তীরে ফেরা ঢেউ (পর্ব- ৪)
অনিন্দিতা গুড়িয়া,
নিউ-দিল্লি
পূর্ববর্তী অংশটি পড়ার জন্য
লাইব্রেরি
বিভাগে দেখুন...
সামনেই ফাইনাল পরীক্ষা, তাই কোন কিছুর কথা উর্মির মাথায় থাকে না।
নৈনিতাল থেকে ফিরে সে নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে দেয়। ভালো রেজাল্ট
করতেই হবে, এই শুধু মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়ায় উর্মির। পড়া পড়া আর পড়া!
এর ফাঁকে কখন যে উর্মি তার পিরিয়ড মিস করে গেছে সে খেয়াল থাকে না। মাঝে
মাঝে মাথা ঘোরে, গা বমি বমি লাগে কিন্তু সে সবকিছুই পাত্তা দেয় না
উর্মি। ভাবে পড়াশোনার চাপে ঠিকমতো ঘুম বা খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে না তাই
এমন হচ্ছে। পরীক্ষা শেষ হলেই একটু লম্বা রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
পরীক্ষা শেষ হতে হতে প্রায় তিন মাস পেরিয়ে যায়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি
যে এই তিন মাসে উর্মির পিরিয়ডের ডেট মিস হওয়ার কথা একবারও মাথায় আসে
না।
উর্মির পরীক্ষা শেষ হওয়ার একদিন আগেই অর্ণবের পরীক্ষা শেষ হয়ে যায়।
তাই পরের দিন উর্মীর পরীক্ষা শেষ হবে সেই কথা ভেবেই অর্ণব আগে থেকেই
ইউনিভার্সিটিতে এসে উর্মির জন্য অপেক্ষা করে। এই তিন মাস নাওয়া খাওয়া
ভুলে খুব খেটে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছিল সে। এবং পরীক্ষাও তার বেশ
ভালই গেছে। এখন একটা ভালো রেজাল্ট আশা করে অর্ণব। তবে এই তিন মাস বড্ড
বেশি করে ঊর্মিকে মনে পড়ছিল অর্ণবের। আর তার জন্যই মনে হয় এত খেটে খুটে
পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিয়েছে অর্ণব। কারণ অর্ণব জানে উর্মির জন্য অন্তত
তাকে ভালো চাকরি বা ভালো পজিশন পেতেই হবে। আর আজ পরীক্ষা শেষে উর্মিকে
অর্ণব সেই কথাটাই জানাতে এসেছে। অর্ণবের কাঁধে একটা ব্যাগ, খুব সন্তর্পনে
ব্যাগের মধ্যে সে একতোড়া লাল গোলাপ এনেছে উর্মীর জন্য আর একটা ছোট্ট
সাদা পাথর বসানো হালকা সোনার আংটি।
পরীক্ষা শেষে উর্মি নিজের বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে হৈ হৈ করতে করতে বেরিয়ে
আসে ইউনিভার্সিটি থেকে। সামনে অর্ণবকে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে ও এগিয়ে
আসে অর্ণবের দিকে। তিন মাস পর অর্ণব ওকে দেখে অবাক হয়ে যায়! এই তিন
মাসে উর্মির চেহারা ভীষণ খারাপ হয়ে গেছে, চোখের তলায় কালি, কেমন আলু
থালু উস্কো খুসকো চেহারা! এইসব দেখে দেখে অর্ণবের মনে কেমন একটা সন্দেহ
জাগে, কারণ কয়েক মাস আগেই অর্ণব ওর নিজের দিদিরও ঠিক এইরকম চেহারা
দেখেছিল। তাই অর্ণব উর্মিকে এক সাইডে ডেকে বলে-" উর্মি তোমার শরীর তো
ভীষণ খারাপ দেখাচ্ছে, চলো তোমাকে কোন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই"।
উর্মি হেসে উড়িয়ে দেয় অর্নবের কথা, বলে-" আরে টেনশন নিও না পরীক্ষার
চাপে এমন হয়েছে, দুই একদিন রেস্ট করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে"।
