থিমের পূজা
অনিন্দিতা গুড়িয়া,
নিউ-দিল্লি
একবার শিব ঠাকুর আর দুগ্গা মার মধ্যে একটু মন কষাকষি হল, আপন ভোলা বাবা
আর পতিপ্রানা মায়ের মধ্যে যে কি করে এটা সম্ভব হলো তাই একটু গুছিয়ে
বলি।
যতই স্ত্রীরা পতিব্রতা হোক না কেন তবুও বাপের বাড়ির কথা তুললেই তারা
বিরুপ হয়ে যায়। মায়ের ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।
ব্যাপারটা হলো এইরকম- শারদীয়া দুর্গাপূজার ঠিক আগে আগে মা-বাবার কাছে
আবদার করলেন একখানা নতুন গহনার জন্য।
কিন্তু বাবা বললেন,
- গৌরী তাও কি সম্ভব! আমি গরিব মানুষ, এটা তো তোমার চেয়ে ভালো কেউ জানে
না। আমি কোথা থেকে তোমার গহনা গড়িয়ে দেবো!
মা বললেন,
- ওসব আমি বুঝিনা, আমার মা মেনকার মনে বড় দুঃখ। আমি তার দুঃখ কিছুটা
হলেও লাঘব করতে চাই।
- আহা; তাঁর আবার কি হলো! এত দুঃখ করা কেন বাপু? তা তাঁর দুঃখের সঙ্গে এই
গহনার কি সম্পর্ক?
- আমি তোমার ঘরে কতটা সমাদরে, কতটা সুখে আছি তা জানতে তিনি সব সময়
চেষ্টা করেন। আমি তাকে বারবার বলি যে আমার কোন দুঃখ কষ্ট নেই, তবুও তিনি
কিছুতেই মনে শান্তি পান না। তাই তোমার দেওয়া গহনা পরে আমি তাঁকে দেখাবো,
যে তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।
এই কথা শুনে বাবা বেশ অভিমানের সঙ্গে বললেন,
- মায়ের কথা না তুলে তুমি তো সোজা আমাকে বললেই পারতে যে আমার ভালোবাসা
নিয়ে তোমার মনে সংশয় দেখা দিয়েছে!
সঙ্গে সঙ্গে মা এক হাত জিভ কেটে বললেন,
- ছি ছি! তুমি এসব কি বলছ, আমি কখনো তাই বলতে পারি!
বাবা বললেন,
- তোমরা মহিলারা কি পারো আর কি পারো না তা আমার বেশ জানা আছে, আর তার
উপরে গহনার উপর তোমাদের মহিলাদের যে কি পরিমান মায়া মোহ এসব কি আমাদের
অজানা বলতে চাও? তোমাদের যত থাকে তবুও কম। আমি না হয় তোমাকে গহনা দিইনি,
তাই বলে কি গহনা তোমার কিছু কম আছে? বছর বছর তোমার দাদা কাকা মামা মেসো
জেঠু পিসেদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। প্রত্যেক বছর না হলেও কম করে শ-খানেক
নতুন আত্মীয় তোমার গজিয়ে উঠছে।
এবার মা ফোঁস্ করে উঠলেন,
-তাতে তোমার কি? তারা কি তোমার ঘরে পাত পেড়ে খেতে আসছে?
- আহা, অত চোটছো কেন? আমার বলার উদ্দেশ্য হলো, তারা তোমাকে সবাই কিছু না
কিছু নতুন গহনা দেয়, তবুও তোমার আরো গহনা দরকার!
