তীরে ফেরা ঢেউ (পর্ব- ৩)

অনিন্দিতা গুড়িয়া,

নিউ-দিল্লি


পূর্ববর্তী অংশটি পড়ার জন্য লাইব্রেরি বিভাগে দেখুন...

যথারীতি উর্মি আর ইউনিভার্সিটি র আরো সবাই মিলে হই হই করতে করতে ওরা নৈনিতাল পৌঁছে গেছে। হোটেলে পৌঁছে ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই যথারীতি ঘুরতে বেরিয়ে পড়েছে। নৈনিতাল মানেই হিল স্টেশন, পাহাড়ি এলাকা। বন্ধুদের সবার সাথে হই হই করে চলতে চলতে হঠাৎ করেই উর্মির পা মচকে যায়। উর্মি ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে, এক পা চলতেও তার ভীষণ কষ্ট হয়। উর্মীর বন্ধুরা সবাই মিলে চিন্তা করে কি করবে! কি করবে! এমন সময় হঠাৎ করেই একজন বলে ওঠে - আরে আমাদের হাফ ডাক্তারবাবু আছেন না সাথে, ওকেই ডাক না।

সবাই জানে হাফ ডাক্তার বাবু মানে অর্ণব। যেহেতু ও ফার্মাসিউটিক্যাল এর ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। সবার হাঁক ডাক শুনে অর্ণব এসে দেখল যে সত্যি উর্মীর পা টা খুব বিশ্রী ভাবে মচকে গেছে, বেশ ফুলে গেছে, যন্ত্রণায় উর্মীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। অর্নবের ভীষণ খারাপ লাগলো। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো কেউ নিজের এই অল্প সময়ের টুর টা মিস করতে চাইলো না। তাই দেখে অর্ণব একাই প্রায় পাঁজা কোলা করে উর্মীকে নিয়ে রুমে ফিরে এলো। উর্মি কে রুমে রেখে অর্ণব বেরিয়ে গেল বাজারের উদ্দেশ্যে সে বাজার থেকে পেইন কিলার জেল স্প্রে মেডিসিন ক্রেপ ব্যান্ডেজ ইত্যাদি সব আনুষঙ্গিক জিনিস কিনে প্রায় দশ মিনিটেই ফিরে আসে।

এসেই বাথরুমে গিয়ে গিজার থেকে গরম জল নিয়ে এসে অর্ণব উর্মীর সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গরম জলে নিজের রুমাল ডুবিয়ে উর্মীর পায়ে সেক করতে থাকে। এরপর উর্মির পায়ে ভলিনি জেল লাগিয়ে ক্রেপব্যান্ডেজ দিয়ে ভালো করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। উর্মির বন্ধুদের ফিরতে সেই বিকেল হয়ে যাবে। আজকে সবার লাঞ্চ বাইরেই করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই অর্ণব বাধ্য হয়েই উর্মীর রুমি থেকে যায়, যদি কখনো কোনো সাহায্যের দরকার পড়ে সেই কথা ভেবে।

অর্ণবের সেবা যত্নে আর পেইনকিলারের কল্যাণে উর্মীর পায়ে এখন আগের থেকে একটু আরাম আছে। অর্ণব আর উর্মি টাইম পাস এর জন্য গল্প করতে শুরু করে। নিজেদের স্টুডেন্ট লাইফের গল্প, ছোটবেলার গল্প, বাড়ির গল্প। এইভাবে একটু একটু করে ওরা নিজেদের সবকিছু শেয়ার করা শুরু করে।

অর্ণবের মনের ভেতরে উর্মীর জায়গা তো অনেক আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। আর উর্মীর মনের মধ্যেও কোথাও যেন ফল্গু ধারার মতো চোরা ভালোবাসার স্রোত বইছিল অর্ণবের জন্য।

এমন সময় হুড় মুড়িয়ে বৃষ্টি নামে। বৃষ্টি উর্মীর ভীষণ প্রিয়। বৃষ্টি দেখে উর্মী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা, ছোট্ট শিশুর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে এবং অর্ণবকে অনুরোধ ওকে একটু ধরে ধরে বাইরের ব্যালকনিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

