস, সেকথা তো তোকে কাউকে বলতে মানা করেছিলাম। তুই তো শুনিস নি। এখন কষ্ট পাচ্ছিস।

আমার মাথায় যে কিছুই ঢুকছে না দাদা?

হো হো করে হেসে উঠল সুখচাঁদ মাতাল। এ তো সেই জীবিত সুখচাঁদের হাসি। এবার সুখচাঁদ মুখ খুলল।

সবাই জানে আমি মদ খেয়ে বেহেড হয়ে জলে পড়ে গেছি, উঠতে পারি নি। ভাল সাঁতারু হয়েও জলে ডুবে মরে গেছি। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় তোর বউদি অনর্ষক মদ আর চাট নিয়ে আমার কাছে আসে। ভাল ভাল অনেক মিষ্টি কথা বলে। তোমার মদ ভাল লাগে বলে আজ এনেছি। তুমি যত পার খাও। আজ আমি বাধা দেব না।

আমি তো হতবাক। এ তো দেখছি ভুতের মুখে রামনাম। তবুও ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে হাসিমুখে বোতলের পর বোতল সাবাড় করতে লাগলুম। চারটে খাওয়ার পর আমার একটু নেশা হয়েছে। ও আর একটা বোতল আমার গলা জড়িয়ে জোর করে খাওয়াল। আমার গলা বুক তীব্র জ্বালায় জ্বলে যেতে লাগল। সাংঘাতিক কষ্ট হচ্ছে তখন। ওকে সব বললাম। ঘাটে নেমে মুখ চোখে জল দিতে বলল ও। ও আরো বলল, এটা খুব কড়া মদ তো, তাই তোমার ওরকম হচ্ছে। জলের ধারে চলো। যেই আমি বুক চেপে টলতে টলতে জলের ধারে গেছি অমনি তোর বউদি এক ধাক্কা মেরে আমাকে জলে ফেলে দিল । হাসতে হাসতে বলল তোকে শেষ খাওয়া খাইয়ে দিলুম।

আঁতকে উঠল বিলাস। বউদি একাজ করল? কিন্তু কেন? নেশার ঘোরে তোমার বুঝতে ভুল হয়নি তো?

আবার সেই দিলখোলা হাসি। ভুল হবার কোন কারণ নেই। শেষ বোতলে কড়া বিষ দেওয়া ছিল। ডাঙায় থাকলেও খানিকবাদে মৃত্যু হত। কিন্তু লোকে বুঝে যেত। তাই তোর বউদি বিষ খাইয়ে জলে ডুবিয়ে মারল। সবাই বিশ্বাস করল সুখচাঁদ মাতাল নেশার ঘোরে জলে কখন পড়ে গেছে আর উঠতে পারে নি। ও নিষ্কলঙ্ক সতী বনেগেল। তিন দিন বাদে ওই আমাকে আবিস্কার করল অন্য কেউ নয়। ধাক্কা মারার ছাপ তিনদিনের ফোলা পচা মড়ার শরীরে পাওয়া মুশকিল।

পোস্টমর্টেম হয়নি?

না। তোর বউদি সতী সেজে এমন পাড়া মাত করা কান্না জুড়ে দিল যে অন্য প্রদেশের রুদালিরা ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না। শুধু বলছে ও অনেক কষ্ট পেয়েছে, আর ওকে কাটা ছেঁড়া করো না। আমি সহ্য করতে পারব না। গ্রামের নেতারা ওর কথা বিশ্বাস করে পোস্টমর্টেম করতে দেয় নি। সঙ্গে সঙ্গে পুড়িয়ে দেয়।

বউদির এ ব্যবহারের কারণ কি?

তুই বড় সাধাসিধে রে বিলাস। সব কথা জানতে নেই। বুঝে নিতে হয়। শুধু একটা কথা বলি ছেলেদুটো ওর মায়ের, আমি ওদের বাবা নই।

মুখ তুলে বিলাস দেখে তার পাশে আর কেউ নেই। চোখের নিমেষে সামনে বসা সুখচাঁদ মাতাল কখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এবার ভয় পেয়ে গেল বিলাস। প্রাণের মায়ায় চোঁ চোঁ দৌড় লাগাল বাড়ির দিকে। একবারও পিছন ফিরে তাকাল না। ওর এই দৌড় দেখলে মিলখা সিংও হয়ত লজ্জা পেয়ে যেত।