মা বললেন,
- তারা তো বেশিরভাগ হয় রোল গোল্ড নয় তো সিটি গোল্ড দেয়।
এবারে বাবা না হেসে পারলেন না। বললেন,
- তাই বল, তোমার দুঃখটা তাহলে এখানে! আচ্ছা বেশ আমি না হয় একটা গহনা
গড়িয়েই দিলাম। কিন্তু প্রিয়ে তুমি পরবে সে গহনা? এখন না হয় লোকে রোল
গোল্ড, সিটি গোল্ড দেয়, কিন্তু আগের দিনে যেসব গহনা তোমার বাপের বাড়ির
লোকেরা দিয়েছে সে সব কোথায় পর? বাপের বাড়ি গিয়ে সে গহনা তুমি চারটে
দিনের জন্য পর, আবার ফেরার সময় সেসব তুমি সেখানেই রেখেই আসো। এখানে তো
আমারই মতোই ছাই ভস্ম গায়ে মেখে হাতে গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরেই কাটাও।
তবে এতেও তুমি বেশ মানাও।
এবারে মা দুর্গা আর সরে থাকতে পারলেন না, আবেগে আবেশে বাবার বুকে মাথা
রেখে চোখ বুঝলেন, বাবা মায়ের মাথায় হাত বুলাতে বললেন,
-জানো পারো? (বাবা-মাকে আদর করে এই নামেই ডাকেন) আজকালকার স্যাকরারা কি
ধড়িবাজ। একে তো সোনার দাম লাখ ছুঁই ছুঁই । তার ওপরে গহনার মজুরি ও এত
বাড়িয়ে দিয়েছে আর খাদের পরিমাণও এত বেশি, ব্যাটারা এক নম্বরের
জোচ্চোর। যেমন তেমন একটা গয়না গড়াতে গেলেও কম করে লাখখানেক তো লাগবেই।
লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
- এইতো আমার অবস্থা! এই মাগনার বাজারে কোথা থেকে যে এতগুলো টাকা জোগাড়
করি.......
এবার মা ছিলা ছেঁড়া ধনুকের মতো ছিটকে উঠলেন,
- তোমার কাছে টাকাটাই বড়, একবারও ভাবলেনা- আহা! বেচারী এতগুলো বছর আমার
কাছে কিছুই চাইনি এখন যা হোক আবদার করছে যেখান থেকে পারি ওর আবদার টা
মেটানোর চেষ্টা করি! তা নয় এখন লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজের দুঃখ
কাহিনী শোনানো হচ্ছে।
ইতিমধ্যে হইচই করতে করতে লক্ষ্মী সরস্বতী এসে হাজির। তাদের হাতে বেশ কিছু
নতুন পোশাক।
লক্ষ্মী বললে,
- মা দেখো সতু (সরস্বতীকে লক্ষী ওই নামেই ডাকে) টা কি বোকা, বলে কি না
যুববৃন্দ ক্লাব পূজা সমিতি থেকে যে শাড়ি গহনা দিয়েছে এবারে সেটাই পরে
যাবে। আমি বলি কি মা, ইয়ংস্টার পূজা কমিটির শাড়ি গহনা বেশ ভালো।
একেবারে লেটেস্ট আর আমাদেরকে বেশ মানাবে, তাই না মা?
সরস্বতী বলেন,
- আমাকে বোকা বলিস, নিজে একটা হাঁদা। নিউ ফ্যাশন কাকে বলে জানিস? বেশ
ছিমছাম হালকা ড্রেস আর গহনা পর তাতেই বেশি স্মার্ট দেখায়। আমি তো দিন
রাত ম্যাগাজিন আর ইন্টারনেটে হাল ফ্যাশনের ডিজাইনারদের কথা পড়ছি, তবেই
তো সব জানি। তুই এসব জানবি কি করে, থাকিস তো কেবল টাকা পয়সা গয়নাগাটি
আর ধান চাল ঘর গৃহস্থি নিয়ে। আমি যা বলি তাই কর।
ইতিমধ্যে কার্তিক গণেশ এসে হাজির।
এসেই গণেশ বললে,
- মা কেতুটা বলে ক্যাপ্ট্রি পরে যাবে। তুমিই বলো মা, পঞ্চানন তলা জোড়া
মন্দির পূজা সমিতি থেকে যে শেরওয়ানি দিয়েছে সেটা খারাপ কিসে? বেশ
ঢিলেঢালা আর আরামদায়ক। আর তাছাড়া আমার এই নাদুস নুদুস চেহারায় কি ওই
ক্যাপ্ট্রি মানায়? উনিতো মেজে ঘষে জিম করে নিজের শরীরটা ঠিকঠাক রেখেছেন,
যা পরেন তাতেই মানায়। কিন্তু আমারটা তো ভেবে দেখবে, এত সেলফিস হলে কি
চলে!