এই কথা বলতে বলতেই উর্মির চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যায় আর মাথা ঘুরে
প্রায় পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলে অর্ণব দুহাত দিয়ে নিজের বুকে ধরে নেয়
ওকে আর প্রায় জোর করে কাছাকাছি একটি ডাক্তারখানায় নিয়ে যায়।
ডাক্তার উর্মিকে চেক করে সাধারণ কয়েকটা মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট লিখে
দিয়ে ব্লাড টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে নেন এবং পরের দিন এসে
রিপোর্ট নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। ডাক্তার-খানা থেকে বেরিয়ে অর্ণব আর
উর্মি একটা ক্যাফেতে গিয়ে বসে, সেখানেই কফি আর স্ন্যাকস খেয়ে তারপর
অর্ণব উর্মিকে হোস্টেলের সামনে ছেড়ে দিয়ে পরের দিন রিপোর্ট আনার কথা
বলে বাড়ি চলে যায়।
রুমে ফিরে উর্মি দেখে মেঘা তার জিনিসপত্র গুছাচ্ছে! উর্মী জিজ্ঞেস করাতে
মেঘা বলে- ফাইনাল পরীক্ষা ছিল বলে আগে থেকে বাড়ির কেউ ওকে খবর দেয়নি,
কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি থেকে ফোন এসেছে যে সপ্তাহখানেকের মধ্যে তার মামাতো
দাদার বিয়ে তাই আর একটুও দেরি না করে সে এখনই বাড়ির জন্য রওনা দেবে আর
আগামীকাল সকাল বেলা সে বাড়ি পৌঁছে গিয়ে সবার সাথে বিয়ে বাড়ির আনন্দে
মেতে উঠবে।
আর তাছাড়া ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে, তাই হোস্টেল সুপারেনটেনডেন্ট
ওদেরকে এক সপ্তাহের মধ্যে রুম খালি করে দেওয়ার কথা ও বলে গেছেন।
ফাইনাল পরীক্ষার অনেক আগেই উর্মি ব্যাঙ্গালোরের একটা বিখ্যাত
মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছে, ফাইনাল পরীক্ষার জন্য
অপেক্ষা করছিল শুধু। হয়তো দু'একদিনের মধ্যে জয়েনিং লেটার ও হাতে পেয়ে
যাবে সে। তবে উর্মির খুব ইচ্ছে করছে এর ফাঁকে একবার কলকাতায় গিয়ে
মায়ের সাথে দেখা করে আসার।
আজ রাতে উর্মির রুমমেট মেঘা নেই, পড়াশোনার চাপও নেই, তাই রাতটা যেন কেমন
নির্জন নিঃসঙ্গ মনে হয় উর্মীর। রাতের খাবার খেয়ে লাইট বন্ধ করে চুপ করে
বিছানায় শুয়ে থাকে উর্মি। দুচোখে ঘুম নেই ওর। ছোটবেলা থেকে আজ অবধি
সমস্ত ঘটনা যেন ওর মনের মাঝে ভীড় করে আসতে থাকে। কেমন করে বাবা মারা
যাবার পর মা সেই ছোট্টবেলায় ওর হাত ধরে গ্রাম থেকে কলকাতায় চলে আসে,
একটা চাকরির জন্য অফিসের দরজায় দরজায় দিনের পর দিন অভুক্ত ক্লান্ত শরীর
নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তারপর কোনো মতে একটা ছোটখাটো চাকরি জুটিয়ে কত কষ্ট
করে ওকে মানুষ করেছেন। হোস্টেল থেকে বাড়িতে ফিরলে মা কত আদর করে মাথায়
তেল লাগিয়ে দিয়ে যত্ন করে পরিপাটি করে ভাত মেখে খাইয়ে দিত। মায়ের সে
সব কথা মনে পড়ছে আজ উর্মীর। মনে পড়ছে ছুটিতে বাড়িতে গেলে সিধু মামা
স্বপ্না মাসি, মা সবার সাথে কেমন হইচই করতে করতে কেটে যেত দিনগুলো।
মনে পড়ছে নৈনিতাল বেড়াতে যাওয়ার কথা। মনে পড়ছে অর্ণব আর ওর আবেগঘন
মুহূর্ত.......
