বিদ্বান এবং কালিদাস
ডক্টর উমাশঙ্কর চক্রবর্তী,
কলকাতা

শহরের থেকে অনেক দূরে কোলাহল বিরোহিত গ্রামের এক পুরোনো বাড়ীর বৈঠকখানায়
বিষ্টুদা সকাল সন্ধে আজো হয়তো বসেন। দেখে মনে হয়না তিনি বয়সের ভারে
ভারাক্রান্ত। নিত্য দু'খানি দৈনিক সংবাদ পত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন।
আমাকে সামনে পেয়ে বিষ্টুদা একদিন প্রশ্ন করেছিলেন, "বলতো উমা, শিক্ষিত
মানুষের কাজ কি? আর বিদ্বান ব্যক্তিরাই বা কি করেন?"
বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের সন্ধিক্ষণে থমকানো এই আমি
খুব তৎপরতার সঙ্গে উত্তরে বলেছিলাম, "বিষ্টুদা, আমিতো জানি, শিক্ষিত
মানুষরা ভাল চাকুরী করে, গুছিয়ে কথা বলে এবং সর্বদা কেমন যেন একটু গা
বাঁচিয়ে চলে। আর বিদ্বান ব্যক্তিগণ কোথায় যে থাকেন জানিনা, তবে
জ্যেষ্ঠদের মুখে শুনি যে তারা নাকি খুব বোকা, জগৎ সংসার সম্বন্ধে তাদের
কোনো জ্ঞানই নেই"।
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বিষ্টুদা বললেন, বুঝেছি, বুঝেছি, 'তুই থালে এসব নিয়ে
একটু আধটু চর্চা টর্চা করিস। তুই ঠিকই বলেছিস, শিক্ষিত মানুষ জনেরা একটু
বেশী সাবধানী আর তাই হয়তো ওরা একটু 'প্যাঁকালে''। আসলে কি জানিস, দেশ
চালাতে গেলে তো অনেক "বুদ্ধি” লাগে। তাই হয়তো সেই বুদ্ধি সব আগলে রাখতেই
ওদের সাবধানী হতে হয়। দেশ চালানো কি সহজ ব্যাপার র্যা?"
"এ আর রাজা, খাজা, বাদশা, শাহেনশা নয়, যে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত হলেও
চলবে। এখন তেল-নুন চাখতে গেলেও শিক্ষের দরকার, বুঝলি?”
"পড়িসনি। মনে নেই। কবিগুরুর সেই কবিতেটা। রাজার দেশের চামার, সে শিক্ষিত
ছিল না বলে তাকে শূলে চড়াতে হয়েছিল'। আর রাজা মহাশয় 'শিক্ষিত' ছিলেন
বলেইতো তার সভার মন্ত্রী এবং সভাসদ গণ তাদের রাজাকে কোটি প্রশংসায়
আপ্যায়িত করেছিল। মূর্খ চামারটা কি পারতো শিক্ষিত মন্ত্রীদের মতো গুছিয়ে
কথা বলতে? সে সব কথার প্যাঁচ-পয়জারই জানতো না সে।"
এতোখানি বলে বিষ্টুদা থামলো, একবার আমার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে একটু গলা
নামিয়ে বলল, "আমার মনে হয় উমা, ওই চামারটা নিশ্চয়ই বিদ্বান ছিল। এমনি এক
সম্রাটের কথা পড়েছি, যে নিজের নামটাও লিখতে পারতো না।
তবে সে 'বিদ্বান' ছিল নিশ্চয়, নইলে আরবী, ফার্সী, উর্দু, পালি, পার্সী,
সংস্কৃতজ্ঞ- সব কটা হেঁকো ডেকো শিক্ষিত পণ্ডিতদের এক গোয়ালে তুলেছিল
কিভাবে? আর এই সব শিক্ষিত-কুলতিলক-কুলকে (সে সর্ব বিদ্যাবিশারদ রাজাধিরাজ
হবুচন্দ্রই হোন কিংবা শাহেন-শাহ মহামতি আকবর) সবারই পছন্দ। কেননা এরা
বিহনে, দেশশাসন নামক চরকায় সুতো কাটবে কেডা?