কার্তিক কিছু বলতে যাচ্ছিল; পিছন থেকে দৌড়ে ঘরে ঢুকলো মহিষাসুর। ঘামে
জবজবে পুরো শরীর। এ বোধহয় কোসরত করতে করতে দৌড়ে এসেছে ।
বলে,
- মা এই আধখানা টেনা আর বুক খোলা জ্যাকেট পরে আমি আর যেতে পারব না, আমার
ভীষণ লজ্জকরে। ছোট ছোট বাচ্চারাও আমার থেকে ভালো পোশাক পরে ঘোরে। আর তার
ওপরে আজকাল প্যান্ডেলে এত মেয়ে বৌদের ভিড়। তোমরা সবাই কেমন সুন্দর জামা
কাপড় পড়ে যাও, অসুর বলে কি আমার কোন প্রেস্টিজ বলে কিছু নেই!
পুজো কমিটির বাবুদের বলো আমার জন্য যেন এবার কোট-প্যান্ট টাই পাঠায়।
এইসব দেখে শুনে শিব ঠাকুর তথা মা দুর্গা উঠলেন তেলে বেগুনে জ্বলে। মা
বললেন,
- কৈলাসে নিজের ঘরে যার যা আছে তাই পরে যদি সবাই যেতে চাও তবেই আমার
সঙ্গে এসো নইলে নয়।
মায়ের ভাব গতিক ভালো নয় দেখে সবাই সুড়সুড় করে কেটে পড়ল।
এমন সময় নন্দী এসে প্রণাম করে দাঁড়ালো। আর বলল,
- মা মর্ত্য থেকে তোমার জন্য থেকে দোলা পাঠিয়েছে তোমায় নিয়ে যেতে।
চার সন্তান আর মহিষাসুরকে সঙ্গে নিয়ে মা চলেছেন বাপের ঘরে। অন্যান্য
বছরের মত না তো দুর্গা মহাদেব কে সাধলেন আর না বললেন 'আসছি'।
শঙ্করও কোন উচ্চবাচ্য করলেন না।
খালি দুর্গা যখন সদর দরজা দিয়ে বেরোচ্ছেন তখন একবার নন্দীকে হেঁকে
বললেন,
- যাও তোমার মাকে মামার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এসো।
নন্দিও- যথা আজ্ঞা বলে বেরিয়ে পড়ল।
লক্ষ্মী সরস্বতী কার্তিক গণেশ তাদের সব বাহানেরা মহিষাসুর আর নন্দী
পর্যন্ত হইচই করতে করতে চলেছে।
কিন্তু মা একেবারে শান্ত। মনে মনে তার হাজার ঝড় বয়ে চলেছে। সব জানা
সত্ত্বেও অনেক কটু কথা শুনিয়েছে স্বামীকে, তাই মনে মনে ভীষণ অনুতপ্ত।
তাঁর সঙ্গে যে দু'দণ্ড কথা বলে ক্ষমা চাইবেন তার কি জো আছে! একতো বাপের
বাড়ি থেকে দোলা এসে হাজির হলো তার উপরে ইগো তো আছে একটু ।
কৈলাস থেকে বেরোনোর পরে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে, মনের রাগটাও অনেকটা
প্রশমিত হয়েছে মায়ের। আর তখনই তিনি শিব ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলার জন্য
নিজের ব্যাগে হাত দিয়ে দেখেন - এই যাহ্, রাগের চোটে নিজের মোবাইলটাই তো
আনতে ভুলে গেছেন। এখন বাচ্চাদের থেকে মোবাইল চেয়ে স্বামীর সঙ্গে কথা
বলবেন সে বড় লজ্জাস্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। তাই তিনি চুপিচুপি একটা
কাগজে 'SORRY' লিখে নন্দী কে দিয়ে বললেন যেন বাবাকেই দেওয়া হয়।
মা দুর্গা যেমনই মর্তে প্রবেশ করলেন অমনি শুরু হল ঝড়-ঝঞ্ঝা মহাপ্রলয়।
মা তো যেমন তেমন করে বাচ্চা-কাচ্চা সমেত সামনের একটা প্যান্ডেলে ঠাঁই
পেলেন।