হঠাৎ করে ছিটকে বিছানায় উঠে বসে উর্মী, ছি ছি ছি ছি! এই তিন মাসে উর্মীর
একবারও ওর পিরিয়ড মিস হওয়ার কথা মাথায় এলোনা! এই জন্যই কি ডাক্তার
বাবু কয়েকটা টেস্ট করলেন! কি জানি কালকে রিপোর্টে কি আসবে! এমন যদি কিছু
হয় ও তো অর্ণবের সামনে চোখ তুলে দাঁড়াতেই পারবে না। না না কালকে
অর্ণবের পৌঁছানোর আগেই ওকে ডাক্তারখানায় পৌঁছে নিজের টেস্ট রিপোর্টটা
নিজেকেই সংগ্রহ করতে হবে, কিছুতেই অর্ণবের হাতে রিপোর্ট ছাড়া যাবে
না......এই কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে উর্মী ঘুমিয়ে পড়েছে জানতেও পারে না।
পরীক্ষা শেষ, টেনশন ফ্রি, তাই রাতে ঘড়িতে অ্যালার্ম লাগিয়ে রাখেনি, আর
মেঘাও রুমে নেই তাই ডাকাডাকি করারও কেউ নেই। আর সেই জন্যই সারারাত্রি
জেগে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে সকালে উর্মির উঠতে অনেকটাই বেলা হয়ে গেল।
যখন চোখ খুলে উর্মি ঘড়ির দিকে তাকালো তখন ঘড়ির কাঁটা দশটা পেরিয়ে
গেছে।
তাড়াতাড়ি করে উর্মি যখন ডাক্তারখানায় পৌঁছালো তখনই অর্ণব ডাক্তার
খানার ভিতর থেকে রিপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে আসছিল, মুখোমুখি প্রায় ধাক্কা
হবার যোগাড় দুজনের! অর্ণব চোখ তুলে দেখল সামনে উর্মি দাঁড়িয়ে। অর্ণব
মাথাটা নিচু করে উর্মীর দিকে রিপোর্টটা বাড়িয়ে দিল। উর্মি আগেই বুঝে
গেছিল রিপোর্টে কি আসতে পারে। এখন অর্ণবের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে আরো ই
কনফার্ম হলো যে ও যেটা ভেবেছিল সেটাই ঠিক। তবুও ধীরে ধীরে রিপোর্টটা দেখল
তারপর অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বলল-
- অর্ণব চিন্তা করো না, তোমাকে এত স্ট্রেস নেয়ার দরকার নেই। দু-একদিনের
মধ্যেই আমি আবর্সন করিয়ে নেব।
উর্মির কথা শুনে অর্ণব চমকে উঠলো, এবং প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলো-
- কি বলছ উর্মি !
- তাছাড়া আর উপায় কি বল, এই মুহূর্তে আমি এসব কিছুই ঝামেলা চাইছি না।
ইমিডিয়েটলি সপ্তাহখানেক এর মধ্যেই আমাকে অফিস জয়েন করতে হবে। আমার
জয়নিং লেটার এসে গেছে।
- অফিস ! জয়েনিং লেটার! এসব কি বলছো উর্মি, এখন আমাদের অনাগত সন্তান
নিয়ে তোমাকে একটু ভাবা উচিত। চিন্তা করো না আমি তোমার পাশে ছিলাম, আছি
আর থাকবো সবসময়। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদেরকে সামাজিকভাবে বিয়েটা
করে ফেলতে হবে। এই সন্তান আমাদের সন্তান আমরা কোনভাবেই এর দায় এড়াতে
পারি না।
হা হা করে হেসে উর্মি বলল -
- তুমি কি ক্ষেপেছো অর্ণব? তোমার কোন চাকরি-বাকরি নেই, আমি এখনও কিছু করি
না, এই সন্তানের দায় আমরা বহন করব কিভাবে! তার চেয়ে তুমি তোমার মত
চাকরি-বাকরি দেখো, আমি আমার মতন চাকরি করি আর এসব কিছু ভুলে যাও।
কথা বলতে বলতে ওরা ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে একটা পার্কের কাছাকাছি এসে
গেছিল। অর্ণব উর্মিকে ইশারা করল পার্কের ভেতরে বসে কথা বলার জন্য। উর্মি
আর অর্ণব পার্কের ভেতরে গিয়ে একটা খালি বেঞ্চ দেখে বসলো দুজনে। অর্ণব
উর্মির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল -
- উর্মি তুমি আমায় ভালোবাসো তো?
