তীরে ফেরা ঢেউ (পর্ব- ২)

অনিন্দিতা গুড়িয়া,

নিউ-দিল্লি


পূর্ববর্তী অংশটি পড়ার জন্য লাইব্রেরি বিভাগে দেখুন...

এই শোরগোল, এই হকারের চিৎকার, এই স্টেশন, উর্মীর বড় পরিচিত! বড় আপন ছিল একসময়! কত মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই স্টেশন কে ঘিরে। এক সময় উর্মি এখানেই ওর মাস্টার্স করার জন্য এসেছিল।

মনে পড়ে যাচ্ছে ইউনিভার্সিটির সেই দিনগুলোর কথা। মনে পড়ছে চারু প্রীতি সুজাতা গণেশ সাহিল সত্যেন্দ্র বাবলু মেঘা এবং আরো অনেকের সাথে আরও একজনের নাম অর্ণব চৌধুরী।

অর্ণব ছাড়া বাকি সকলেই উর্মির ক্লাসমেট ছিল। উর্মিরা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এর স্টুডেন্ট আর অর্ণব ছিল মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট এর স্টুডেন্ট। তা বলে অর্ণব ডাক্তারি পড়তে আসেনি ইউনিভার্সিটিতে। অর্ণব ফার্মাসিউটিক্যাল নিয়ে পড়ছিল। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে, ক্ষমতা বা মেধা কোনটাই অর্ণবের ছিল না। তার ওপর ইউনিভার্সিটিতে সক্রিয়ভাবে স্টুডেন্ট রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল অর্ণব, যার জন্য ইউনিভার্সিটি পাস আউট হতেও ওর সময় লাগছিল।

অর্ণব ছিল রেল কোয়ার্টারে থাকা রেলের ডি ক্লাস কর্মচারীর মা মরা তিন সন্তানের একজন, খুব সাধারণ ছেলে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে উর্মি ছিল মায়ের একমাত্র আদরের এবং ইউনিভার্সিটির ব্রাইট স্টুডেন্ট। অর্ণব চৌধুরী নামটা শুনতে বাঙ্গালীদের মতন হলেও অর্ণব কিন্তু আদপেই বাঙালি ছিল না। অর্ণবরা ছিল ইউপির বাসিন্দা। ওর দাদা পরদাদা নানা পরনানা দাদিহাল নানিহাল সবকিছুই ইউপিতেই।

অর্ণবের একটাই দিদি অনিতা, বিয়ে হয়েছে ওদের গ্রামের দিকে। তাও প্রায় এখান থেকে আড়াইশ কিলোমিটারের ব্যবধান । আর অর্ণবের ছোট ভাই অমিত এখন স্কুলেই পড়ে। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, আর বাবা অফিস করে, তার জন্য সংসারের সমস্ত কাজ রান্নাবান্না সবকিছুই অর্ণব করতে পারে। না পারলে চলবে কেন!

অর্ণবের আবার গাছপালার খুব শখ। ওদের ছোট্ট দু কামরার রেল কোয়ার্টারের সামনে আর পেছনে যে এক ফালি করে খালি জমি আছে সেখানে সে তার নিজের হাতে বেশ কিছু বাহারি ফুল গাছের চারা লাগিয়েছে। যখন সেগুলো ফুলে ফুলে ভরে থাকে তাদের এই ছোট্ট কোয়ার্টারটা দেখতে একেবারে অন্যরকম লাগে।

উর্মি আর অর্ণব আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টের হলেও ওদের মধ্যে দেখা হওয়া এবং বন্ধুত্ব হওয়ার বেশ একটা ইন্টারেস্টিং গল্প আছে। উর্মি যখন প্রথম ইউনিভার্সিটি তে পড়তে এলো তখন ওর বাংলা বা ইংরেজি ভাষাটা অনেক সাবলীল থাকলেও স্থানীয় ভাষাটা সেরকম ভাবে রপ্ত ছিল না । তাই স্থানীয় কিছু ছেলে মেয়ের ট্রোলের মুখে পড়েছিল উর্মি। আর সেখান থেকেই প্রথমবার ওকে উদ্ধার করেছিল ইউনিভারসিটির স্টুডেন্ট ইউনিয়নের দাদা অর্ণব। সেই প্রথম দেখা, তবে আলাপ পরিচয় সেভাবে হয়ে ওঠেনি ।