যথাক্রমে পুজোর দুটো দিন কেটে গেছে, কিন্তু না তো নন্দির দেখা আছে আর না
তো পার্বতীর কোন খবর পাচ্ছেন মহেশ্বর। তিনি কৈলাসে বসে দিব্য দৃষ্টি
দিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টিতে সব কেমন ধোঁয়া
ধোঁয়া। স্ক্রিনে বারবার নো ফ্রিকোয়েন্সি নট এভেলেবেল লেখা আসছে।
আর স্হীর থাকতে পারলেন না তিনি, ভৃঙ্গিকে সাথে নিয়ে সূক্ষ্ম শরিরে তিনি
ধরাধামে নেমে এলেন। ততক্ষণে ঝড়-বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। রাস্তায় রাস্তায়
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মানুষের ঢল নেমেছে। মহাদেব আর ভৃঙ্গীও মিশে গেলেন
সেই ভিড়ে, তবে অবশ্যই ভেশ বদল করে।
প্রথমেই ঢুকলেন জোড়া বটতলা দুর্গাপূজা প্রাঙ্গণে। সেখানে প্রচন্ড ভিড়ে
চাপাচাপি গাদাগাদি করে নিজের মস্ত ভুঁড়িটাকে সামলে গলদঘর্ম হয়ে কোন
রকমে মূল প্যান্ডেলে গিয়ে হাজির হলেন। কিন্তু তিনি খুঁজে পেলেন না
পার্বতী বা অন্য কাউকে। কারণ অন্যান্য বারের চাইতে এবারের ব্যাপারটা বেশ
গড়বড়ে মনে হলো। কিন্তু লোকে বেশ প্রশংসা করছে। ভালো করে কান পেতে
লোকেদের কথা শুনে তিনি বুঝতে পারলেন এবারে এটা নাকি 'থিমের পূজা'।
এবার ভৃঙ্গী আঙুল নির্দেশ করে বললে,
- বাবা ওই দেখুন ওইখানে কি সব যেনো দেখছে লোকে, চলুন আমরা এগিয়ে যাই হতে
পারে ওখানে মায়ের দেখা পাব।
যেমন ভাবা তেমন কাজ, তারাও পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু যা দেখল তাতে
তাদের দাঁত কপাটি লাগার জোগাড়।
বাচ্চারা মায় মহিষাসুর এবং পার্বতী পর্যন্ত কি সাজে মর্ত্যে আসতে
চেয়েছিল আর এখানে কি সাজে আছে! এরা নন্দীকেও ছাড়েনি, তার ও নাকে দড়ি
দিয়ে গাড়ি টানাচ্ছে। গণেশ সেই গাড়ির চালক আর কার্তিক তার হেলপার।
দুজনেরই গায়েই পাতলা ফতুয়া আর পাঁচ হাতি ধুতি মাল কোচা করে পরানো।
লগি ঠেলে খড় বোঝাই নৌকা নিয়ে আসছে লক্ষী, পরনে গাছ কোমর করে একটা মোটা
ডুরে শাড়ি।
সরস্বতীকে নামিয়ে দিয়েছে একটা এঁদো ডোবায় সাঁতার কাটতে।
মহিষাসুরকে বসিয়েছে পথের ধারে একখানা ছেঁড়া গামছা জড়িয়ে, হাতে একটা
মাটির সরা। সে ভিক্ষা করছে!
ঘুরতে ঘুরতে শঙ্করকর যখন পার্বতীকে দেখতে পেলেন তখন তিঁনি আর তাঁর চোখের
জল ধরে রাখতে পারলেন না।
দেখলেন তাঁরর প্রাণপ্রিয়া প্রেয়সী পার্বতী কে আলু বেগুন পটল নানা
জিনিসের দোকানী মাসির মত উপুড় করা একটা ঝুড়ির উপর বসে বিক্রি বাটা
করছেন। কারো অঙ্গে একটাও অলংকারের চিহ্নমাত্র নেই।
মহাদেব নিঃশব্দে বেরিয়ে এলেন প্যান্ডেল থেকে। এইরকম পূজা দেখে লোকে
যারপরনায় উচ্ছেসিত কেন তা বুঝে উঠতে পারলেন না।
বারবার মাইকের অ্যানাউন্স শুনে বুঝলেন এবারের থিম রবি ঠাকুরের 'হাট'!