- একথা জিজ্ঞেস করছ কেন? যদি বলি হ্যাঁ ভালোবাসি, আর যদি বলি না ভালোবাসি
না তাহলেই বা কি বলবে তুমি?
অর্ণবের চোখে জল,
- উর্মি আমি তোমাকে বড্ড ভালোবাসি, আমি তোমাকে হারাতে চাইনা কোনভাবেই।
- অর্ণব আবেগপ্রবণ হয়ে কোন ডিসিশন নেওয়াটা ঠিক নয়। পরে কিন্তু এর জন্য
পস্তাতে হবে। আমি একজন মেয়ে হয়ে যখন ক্যাজুয়ালি এটাকে মেনে নিচ্ছি
একজন ছেলে হয়ে তো দায় ঝেড়ে ফেলাটা খুব সহজ।
- জানি না আমার পরিস্থিতিতে অন্য কোন ছেলে থাকলে কি করতো কিন্তু আমি আমার
অবস্থাটা জানি। আমি তোমাকে পেতে চাই আমার সন্তানকে পেতে চাই।
উর্মী বলল - অর্ণব তুমি এইভাবে আমার উপর জোর করতে পারো না, আইনত কোন
অধিকার তোমার নেই। আর তাছাড়া এই সন্তান আমি রাখবো কি রাখবো না সেটা
সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।
- এই সন্তান শুধুই কি তোমার, আমার কি নয়!
- আমি মানছি এটা আমাদের দুজনেরইএকটা বিশেষ মুহূর্তে আবেগে ভেসে যাওয়ার
ফল।
আহত কন্ঠে অর্ণব বলে উঠলো -
- শুধুই কি আবেগে ভেসে যাওয়া! ভালোবাসা নয় বলতে চাও!
- 'ভালোবাসা' কথাটা বলা খুব সহজ অর্ণব কিন্তু তার দায়িত্ব পালন করাটা
ভীষণ কঠিন। বাস্তব বড় রূঢ়। দরজা দিয়ে দারিদ্র্য প্রবেশ করলে ভালোবাসা
জানলা গলে আপনিই উড়ে পালাবে। আর তাছাড়া এই সামান্য বিষয়ের জন্য আমি
আবার ক্যারিয়ার নষ্ট করতে পারিনা। সামনে আমার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার, তুমি
আমাকে আমার ক্যারিয়ার থেকে এইভাবে দূরে সরিয়ে দিতে পারো না অর্ণব।
এইবারে অর্ণব বেঞ্চ থেকে নেমে মাটিতে বসে উর্মির পা দুটো জড়িয়ে ধরল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল -
-প্লিজ উর্মি আমার এই কথাটা অন্তত তুমি শোনো। আমি কিচ্ছু চাই না তোমার
থেকে। আমাকে আমার সন্তানহারা করোনা। তার জন্য তুমি আমাকে যা বলবে আমি তাই
করবো।
অর্ণবের এই রূপ দেখে উর্মি অবাক হয়ে গেল! আজকালকার দিনে কত ছেলেরা
মেয়েদেরকে ফুষলে তাদের সঙ্গে সহবাস করে তারপর তারা প্রেগন্যান্ট হয়ে
গেলে তাদেরকে রীতিমতো ছুঁড়ে ফেলে দেয় নিজেদের জীবন থেকে, দায়-দায়িত্ব
ঝেড়ে ফেলতে চায় আর সেখানে অর্ণব.......
উর্মি বলল-
- অর্ণব ওঠো, ছাড়ো আমার পা, এরকম করোনা প্লিজ। আশেপাশের লোকজন আমাদেরকে
দেখছে। তুমি এমন করো না লক্ষীটি, ওঠো, আমাকে রুমে যেতে দাও। দুই-একদিনেই
আমাকে আমার হোস্টেল খালি করে দিতে হবে, আজ রাতটা অন্তত ভাবনা চিন্তা করার
জন্য আমাকে সময়টা দাও। কথা দিচ্ছি যে ডিসিশন নেব তোমাকে জানিয়েই নেব।
একা একা কোন ডিসিশন নেব না।
এরপর অর্ণব চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় আর উর্মিকে তার হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে
ফিরে যায় নিজের বাড়িতে।
উর্মি কি ডিসিশন নেবে না নেবে সেটা ভেবে ভেবেই অর্ণবের দিনের খাওয়া
রাতের ঘুম সব উড়ে গেছে। সারাটা রাত সে শুধু বিছানার মধ্যে ছটফট করেছে আর
মাঝে মাঝেই কেঁদে কেঁদে উঠেছে। হাত দুটো বুকের কাছে জড়ো করে বারবার
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানিয়েছে যে উর্মি যেনো এমন কোন ডিসিশন না নেয়
যাতে এই সন্তানটা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই চিরতরে হারিয়ে যায়!