এরপর দ্বিতীয়বার দেখা হয় ইউনিভার্সিটির অ্যানুয়াল ফেস্ট এর সময়। অর্ণবের উপর পড়েছিল কালচারাল প্রোগ্রামের দায়িত্ব। গান গাওয়ার জন্য উর্মি নাম লিখিয়েছিল। এদিকে প্রোগ্রাম লিস্ট অনেক লম্বা হয়ে যাওয়ায় এবং সময়ের অভাবে অনুষ্ঠান থেকে উর্মির নামটা বাদ দিয়ে দেয় অর্ণব। এই বাদ দেয়ার ব্যাপারটা উর্মির জানা ছিল না, ফেস্টের দিন সে বেশ সাজুগুজু করে মাথায় ফুল টুল লাগিয়ে উপস্থিত।

গ্রীন রুমে পৌঁছে দেখলে বেশ চাপা একটা উত্তেজনা চলছে সবার মধ্যে । চিফ গেস্ট এসে পড়ল বলে, কিন্তু যে মেয়েটাকে গেস্ট কে ওয়েলকাম জানানোর জন্য তৈরি হয়ে আসতে বলা হয়েছিল সে এসে পৌঁছায়নি তখনও। অনুষ্ঠানসূচী হাতে ঘুরতে থাকা ছেলেটার কাছে গিয়ে উর্মি জানতে চাইলো যে তার গানটা কোন সময় আছে, কিন্তু লিস্টে উর্মি তার নাম খুঁজে পেল না। পরে শুনলো যে অর্ণব নামের ছেলেটি যার উপর পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব ছিল সে উর্মির নাম অনুষ্ঠান থেকে বাদ দিয়েছে।

উর্মী অপমানিত বোধ করে এবং ভীষণ রেগে প্রায় দৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছিল, এদিকে সেই সময়ই চিপ গেস্ট আসার অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গিয়েছে। উর্মি হঠাৎই হাতে একটা হেঁচকা টান অনুভব করে, দেখে একটি দোহারা চেহারার লম্বা ছেলে ওকে ধরে স্টেজের দিকে তুলে দিচ্ছে আর ফিসফিসিয়ে কানে কানে বলছে -"যাও যাও মহামান্য অতিথিকে বরণ করে নাও "

উর্মি দেখলো, আরে এ তো সেই ছেলেটা যে ইউনিভার্সিটি শুরুর দিকে স্থানীয় ছেলেমেয়েদের ট্রল হওয়ার হাত থেকে ওকে বাঁচিয়ে ছিল । তখনও অবশ্য উর্মি জানেনা যে এই ছেলেটাই অর্ণব, যে ওর নামটা বাদ দিয়েছে অনুষ্ঠান থেকে।

অর্ণবের ধাক্কায় উর্মি তখন প্রায় স্টেজের উপর পৌঁছে গিয়েছে, মুখে রঙীন আলোর ঝলক পড়াতে কোনক্রমে মুখে হাসি এনে ফুলের বুকে তুলে দিল চিফ গেস্টের হাতে এবং সহাস্যে ওয়েলকাম জানালো গেস্টদেরকে। স্টেজ থেকে নেমে আসার সময় হঠাৎ অর্ণব বলে কেউ ডাকতে ওই ছেলেটি যখন রেসপন্স করল তখনই উর্মি বুঝতে পারল যে অর্ণব আর অন্য কেউ নয় ওই ছেলেটি স্বয়ং।

ভীষণ রাগ হয়েছে উর্মীর, অর্ণবের পাশ থেকে যাওয়ার সময় দাঁতে দাঁত চেপে ঘসখসে আওয়াজে বলেছিল -"কাজটা কিন্তু ভালো হলো না, আমার নামটা কেটে বাদ দেওয়া হল অনুষ্ঠান থেকে অথচ সেই আমিই না হলে অনুষ্ঠানটা উদ্ধারই হলো না।"