শিক্ষা দান, হিসাব রক্ষা, জমা-খরচ, কল-কারখানা, খেতি-বাড়ী,
ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর ট্যাক্সো, নজরদারী, তদুপরি জাবদাখাতার মার্জিনের
বাইরের হিসেব? এসব তো অশিক্ষিত/গোমুখ্যদের কাজ না।
বদমাস, চোর ইত্যাদি ধরতে পেয়াদা-পুলিশ চাই। তাদেরকে তো শিক্ষিত হতেই হবে,
নচেৎ চুরির মাল সরাবে কে? আজকের জমানাতেও চুরির মাল কটা ফেরত পাওয়া যায়
বলতে পারিস? কাজে কাজেই সুউপায়ী হতে হলে সুশিক্ষিত হতেই হবে বুঝলি? আর
ভয়টা ওদের ঐখানেই।
জাবদা খাতার বাইরে যা রইলো, তা যদি কোনো 'দুধ চোর' বিড়াল' দেখে ফেলে?
তাইতো বলি ভাই, বিদ্বান আর শিক্ষিতের তফাৎ অনেক, বোঝাও অনেক কঠিন।
ধর না, সেই মূর্খ কালিদাসের কথা? রাজকন্যা তো তার মূর্খামী ধরে ফেলে,
বাসর ঘর থেকেই বিদায় করে দিয়েছিল। তাতে সে মূর্খের কি এলো গেলো?
ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা তুলে ঘোরাতে ঘোরাতে বিছুদা বেশ জোর দিয়েই বললো,
"কিচ্ছুটি নয়। তারপর কি হলো বল?"
আমি আর কি বলবো? বিষ্টুদার কথার অর্ধেক বুঝি তো বাকিটা ঘন কুয়াসায় ঝাপসা।
তাই নিজ বিদ্যা আর জাহির না করে নিজেকে সঁপে দিই বিষ্টুদার জিম্মায়। বলি,
"শুনতে বেশ ভাল লাগছে, একটু সহজ করে বলো না দাদা?"
বিষ্টুদা হয়তো এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি। মৃদু উত্তেজিত হয়ে স্বগতোক্তির
ঢঙে বলে উঠলো, হবে আবার কি, হলোই বা কি। মার কাটারি মার্কা চার চারখানা
মহাপ্রলয় বাদ্য- বাদনরঞ্জিত দিকবধূ-হাস্য কলরোল-মুখরিত বিশ্বশ্রেষ্ঠ
কাব্যপোন্যাস ছাড়লো তো? একেই বলে বিদ্বান, বুঝলি?
এ কিন্তু একালের 'ঝড়ের জলে কাকের ডানার ছাতা' বা 'চোডের ধোঁয়ায় দেখি হয়
তোমার মুখ' মার্কা শিক্ষিত কর্বিদের কাব্য নয়, জানবি? বিষ্টুদা থামলো।
এই পর্যন্ত শুনেই আমি আমার শিশুকালের হাতেখড়ির পর থেকে আজ পর্যন্ত লেখা
পড়ার ফর্দ মেলাতে মেলাতে সব গুলিয়ে ফেললাম। অতি কষ্টে নিজেকে সামলে জানতে
চাইলাম, দাদা, নেপথ্য কাহিনীটাতো বললে না, তুমিই তো বল, আমার মাথায়
বৃষপুরীষ (ষাঁড়ের গোবর), জানোতো, সহজে বুঝতে পারি না। একটু খুলে বল না
দাদা?