বৃষ্টি অর্ণবের যে খুব খারাপ লাগে তা নয়, তবে ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজলেই অর্ণবের শরীর খারাপ হয়ে যায়। অর্ণব উর্মির অনুরোধ উপেক্ষা করতে না পেরে উর্মিকে ধরে ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে আসে। পাহাড়ে বৃষ্টি এই প্রথম দেখছে উর্মি। বৃষ্টিতে চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া। সবুজ গাছপালা গুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে বৃষ্টির অবিশ্রান্ত ধারা স্রোতে নিজেদেরকে ভাসিয়ে রেখেছে। উর্মি গুন গুন করে গায়ে ওঠে "আজি ঝরঝর মুখর বাদল দিনে".......

জানিনা অর্ণবের আজ কি হল, উর্মির গান শেষে নিজেও গেয়ে ফেলল তার ফেভারিট একটা গান "রিমঝিম গিরে সাবন".........

ওর গান শুনে উর্মি রীতিমতো মুগ্ধ আপ্লুত! অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো এত ভালো গান গাইতে পারে অর্ণব!

উর্মি ছোট্ট শিশুর মত হাতের বৃষ্টির জল নিয়ে অর্ণবের গায়ের ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। অর্ণব সমানে বলে যাচ্ছে "এই আমার গায়ে জল দিও না, বৃষ্টির জলে আমার শরীর খারাপ করে".......কিন্তু কে শোনে কার কথা? উর্মী তখন একেবারে ছোট্ট শিশুর মত উচ্ছল অস্থির। অর্ণব উর্মীর দিকে দেখছে আর মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে, অর্ণব এখন পুরো উর্মিময়। এই সময় অর্ণবের মনে হলো যে উর্মিকে অর্ণবের মনের কথা বলে দেওয়াই উচিত অর্ণব ফিরে ফিরে কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে হাটু মোড়ে বসে বলল- "উর্মী আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি, চিরকালের জন্য তুমি কি আমার হবে"?

মুখে কিছু না বলে অর্ণবের চোখের দিকে তাকিয়ে শুধু মৃদু হাসে উর্মি, ওর চোখ দুটো দেখে অর্ণব বুঝতে পারে উর্মীও ওকে ভালবাসে। দুজনে কতক্ষণ একে অপরের দিকে এইভাবে সব সপ্রেম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মনে নেই।

ধীরে ধীরে হাওয়ার তীব্রতা বাড়তে থাকে সেই সাথে বাড়তে থাকে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির ছাটে এবারে পুরো ব্যালকনি জলে একাকার হয়ে যায়। উর্মী আর অর্ণব বৃষ্টির ছাটে পুরো ভিজে যায়।

দুজনে ওরা ব্যালকনিতে ভিজতে থাকে, কিছুক্ষণ পর অর্ণব হাঁচতে শুরু করে। হঠাৎই উর্মির টনক নড়ে, অর্ণবের কথা ভেবে ওর খুব খারাপ লাগে, মনে মনে ভাবে ইস ছেলেটা আমার জন্য এত করে আর আমি নিজের ভালো লাগার কথাই শুধু ভাবলাম ওর অসুস্থতার কথাটা ভাবলাম না, বড্ড ভুল হয়েছে। উর্মি বলে অনেকক্ষণ ভেজা হয়ে গেছে চলো আমরা ভেতরে যাই।

অর্ণব ধীরে ধীরে উর্মী কে নিয়ে রুমে ঢুকে তাকে বাথরুমে পৌঁছে দেয় আর শুকনো জামা কাপড় দিয়ে বলে "ভিজে থাকলে শরীর খারাপ করবে তাই তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নাও"।

উর্মী বলে "তুমিও চেঞ্জ করে এসো, ভিজে থাকলে আমার চেয়ে তোমার শরীর আরো বেশি তাড়াতাড়ি খারাপ করবে। এমনিতেই তুমি এখন থেকেই হাঁচতে শুরু করে দিয়েছো"।

অর্ণব ঠিক আছে বলে বেরিয়েই যাচ্ছিল, হঠাৎ মনে হল উর্মীর পায়ে ব্যথা যদি সে বাথরুম থেকে বেড পর্যন্ত না আসতে পারে তাই একটু অপেক্ষা করছিল।