অর্ণব কেমন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে ছিল উর্মীর দিকে। উর্মির টানা টানা আয়ত উজ্জ্বল দুটি চোখে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল অর্ণব। উর্মি আরো কিছু বলছিল কিন্তু অর্ণবের কানে যেন সে সব কিছু ঢুকছিলই না সে কেমন মহগ্রস্থের মত উর্মীর রাগত চোখের দিকে তাকিয়েই ছিল।

কলেজের অনেক মেয়েই অর্ণবের আগে পিছে ঘুরঘুর করে অর্ণব সেটা বেশ ভালই বোঝে। কিন্তু কাউকেই পাত্তা দেয় না ও। নিজের চারদিকে একটা গম্ভীর পরীখা তৈরি করে রেখেছিল এতদিন। কিন্তু আজ ওর একি হলো! এই মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। অর্ণব বুঝতে পারল না ওর এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ।

অর্ণবের খাওয়া ঘুম সব উড়ে গিয়েছে। ইউনিয়নে বক্তৃতা দিতে গিয়ে এমন সুবক্তা অর্ণবের সমস্ত যেন খেই হারিয়ে যাচ্ছে। কি বলতে কি বলছে নিজেই বুঝতে পারছে না। সব যেন কেমন গুলিয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। অর্ণব বুঝলো এটা লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট । মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে হবে ।কিন্তু এত বড় ইউনিভার্সিটিতে নামধাম জানা নেই, কোন ডিপার্টমেন্ট জানা নেই, খুজবে কি করে ?

কিন্তু এ তো আর অন্য আর সাধারণ পাঁচটা ছাত্রের মত নয় এ হচ্ছে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের দাদা অর্ণব।

খুব বেশি সময় লাগলো না, বড়জোর এক সপ্তাহ। তার মধ্যেই অর্ণব খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলো মেয়েটার নাম উর্মি, সে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে মাস্টার্স করছে। ব্যাস আর যায় কোথায় ? আর অর্নবকে ধরে কে ? এরপর অর্ণব নানান অজুহাতে নানান আছিলায় ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট এ রেগুলার যাতায়াত শুরু করলো। এ নিয়ে কেউ খুব একটা মাথা ঘামালো না, কারণ অর্ণব ছাত্র রাজনীতি করে। যেকোনো ডিপার্টমেন্টেই তার অবাধ যাতায়াত।

কিন্তু উর্মিকে আর পায়না, পাবে কোথা থেকে? সে তো নিজের পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত। সে ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ সচেতন। এরপর একদিন অর্ণব ঊর্মিকে কলেজ ক্যান্টিনে সামনাসামনি দেখতে পায় কিন্তু উর্মীর সঙ্গে চোখাচোখি হওয়াতে উর্মির সেই পুরনো রাগ আবার মনের ভেতরে জেগে ওঠে এবং এমনভাবে অর্ণবের দিকে তাকায় যেন নিজের চোখের দৃষ্টি দিয়ে অর্ণবকে ভস্ম করে দিতে চায়। কিন্তু বেচারা অর্ণব সে তো ভস্ম অনেক আগেই হয়ে গিয়েছে এখন সে বিহ্বলের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মোমের মতন গলে যাচ্ছে গলে যাচ্ছে আর গলে যাচ্ছে। অর্ণবের অবস্থা দেখে উর্মীর বন্ধুরা অনেকেই অর্ণবের ভেতরের অবস্থাটা বুঝতে পেরেছে। উর্মিকে সে কথা বলাতে উর্মি কারোর কথা পাত্তাই দেয় না। উল্টে রাগ দেখিয়ে ক্যান্টিন থেকে না খেয়ে বেরিয়ে পড়ে।

উর্মি বেরিয়ে যেতেই অর্ণবের চমক ভাঙ্গে, দেখে উর্মির প্লেটে পুরো খাবারই পড়ে আছে। ভীষণ অপরাধবোধ হতে থাকে অর্নবের । মনে মনে ভাবে ইস আমি এমন একটা গর্ধব যে আমার জন্য বেচারী উর্মিটার খাওয়াও জুটলো না। নাহ্ এভাবে চলবে না, সরাসরি উর্মির সামনে গিয়ে ওকে প্রেমের প্রস্তাবটা দিতেই হবে।