শিব ঠাকুর ভৃঙ্গিকে জিজ্ঞেস করলেন,
- হ্যাঁরে ভৃঙ্গি, এই থিমের পুজোটা কি রে! তুই কি কিছু জানিস? আর এই রবি
ঠাকুরের হাটটাই বা কি?
ভৃঙ্গি বলল,
- বাবা আমি তো সে সবকিছু জানি না, ওই যে ওইখানটায় একটা বেশ বড় কাগজ
টাঙানো আছে। আর তাতে কি যেন লেখা আছে, চলুন না একটু এগিয়ে এগিয়ে পড়ে
দেখি কি লেখা আছে!
থিমটা রবি ঠাকুরের হাট হলেও যেভাবে পূজা কমিটির সদস্যরা সাজিয়েছে তা যেন
-

"কৈলাস পাড়ার নন্দির গাড়ি
থিমের হাট বেশ ভারী।
গাড়ি চালায় গণেশ মুসিক
সঙ্গে যায় ময়ূর কার্তিক।
জিনিসপত্র জুটিয়ে এনে
দুগ্গা মা বেচে কেনে।
খড়ের আঁটি নৌকা বেয়ে
আনল ঘাটে লক্ষী মেয়ে।
মহিষাসুর পথের ধারে
গামছা পরে ভিক্ষে করে।
সরস্বতী ডোবার ঘাটে
ডুব দেয় আর সাঁতার কাটে।। "

নন্দী কেন ফিরছিল না আর কেনই বা পার্বতীর কোন খবর তিনি পাননি এখন তার
কাছে সবই স্পষ্ট। তিনি ভৃঙ্গিকে সাথে করে ফিরে গেলেন কৈলাসে।
এরপর পূজা সমাপ্তে দশমীর দিন মা দুর্গা মহিষাসুর বাচ্চারা এবং তাদের
বাহনেরা সবাই ফিরে এলো নিজের ঘরে কৈলাসে।
কার্তিক খুব হাঁচছে দেখে শীবঠাকুর জিজ্ঞাসা করলেন,
- কি হল আবার?
কার্তিক বললেন,
- দেখো না বাবা, নারায়ণ তলার পুজো প্যান্ডেলে আমাদের গড়েছে লঙ্কা
দিয়ে। একটা ছেঁড়া শুকনো লঙ্কা পড়বি তো পড়, একেবারে পড়েছিল আমার
নাকের কাছেই। ব্যাস ওমনি লঙ্কার ঝাঁজ ঢুকে গিয়েই আমার এই বিপত্তি!
মা দুর্গার হাত রীতিমতো ফুলে গেছে। জিজ্ঞেস করাতে বললেন,
- মর্তলোকের মেয়েরা নাকি আজকাল দুর্গা দশ ভূজা! তাই তারা যা কাজ করে
আমার দশ হাত দিয়েই এইবারে সেইসব জিনিস লোককে দেখিয়েছে।
আমার দশ হাতের অস্ত্রের পরিবর্তে ছিল হাতা খুন্তি গাড়ির চাবি কলম মোবাইল
ল্যাপটপ বাচ্চার দশ মনি ভারি স্কুলের ব্যাগ টিফিন জলের বোতল আর ছিল মেকআপ
বক্স আর মেকআপ ব্রাশ।
লক্ষ্মী সরস্বতী তাদের পায়ে ভলিনি জেল লাগাচ্ছে আর উহ্ আহ্ করছে। বাবা
কারণ জানতে চাইলে জানালো যে স্টুডিও পাড়ায় তাদের পায়ে 6 ইঞ্চি পেন্সিল
হিলের জুতো পরিয়ে রেম্প ওয়াক করিয়েছে পূজা কমিটির লোকেরা।
আর সবার চেয়ে অবস্থা খারাপ মহিষাসুরের। তার সারা গায়ে লাল লাল চাকা
চাকা, ঠোঁট রীতিমতো ফুটি ফাটা সামনের একটা দাঁতও ভেঙে গিয়েছে। সে জানালো
মিষ্টি পট্টির লোকেরা সব রকমের মিষ্টি দিয়ে মূর্তি গড়েছিল। তারা
মহিষাসুরকে গড়েছিল রাজ্যের রসালো মিষ্টি দিয়ে। আর তাতেই যত পিঁপড়ে তার
গায়ে পায়ে পিঠে চড়ে খুবলে খেয়েছে।
শুধু কি তাই! জানো বাবা, ভাসানের দিন সিঁদুর খেলার সময় লোকেরা আমার
সঙ্গে কি ব্যবহার করেছে? সবাই মিলে আমার মুখে এমন কি নাকের ভেতরে পর্যন্ত
মিষ্টি ঠেসে ঠুসে ঢুকিয়েছে আর পরে সেই মিষ্টির মধ্যে ধূপের কাঠি গুঁজে
ধূপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। উফ্ ধুপের ধোঁয়া, জ্বলা ধূপের তাপ আর ওই কাঠির
খোচায় আমার ঠোঁটের আর দাঁতের অবস্থা দেখো কি সঙ্গীন হয়েছে!