এদিকে হোস্টেলে ফিরে জিনিসপত্র গোছগাছ করে উর্মি অনেক চিন্তা করল শেষে ও
একটা ডিসিশনে এলো।
কথা মতো পরদিন সকালবেলা ওরা আবার সেই পার্কে দেখা করলো দুজনে। তারপর
অর্নবকে জানালো যে
- চাকরি করতে ওকে এখন ব্যাঙ্গালোর যেতে হবে, তারপর হয়তো ওখান থেকে তাকে
শিফট করে আবার অন্য কোথাও দেবে। তো অর্ণব যদি চায় তাহলে অর্ণব উর্মীর
সাথে ব্যাঙ্গালোর যেতে পারে এবং উর্মি এটাও বললো যে সন্তানের সে জন্ম
দেবে কিন্তু তারপরে উর্মির ওপরে অর্ণবের আর কোন অধিকার থাকবে না। উর্মী
অর্ণবকে সন্তান দিয়ে চিরতরে মুক্ত।
অর্ণব মনে মনে ভাবল ঠিক আছে, আগে সন্তান তো আসুক দুনিয়াতে! কেউ কখনো
শুনেছে যে সন্তানকে ছেড়ে দিয়ে মা মুক্ত হওয়ার চিন্তা করে! সন্তানের
মুখ দেখলে আপনিই মা সন্তানের সাথে জুড়ে যাবে।
উর্মীর কথা মতন অর্ণব বলল হ্যাঁ ঠিক আছে এবং সন্তান প্রাপ্তি হয়ে গেলে
সে সন্তানকে নিয়ে ফিরে যাবে নিজের গন্তব্যে, তখন থেকে উর্মির পথ আর
অর্ণবের পথ আলাদা হয়ে যাবে।
অর্ণব বাড়িতে তার বাবাকে জানালো যে সে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি পেয়েছে, তাই
তাকে দুই এক দিনের ভেতরেই বাঙ্গালোর চলে যেতে হবে।
অর্ণবের বাবা তাতে মত দিয়ে দিলেন, তিনি মানা করলেন না। উর্মীও তার মাকে
জানালো যে তাকে এখনই ব্যাঙ্গালোর চলে যেতে হচ্ছে পরে সময় সুযোগ মতো সে
মায়ের সাথে যোগাযোগ করে মায়ের কাছে আসবে অথবা মাকে সে নিজের কাছে ডেকে
নেবে। অর্ণব এবং উর্মি দুজনেই নিজের নিজের পরিবারের কাছে অথবা কোন
বন্ধু-বান্ধবকে কোন কিছুই জানালো না তারা দুজন রওনা দিল ব্যাঙ্গালোরের
উদ্দেশ্যে।
এখন অর্ণবের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞ্যান উর্মিকে কিভাবে ভালো রাখা যায়।
উর্মিকে সেবা যত্নে ভরিয়ে রাখল অর্ণব যে আবাসনে ওরা উঠেছে তার গেটের ঠিক
বাইরেই একটি ওষুধের দোকানে অর্ণব চাকরী জুটিয়েছে। ওর যা ডিগ্রী তাতে
অনায়াসে অন্য কোন ভালো জায়গায় চাকরি করতে পারতো কিন্তু ভালো জায়গায়
চাকরি করা সুবিধাজা যেমন অসুবিধা হতো এমনকি পয়সাটা হয়তো অনেক বেশি
পাওয়া যাবে বা সম্মানটাও বেশি কিন্তু সেখানে দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি
অনেক বেশি সময় তাকে অফিসে দিতে হবে। তাই পয়সার কথা চিন্তা না করে বা
সম্মানের কথা চিন্তা না করে অর্ণব উর্মির সেবা যত্নের দিকে বিশেষ নজর
দিতে পারবে। সারাদিন দোকান করে আর তারপর উর্মি অফিস থেকে ফিরে এলে উর্মীর
সেবায় লেগে যায় অর্ণব।
এক এক সময় উর্ম নিজেই অবাক হয়ে যায়!