উর্মীর সেটা জানা ছিল না তাই উর্মি নিশ্চিন্ত মনে স্নান সেরে ভেজা কাপড় বদলে নিচ্ছিল।

এদিকে রুমের মধ্যে ভিজে জামা কাপড়ে বসে থাকতে থাকতে অর্ডবের ভীষণ ঠান্ডা লাগছিল ও মনে ভাবল যতক্ষণ উর্মি বাথরুম থেকে না বেরোচ্ছে ততক্ষণে ও ওর জিন্সের প্যান্ট আর টি শার্টটা নিংড়ে নেবে, যেমন ভাবা তেমন কাজ। ভেতরে হাফপ্যান্ট রেখে উপর থেকে জিন্সের প্যান্ট আর টি শার্টটা খুলে ফেললো অর্ণব।

আর ওদিকে ভেজা কাপড় কোনরকমে বসে বসে ঊর্মি খুলে তো ফেলেছে কিন্তু মুশকিল হয়েছে শুকনো কাপড় পড়ার সময়। উপরের টপটা কোনরকমে গলিয়ে নিচের প্যান্টটা হাতে নিয়ে উর্মী বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে এসেছে ধীরে ধীরে। মনে মনে এটাই ভেবেছে যে বেডে বসে ধীরে ধীরে লোয়ারটা পরে নেবে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে সামনে অর্ণবকে দেখতে পাবে ও ভাবেনি, তাই চমকে তাড়াতাড়ি করে আবার বাথরুমের ভেতর ঢুকে যাওয়ার চেষ্টা করে উর্মী। ও ভুলে যায় তার পায়ের ব্যথার কথা। এই তাড়াহুড়োতে উর্মি আবারও পায়ে ব্যথা অনুভব করে আহ করে বসে পড়ার আগেই অর্ণব দৌড়ে এসে উর্মীকে ধরে নেয়। উর্মি ও পড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে খামচে ধরে অর্ণবের কাঁধ।

অর্ণবের খোলা কাঁধে উর্মীর নখ ক্রমে দেবে বসে যাচ্ছে অর্ণবের কাঁধটা জ্বালা করে ওঠে। অস্ফুটে অর্ণবের মুখ থেকে আহ্ শব্দ টা বেরিয়ে যায়, তাতে করে উর্মী চোখ মেলে নিজেকে অর্ণবের একেবারে বুকের সাথে মিশে থাকা অবস্থায় আবিস্কার করে। একে অপরের প্রতি একটা ভালো লাগার জায়গা তো ছিলই এখন আবার আগুন আর ঘি একসাথে এতো কাছে। কতক্ষণ এভাবে থাকা যায় ! এক আবেগঘন মুহূর্তে চার চোখের মিলন ঘটে।

একে অপরের গরম শ্বাস পড়ছে একে অপরের মুখে, থর থর করে কেঁপে উঠে দুটো শরীর তারপর আবেশে আবেগে ভালোবাসায় একে অপরের ঠোঁটের দখল নিয়ে নেয় দুজনে, হারিয়ে যায় একে অপরের মধ্যে। মেতে ওঠে এক আদিম খেলায়।

কিভাবে যে কি হয়ে গেল তা বুঝে ওঠার আগেই যা হবার তা হয়ে গেছে।

লজ্জায় অর্ণবের মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো, ভীষণ রাগ হচ্ছিল নিজের উপরে এতটা কেয়ারলেস সে হল কিভাবে? সে তো এভাবে উর্মিকে পেতে চায়নি! ইচ্ছে করছিল নিজেকেই নিজে ঠাটিয়ে ঠাটিয়ে চড় মারে। মাথা নিচু করে বারবার করে উর্মীর সামনে সরি বলছিল সে। বারবার করে বোঝাতে চাইছিল যে সে উর্মিকে ভীষণ ভালোবাসে কিন্তু এইভাবে উর্মীর অসহায়তার সুযোগ সে নিতে চায়নি কখনোই।

খুব স্বাভাবিক গলায় উর্মী বলেছিল ডোন্ট ওয়রী, আমরা একে অপরকে লাইক করি টেনশন নিও না। আমরা দুজনে কেউই দুধের শিশু নই , যা হয়েছে তা আমাদের দুজনের পূর্ণ সম্মতিতেই হয়েছে। তুমি তোমার রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে এসো।