বলেই মহিষাসুর ছোট বাচ্চার মতন ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল। শিব ঠাকুর
তাকিয়ে দেখলেন সত্যিই মহিষাসুরের সাথে বড় বেশি দূর্ব্যবহার করেছে
মর্তবাসিরা।
নন্দীর কথা তো আগেই বলেছি,
সে কৈলাসে বাবার সাথে সাথে থাকে, কখনো কখনো বাবাকে পিঠে নিয়ে একটু আধটু
এদিক-ওদিক যায়। তাতে তার খুব বেশি পরিশ্রম করতে হয় না। অনেকদিন পরিশ্রম
না ক'রে ক'রে তার অভ্যাস ছেড়ে গেছিল। কিন্তু মর্তবাসি পূজা প্যান্ডেলের
লোকেরা তাকে দিয়ে গাড়ি টানিয়ে তার শরীরের অবস্থা এতটাই খারাপ করেছে যে
তাকে হসপিটালে ভর্তি করতে হয়েছে।
গণেশ কে দেখতে পেয়ে মহাদেবে কাছে ডেকে আদর করে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন তার চেহারা এত খারাপ হলো কি করে? এমন সুপুষ্ট ভুঁড়িটাইবা
অমন চুপসে গেল কি করে!
এবার গণেশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেলল। বলল,
- মর্তবাসিরা খুব নিষ্ঠুর, লাখ লাখ টাকা প্যান্ডেলে লাইটিং এ খরচ করেছে
কিন্তু চার দিনের নৈবেদ্যের জন্য ৪০টা টাকাও খরচা করেনি। এক মুঠো আতপ চাল
আর দুটো বাতাসা খেয়ে কি আর চারটে দিন থাকা যায়? তাই তো এমন দশা!
সবাইয়ের সব শুনে দেখে মহাদেব বললেন যাও সবাই নিজের নিজের ঘরে আর নিজেদের
মনের মতো করে থাকো খাও আনন্দ করো।
তোমরাও তো কারণে অকারণে লোকেদের কম পুতুল নাচ করাও না তাই সুযোগ পেয়ে
তারাই বা ছেড়ে দেয় কি করে!
এরপর আর কথা চলে না, যে যার ঘরে যাওয়ার আগে ভৃঙ্গি এসে খবর দিল যে
নন্দীর অবস্থার উন্নতি হয়েছে, দুই এক দিনে তাকেও হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ
দেওয়া হবে হয়তো। আর সেই সঙ্গে বাবার হাতে দিয়ে গেল নন্দীর থেকে আনা
মায়ের SORRY লেখা কাগজটা।
সবাই ঘর থেকে চলে গেলে শিব এগিয়ে গেলেন দুর্গার দিকে। বললেন,
- প্রিয়ে আজ আমার এক ভক্ত আমাকে একটা পার্সেল পাঠিয়েছে, তাতে একটা
কুন্দ ফুলের মালা আর এক পুরিয়া গঞ্জিকা আছে। মালাটা তুমি পরো আর বাকিটা
আমি নিই।
মা সপ্রেম দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালে বাবা নিজের হাতে মালাটি মায়ের
গলায় পরিয়ে দিলেন এবং মা সাগ্রহে হাসিমুখে সেটি গ্রহণ করলেন।
কৈলাসে আবার শান্তি ফিরে এলো।।