ব্যাঙ্গালোরে এসে অর্ণব এবং উর্মি দুজনের পুরনো ফোন নম্বর বদলে ফেলে ওরা
এবং নতুন নম্বর কেবলমাত্র নিজেদের বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ করার জন্য
ব্যবহার করে ওরা যাতে করে পুরানো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ওদের কোন রকম
যোগাযোগ না থাকে। আসলে ওদের পরিস্থিতিটা ওরা কাউকেই জানাতে চাইছিল না।
এর মাস দুয়েক পরে হঠাৎ করেই মেট্রোতে উর্মির বান্ধবী মেঘার সাথে দেখা
হয়ে যায় উর্মীর। উর্মিকে দেখেই মেঘা জড়িয়ে ধরে হৈচৈ করে ওঠে, কিন্তু
উর্মী যেন একটু চমকে ওঠে। মেঘা বলে কিরে চমকে গেলি?
- আসলে আমি ভাবতেই পারিনি যে এই শহরে এই ভাবে তোর সাথে দেখা হবে! খুব
ভালো হলো চল, তারপর কোথায় আছিস, কি করছিস, ইত্যাদি নানা কথোপকথনের পরে
উর্মি বুঝতে পারে ওদেরই অফিস বিল্ডিং এর সেকেন্ড ফ্লোরে মেঘার অফিস।
দুজনের মধ্যে রোজ দেখা সাক্ষাৎ হবে। এখনো উর্মির বেবি বাম্প স্পষ্ট নয়
তাই মেঘা কিছুই বুঝতে পারেনি কিন্তু দুদিন বাদেই উর্মির বেবিবাম্প এলে
মেঘা সবটা বুঝে যাবে। উর্মি মনে মনে প্রমাদ গণলো।
সেই দিনই অফিস থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করে এসে অর্নবকে বলল-
- গোছগাছ করে নাও, দুই একদিনে আমাদেরকে ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে
যেতে হবে।
- অন্য কোথাও কেন? এই তো সবে দু মাস হয়েছে আমরা ব্যাঙ্গালোর এসেছি,
তোমার নতুন চাকরি, নতুন অফিস এখনই কোথায় কিভাবে যাবে!
- চিন্তা নেই, আমাদেরই অফিসের আর একটা ব্রাঞ্চ আছে চন্ডিগড়ে ওরা আমাকে
সেখানে ট্রান্সফার করে দিয়েছে । আমরা চন্ডিগড় চলে যাব।
এরপর অর্ণব দোকানের পার্ট ঘুচিয়ে উর্মীর সাথে সাথে লটবহর নিয়ে চন্ডিগড়
এসে পৌঁছালো।
এখন উর্মির মাঝে মাঝেই হাবিজাবি অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছে করে। মাছ মাংস ডিম
চিকেন মাটন এবং অর্ণব; যে সারা জীবন ননভেজ ছুঁয়েও দেখেনি সে কিন্তু বিনা
বাক্য বয়ে উর্মীর কথা ভেবে সব কিছু যোগান দিতে থাকে এবং অনেক যত্ন করে
উর্মীকে খাওয়ায়।
ধীরে ধীরে উর্মির উদর স্ফীত হতে থাকে। ঊর্মিকে দেখে দেখে অর্ণবের ভীষণ
আনন্দ হয়। মাঝে মাঝে ভাবে উর্মিকে গিয়ে একটু জড়িয়ে ধরে। উর্মির পেটে
কান লাগিয়ে শোনে বাচ্চার হৃদস্পন্দন! একটু একটু করে বেড়ে ওঠা
বাচ্চাটাকে ফিল করতে চায় অর্ণব।
কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সংযত করে নেয়। ওরা এক বাড়িত থাকলে কি হবে,
দুজনের বেডরুম আলাদা। ওরা কেউ কাউকে নৈনিতাল এর সেই হোটেলের সেই দিনের
পরে ছুঁয়েও দেখেনি। শেষের দু মাস উর্মির পেটটা এতটা বড় হয়েছে যে চলতে