কিন্তু নানান কারণে উর্মিকে প্রস্তাবটা আর দেওয়া হয়ে ওঠে না অর্ণবের।

কেটে গেছে বেশ কয়েকটি মাস। এখন অর্ণব দের বাড়িতে খুশির বন্যা বইছে। অনেক বছর বাদে অর্ণবের দিদির বাচ্চা হয়েছে, তার উপরে ছেলে । মা নেই সেই জন্য ওর দিদির শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ওর দিদিকে বাচ্চা হওয়ার জন্য ওদের বাড়িতে আসতে দেয়নি। আর এলেই বা কে দেখাশোনা করত? এসব কাজের জন্য অন্তত একজন মহিলার দরকার হয়, আর বাড়িতে তো ওরা তিন তিনটে পুরুষ মানুষ। কোনক্রমে নিজেদের কাজ নিজেরা সেরে নেয় ওরা। তারপরে নতুন মা আর বাচ্চার সেবা-শুশ্রষা করা ওদের দ্বারা হবে না, সম্ভব ও নয়। তাই জামাইবাবু বাবার অফিসে ফোন করে খবরটা দিতেই অর্ণবের বাবা আর ভাই রেডি হয়ে যায় ওর দিদির বাড়িতে যাওয়ার জন্য। আগেই বলেছি ওর দিদির বাড়ি ওদের পৈত্রিক গ্রামের বাড়ির দিকে আর কয়েক দিনের মধ্যেই ওদের গ্রামেও একটি বিয়ের নিমন্ত্রণ আছে ওদের। সামনেই অর্ণবের পরীক্ষা আর তার পাশাপাশি রাজনীতির মহড়া ও চলছে জোর কদমে। ইউনিভার্সিটিতে ভোট আছে। তো সেই সব কারণে অর্ণবের আর দিদির বাড়িতে যাওয়া হয়ে ওঠেনা। অর্ণবের বাবা আর ভাইয়ের ওর দিদির বাড়িতে বাচ্চার নামকরণের অনুষ্ঠান আর ওদের গ্রামে বিয়ে সেরে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় দিন পনেরো লেগে যাবে। রওয়ানা হবার আগে অর্ণবের বাবা বারবার করে ওকে বলে যান যে ও যেন নিজের স্বাস্থ্যের প্রতী বিশেষ খেয়াল রাখে। রাজনীতির মিটিং মিছিল করতে গিয়ে বা পরীক্ষার পড়া করতে গিয়ে নিজের খাওয়া-দাওয়া তে যেন ব্যাঘাত না ঘটায়। পেট খালি থাকলে খুব সহজেই রোগ শরীরে বাসা বাঁধে। আশেপাশে ভীষণভাবে রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে, প্রায় ঘরে ঘরে মাতা (পক্স) হচ্ছে । সেই জন্য ওঁর ভীষণ চিন্তা লেগে থাকবে। অর্ণব ওর বাবাকে আশ্বস্ত করে ট্রেনে চড়িয়ে দিদির বাড়িতে রওনা করিয়ে দেয়।

কেটে গেছে দুটো দিন । অর্ণবের ব্যস্ততার সীমা পরিসীমা নেই। মিটিং মিছিল করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ও সারা ক্যাম্পাস জুড়ে। কদিন উর্মীর খবর নেওয়ার সময় পর্যন্ত পায়নি ও। যদিও উর্মির সাথে ওর সরাসরি কথা হয় না, তবে উর্মীর বন্ধুদের মারফত ও খোঁজ খবর ঠিক পেয়েই যায় । সেদিন উর্মীর এক বন্ধু চারু হাঁপাতে হাঁপাতে এসে অর্ণবকে বলল যে উর্মীকে হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্ট হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে যেতে বলেছেন। এমন খবর শুনে অর্ণব তো ভীষণ অবাক। এ আবার কেমন কথা! উর্মি পড়াশোনায় খুব ভালো তার উপরে খুব ভালো ডিসিপ্লিন মেন্টেইন করে। ওর জন্য তো হোস্টেল থেকে চলে যাওয়ার মতন কোন ঘটনা হওয়া উচিত না! তবে হলো কি? ব্যাপারটা দেখার জন্য ও হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের ঘরের সামনে যায়। সুপারিনটেনডেন্টের সাথে কথা বলে বুঝতে পারে যে উর্মীর পক্স হয়েছে আর সেই পক্স যাতে অন্য কোন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য সুপারিনটেনডেন্ট উর্মিকে হোস্টেল থেকে বাড়ি চলে যেতে বলেছেন। উর্মির শরীরের অবস্থা ভীষণ খারাপ। জ্বরে প্রায় বেহুশ আর পুরো শরীরের সাথে সাথে চোখ এবং জিভ পর্যন্ত পক্সে ভরে গেছে। কোথাও তিল ধারণের জায়গাও নেই।