একটা তীব্র অপরাধবোধ যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল অর্ণবকে। উর্মীর রুম থেকে বেরিয়ে কোনরকমে নিজের শরীরটাকে টেনে নিজের রুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে শুকনো জামা কাপড় পড়ে অর্ণব আর উর্মীর রুমে ফিরে যেতে পারল না। ওর যেন বারবার মনে হচ্ছিল উর্মীর চোখের সামনে ও আর দাঁড়াতে পারবে না কখনোই। এত সবকিছুর মধ্যে সময়ের হিসেবটাই ছিল না, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁই ছুঁই। নিজের রুম থেকে রুম সার্ভিসের ফোন করে উর্মীর রুমে লাঞ্চ সার্ভ করতে বলে দেয় ও। আর নিজে নিচের ডাইনিং স্পেসে লাঞ্চ করে ফিরে আসে।

এরপর বিকেলের দিকে বন্ধুরা সবাই ফিরে এলে ওরা সবাই একসাথে নিচের হলে চা আর স্ন্যাকস খাওয়ার জন্য জড়ো হয়। উর্মিকে ওর রুমমেট মেঘা ধরে ধরে নিচে নিয়ে আসে। সবাই সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরল, কি কি দেখল, সেই সব গল্পে মুখর হয়ে ওঠে গোটা হল।

এরপর বন্ধুরা কেউ কেউ রুমে ফিরে গেলেও কেউ কেউ আবার শপিং করার জন্য বাইরে চলে যায় আর ডিনারের আগেই ফেরত আসার কথা জানিয়ে স্থানীয় মার্কেটের দিকে বেরিয়ে যায়। মেঘা বলে, সে মার্কেটিং পরের দিন করবে, ও ভীষণ টায়ার্ড ছিল তাই উর্মিকে ধরে ধরে নিয়ে মেঘা আর উর্মি ওদের রুমে ফিরে আসে।

অর্ণবের রুমমেট মার্কেটে গেছে তাই অর্ণব একাই নিজের রুমে ফিরে এসে বেডে শুয়ে শুয়ে সারা দিনের কথা মনের মধ্যে রোমন্থন করতে লাগে।

পরদিন সকালে উর্মীর পায়ের অবস্থা অনেকটাই ভালো থাকায় ও ধীরে ধীরে আর সবার সাথে নৈয়না দেবীর মন্দির দর্শন করতে যায়। মন্দিরে পৌঁছে অর্ণব দেখে উর্মি একলা মন্দির চত্বরে বসে আছে আর বাকি সবাই আশপাশটা ঘুরে দেখছে। উর্মীর পায়ের ব্যথার জন্য উর্মী বেশি হাঁটাহাঁটি করছে না। উর্মির একাকীত্ব দূর করতে অর্নব গিয়ে উর্মীর পাশে বসে যায়।

কি ভেবে অর্ণব বলে উর্মী এই নেয়না দেবীর সামনে আমি তোমাকে আমার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করলাম, আমি তোমার যোগ্য সম্মান দিয়ে নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করছি। এই মুহূর্ত থেকে তুমি আমি স্বামী স্ত্রী, বলেই উর্মি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেয়না দেবীর ঘট থেকে আঙ্গুলের ডগায় একটু সিঁদুর নিয়ে অর্ণব উর্মীর কপালে একটা ফোঁটা লাগিয়ে দেয়।

ঊর্মি বলে অর্ণব বি প্রাক্টিকাল, আবেগ তাড়িত হয়ে কোন কাজ করো না। রিলাক্স থাকো, কেন এতো গিল্ট ফিল করছো!

অর্ণব কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মেঘা এসে উপস্থিত হয় ওদের দুজনের মাঝে পূর্বের দিকে তাকিয়েই মেঘা বলে কিরে ঠাকুর মশাই কোথায় আমাকেও একটা টিকা লাগিয়ে দিতে বল। উর্মি শুধু মৃদু হাসে আর অর্ণব সেখান থেকে সরে যায়।

এরপর সন্ধ্যের গাড়ি ধরে তারা সবাই পরের দিন সকালবেলা ইউনিভার্সিটিতে ফিরে আসে।



ক্রমশ.......