সুন্দরবনের কুমির প্রকল্প

সুচিত্র রঞ্জন পুরকাইত,

দঃ ২৪ পরগনা


সুন্দরবন হলো বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত একটি প্রশস্ত বনভূমি যা বিশ্বের প্রাকৃতিক বিস্ময়াবলির অন্যতম। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার কিছু অংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি।

অববাহিকার সমুদ্রমুখী সীমানা এই বনভূমি গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মোহনায় অবস্থিত এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বিস্তৃত। বঙ্গোপসাগরের ৭৫ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত জোয়ার এখানে সবসময়ই দেখতে পাওয়া যায়।

গোটা সুন্দরবনকে জালের মত জড়িয়ে রয়েছে সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদা চর এবং ম্যানগ্রোভ বনভূমির লবণাক্ততাসহ ছোট ছোট দ্বীপ। বনভূমিটি, বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ছাড়াও নানান ধরনের পাখি, চিত্রা হরিণ, লোনা জলের কুমির, কেটো কচ্ছপ, স্বাদু জলের কুমির ও সাপ সহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত।

সুন্দরবন ভ্রমণে সারা বছরই দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। তবে সুন্দরবন ভ্রমণে যে বিশেষ স্থান গুলি পর্যটকদের আকর্ষিত করে থাকে, তাদের মধ্যে অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ভগবৎপুর কুমীর প্রকল্প। ভ্রমণ পিপাসু মানুষদের পাশাপাশি কচিকাচাদের ভিড় লক্ষ করা যায় এই কুমীর প্রকল্প এলাকায়।

ভগবৎপুর কুমীর প্রকল্পের প্রথম সূচনা হয় ১৯৭৬ সালে। প্রথম বছর ৩২ টি কুমিরের ডিম সংগ্রহ করা হয়েছিল ডাবরহানা খাল থেকে। ১৯৮২ সালে প্রথম ভগবৎপুর কুমীর প্রকল্প থেকে কুমীর উৎপাদন করা হয়। কুমীরের কৃত্রিম প্রজননের জন‍্য রয়েছে হ‍্যাচারিও। সুন্দরবনের নোনা জলের কুমীর বিলুপ্তপ্রায় বলে এই কুমিরপ্রকল্পটি করা হয়েছিল। বর্তমানে এখান থেকে কুমির সংগ্রহ করে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কুমীর প্রকল্পটি বর্তমানে সুন্দরবন পর্যটন মানচিত্রে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ঢুকতে কাটতে হবে টিকিট। টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ১০ টাকা।

কলকাতা থেকে মাত্র ১১০ কিলোমিটার এর কিছু বেশি রাস্তা। ভগবৎপুর কুমীর প্রকল্পে আসতে হলে আপনাকে শিয়ালদহ থেকে কাকদ্বীপ স্টেশন আসতে হবে। এরপর, কাকদ্বীপ থেকে আপনাকে বাস এ পৌছাতে হবে পাথরপ্রতিমা। সেখান থেকে আপনি টোটো বা ছোট গাড়িতে পৌঁছে যেতে পারবেন ভগবৎপুর কুমীর প্রকল্পে। সময় লাগবে এক ঘন্টার মত। অথবা আপনি ধর্মতলা থেকে বাস এ নামখানা এসে, নৌকা করে যেতে পারেন কুমীর প্রকল্পে।

কুমীর প্রকল্পে আপনি বড়ো ছোট মাঝারি সমস্ত ধরনের কুমীরই দেখতে পাবেন। বর্তমানে ৪২৭ টি কুমির রয়েছে এই প্রকল্প এলাকায়। তবে ইতিমধ্যেই প্রায় ৫০০টির বেশি কুমীর বিভিন্ন জায়গার খারি এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রকল্প আধিকারিক সূত্রে জানা যায়। কুমীরের ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বের করতে বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেক্ষেত্রে তাপমাত্রা একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। উপযুক্ত তাপমাত্রা হিসেবে ২৭ ডিগ্রি থেকে ৩২ ডিগ্রি, এই পরিমাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে প্রকল্প এলাকায় ডিম ফুটে জন্ম নেয় নতুন কুমীরের বাচ্চা। প্রকল্প এলাকায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে কুমিরের ডিম সহ বিভিন্ন বয়সের মৃত কুমীরের দেহাংশ।

ভ্রমণার্থীরা যাতে সহজেই কুমিরের বিষয়ে জানতে পারেন, তার জন্য বিশদ বিবরণ এর মাধ্যমে বিভিন্ন সাইনবোর্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রকল্প এলাকায়।

কুমীর প্রকল্পের সাথে এখানে ঘূরতে পারেন সুন্দরবনের লোথিয়ান আইল‍্যান্ড। কাছেপিঠের এলাকাগুলিও ঘুরে দেখতে পারেন। সুন্দরবনের মনোরম পরিবেশ খুব একটা মন্দ লাগবে না। একদিনের জন‍্য ম‍্যানগ্রোভ বাদাবনের সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি কুমির দর্শনে, আসতেই পারেন ভগবৎপুর কুমীর প্রকল্পে।