উর্মি এই রাজ্যের মেয়ে নয়, সে ভিন রাজ্য থেকে এই রাজ্যে পড়াশোনা করতে এসেছে। তার ওপরে শরীরের এই অবস্থায় ও কোথায় যাবে? উর্মির বন্ধুরা যেন অকূল পাথারে পড়ে যায়। উর্মীর যে দু একজন বন্ধুর বাড়ি আশেপাশে কাছাকাছি ছিল তাদের বাড়িতেও মাতা (পক্স) সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে বাড়ির লোকেরা উর্মিকে অ্যালাও করে না। অর্ণব কিন্তু দূরে থাকতে পারে না, সে সমস্ত রকম চিন্তা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে উর্মিকে প্রায় পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে আসে নিজেদের কোয়াটারে। সেখানে রেখে দিন রাত এক করে উর্মির সব রকম ভাবে সেবাশুশ্রূষা করে ও। প্রায় এক সপ্তাহ বেহুঁশের মতন কেটেছে উর্মির। যখনই উর্মি চোখ খুলেছে দেখেছে অর্ণব ওর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে, ওর সেবা-শুশ্রষা করছে। প্রায় দিন দশেক পর পুরোপুরি সুস্থ হয় উঠে উর্মি ওর হস্টেলে ফিরে আসে।

এই প্রথম অর্ণবের জন্য উর্মির মনে একটা অনুভূতি তৈরি হলেও উর্মী সেটা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক নয়। উর্মির কাছে প্রেম মানে মনের দুর্বলতা, নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই উর্মী অর্ণবের সামনে কোন কিছু প্রকাশ করে না। আর অর্ণব ও নিজের মনের অনুভূতির কথা উর্মির সামনে সরাসরি বলতে পারেনা।

এর মাঝে কেটে গেছে অনেকগুলো মাস, ইউনিভার্সিটি ভোটের সময়ে উর্মীর অসুস্থতার কারণে অর্ণব সেই যে রাজনীতির মহল থেকে একটু একটু করে দূরে সরতে শুরু করেছিল আজ সে প্রায় সেখান থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এখন অর্নব নিজের ক্যারিয়ার সম্বন্ধে একটু সচেতন হয়েছে, এতে তার বাবা খুব খুশি। অর্ণব চাইছে পড়াশোনায় মন দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে একটা ভালো পজিশনে পৌঁছাতে এবং এ বছরই সেটা করে দেখাবার ইচ্ছে আছে ওর। আর তাই সব কিছু ভুলে আদা জল খেয়ে লেগে পড়েছে পড়াশোনা করতে।

উর্মি একটা বিখ্যাত মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে খুব ভালো মাইনের চাকরির অফার পেয়েছে। এখন অপেক্ষা শুধু ফাইনাল রেজাল্ট হাতে আসার। উর্মি খুব ভালো করেই জানে যে এই চাকরিটা ওর জন্য পাকা, কেননা বরাবর ফার্স্ট গার্ল উর্মি ফাইনাল রেজাল্ট নিয়ে এতোটুকু দুশ্চিন্তাগ্রস্থ নয়। ওদের ফাইনাল ইয়ারের এক্সাম প্রায় ঘাড়ের উপরে। এর মধ্যে একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফাইনাল ইয়ারের এর স্টুডেন্টদের দুদিনের জন্য একটা ছোট্ট ফেয়ারওয়েল ট্রিপ বা আউটিং এর ব্যবস্থা করেছে। উর্মি এবং ওর সব বন্ধুরা দারুন খুশি।

ক্রমশ.......