ফিরতেও কষ্ট হয়। তাই শেষের দুই মাস উর্মি বাড়িতে বসেই অফিসের কাজ করে।
ওয়ার্ক ফ্রম হোম নেয় উর্মী।
অর্ণব উর্মীর প্রতিটা মুহূর্তের খেয়াল রাখে। তার খাওয়া পরা, হাঁটা চলা,
সবকিছুতেই তাকে সাহায্য করে। দেখতে দেখতে সেই বিশেষ মুহূর্তটি উপস্থিত
হলো, অর্ণব উর্মিকে নিয়ে হসপিটালে এডমিট করল। অর্ণব উর্মির যত্ন আত্তির
কোন ত্রুটি রাখেনি তাই নরমাল ডেলিভারিতে উর্মি খুব হেলদি ভাবেই একটি
হেলদি শিশুর জন্ম দিল। তবে উর্মির ব্যবহারে নার্সরা ভীষণ অবাক হয়ে গেল,
সদ্য জন্মানো শিশুর কান্না শুনে মায়েরা আনন্দে অধীর হয়ে ওঠে বাচ্চার
মুখ দেখার জন্য। কিন্তু উর্মির মধ্যে সেরকম কোন হেলদোল দেখা গেল না। সে
সন্তানের মুখ দেখতেই চাইল না। উর্মীর মনের মধ্যেও ভয় ছিল, পাছে সন্তানের
মুখ দেখলে যদি মায়ায় জড়িয়ে যায়! আপনারা হয়তো ভাববেন জগতে এমন কোন
মা হতে পারে যে নিজের সন্তানের মুখ দেখতে চায় না! কিন্তু উর্মি একেবারে
অন্য ধাতুতে গড়া। তার কাছে তার ক্যারিয়ারই সবকিছু তার আগে কি সন্তান কি
স্বামী কি সংসার কোন কিছুরই কোন মূল্য নেই। এখন উর্মিকে তার বেডে দেওয়া
হয়েছে আর বাচ্চাকে দেওয়া হয়েছে বেবিকটে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার
এলেন সাথে সাথে একমুখ হাসি নিয়ে অর্ণবও ঢুকলো, উর্মি আর বাচ্চাকে দেখে
অর্ণব ভীষণ খুশি হল। ডাক্তার এসে মা বাচ্চা দুজনকে চেক করে বললেন দুজনেই
একেবারে সুস্থ আছে। পরের দিনই ওদেরকে ডিসচার্জ করে দেওয়া হবে।
শুনে উর্মি অর্নবকে বলল -
- অর্ণব আমি আমার রুমে একটা ট্রলি ব্যাগ গুছিয়ে রেখে দিয়ে এসেছি কালকে
হসপিটালে আসার সময় তুমি আমার ওই ট্রলি ব্যাগটা উঠিয়ে এনো প্লিজ।
পরদিন ট্রলিটা আনতে গিয়ে অর্ণব দেখল বেশ বড় আর ভারী ট্রলি ব্যাগে লক
করা আছে। অন্য কোন কিছু না ভেবে ট্রলিটা নিয়ে হসপিটালে এলো উর্মীকে আর
বাচ্চাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। হসপিটালের গেটে এসে
দাঁড়িয়ে অর্ণব পার্কিং থেকে নিজেদের গাড়িটা আনতে গেল। ততক্ষণে উর্মি
আর একটা ক্যাব বুক করে নিয়েছে। অর্ণব নিজের গাড়ি হসপিটালের গেটে
লাগানোর সাথে সাথে উর্মির ক্যাবটাও অর্ণব এর গাড়ির পেছনে এসে দাঁড়ালো।
উর্মি অর্ণবকে বলল-
- অর্ণব তুমি যেটা চেয়েছিলে সেটা পেয়ে গেছো, এখন থেকে তোমার রাস্তা আর
আমার রাস্তা আলাদা।
দুদিন বয়সের সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে হতভম্বের মতো অর্ণব
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল উর্মীর দিকে। আর অর্ণবের চোখের সামনে থেকে
উর্মি তার ব্যাগ নিয়ে ক্যাবে চড়ে বসে গেল। একবারও পিছন ঘুরে তাকালো না
পর্যন্ত।
ক্রমশ..............