বিষ্টুদা শ্যেনদৃষ্টিতে আমাকে যেন একবার যাচাই করে নিল; তারপর কি ভেবে
বললো, হ্যাঁ হ্যাঁ, সত্যিতো, তোরা এসব জানবিই বা কি করে? "এ প্লাস বি হোল
স্কোয়ার" মার্কা গোলোক ধাঁধায় মুখ থুবড়ে শিক্ষালাভ করেছিস তো; না হলি
কেরানী, না হলি এম.এল.এ। হলি কিনা রুপোর স্যাকরা, তোকে বলা বৃথা।"
এবার আমি জিদ ধরে বসলাম। বললাম, বিষ্টুদা, আমি কিন্তু আজ তোমার গল্পের
শেষ শুনেই উঠবো। বিষ্ণুদা মৃদু হাসলো, তার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, সে
যেন সুদূর অতীতের কোন জ্যোৎস্না-স্নাত রাজপ্রাসাদের আলো ঝলমল গবাক্ষ পথে
উঁকি দিচ্ছে। আনমনা ভাবেই বললো, শোন তবে বলি, আজ আছি, কালতো নাও থাকতে
পারি, কেউতো আর জানতে বা শুনতে চায় না, তবু তুই যখন চাইছিস, বলি শোন,
"সেই যে স্বয়ম্ভর সভার সকল প্রকার মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান পর্ব সমাপান্তে
শিক্ষিতা রাজকন্যা ভালই বুঝেছিল যে সে মহামূঢ় কালিদাসকে স্বীয় পতি রূপে
বরণ করে নিদারুণ ভাবে প্রবঞ্চিত হয়েছে। বিবাহ অনুষ্ঠানে, নিজ মূঢ়তার
প্রকাশ না করে, শয়ন বাসরে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে কটু-কটাক্ষ করে নবপতি
কালিদাসকে সবার অলক্ষ্যে প্রাসাদ থেকে দূর করে দেয়। সোজা কথায় আপদ বিদেয়
করে দেয়।" এমনি আকাট সেই মূর্খ (কালিদাস), এতবড় অপমানের বুঝলো ছাই?
সারাদিনের আপ্যায়ন, আভরণ, রাজগৃহের ভাল ভাল খাদ্যাদি ভক্ষণের আনন্দে সে
তখন বিভোর। গলায় তখনো তার ঝুলছে সুগন্ধি ফুলের মালা। দিলখোলা আনন্দে,
"কুলের বালা পুকুর ঘাটে/গা ডুবিয়ে সাঁতার কাটে জাতীয় খেউড় গান, বেসুরো
গলায় গাইতে গাইতে বনপথে ফিরছিল আপন ডেরায়।
ওদিকে, স্বয়ম্বর সভায় রাজকন্যা কর্তৃক অপমানিত তিন পণ্ডিত অরণ্যপ্রান্তে
রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্যে বিশ্রামরত এবং কালিদাসের ফিরে আসার ক্ষণ নির্ণয়ে
মৃদুমন্দ শিখা সঞ্চালনে তর্করত ছিলেন।
সহসা কালিদাসের বেতালা রাগের মূর্ছনায় পুলকিত হয়ে, তাকে কাছে ডেকে
শুধালো, "কিহে কালিদাস রাজমহলের সুকোমল বাসরশয্যা ছেড়ে এতো রাতে যাচ্ছো
কোথায়???
বলি, বিদূষী রাজকন্যার রূপের ছটা কি তোমায় মাতাল করেনি? তোমার কথায় কি
তিনি সম্মোহিত হননি। নাকি তিনি নারীবেশে অর্ধনারী?
কালিদাস পণ্ডিত মহাশয়দের এহেন ভাষার চাতুরী বা অর্থ বুঝবে কি, ভুরিভোজনের
আনন্দে তখনো সে হেসেই সারা।
গণ্ডিতেরা সেই হাসি দেখে 'অব্যর্থ' কিছু বুঝেছিল। কালক্ষয় না করে, চার
শব্দের একটি 'বাক্য' শিখিয়ে কালিদাসকে সেই রাতেই পুনরায় রাজকন্যা সমীপে
ফিরে যেতে প্রলোভিত করে। সে মূর্খ পন্ডিতাদেশ মাথায় নিয়ে রাত্রি তৃতীয়
প্রহরে হাজির হয় চন্দ্রপ্রভার নিকট। রাজকন্যা চন্দ্রপ্রভা সম্ভবত নিজ
জ্ঞান বিদ্যার চাতুরী হীনতায় মূহ্যমান। আগামী প্রাতের পরিদৃশ্যমান অনুভবি
চিন্তা ও আশঙ্কায় নিদ্রাহীন সন্ত্রস্ত হরিণীর ন্যায়, অলিন্দে চঞ্চল পদে
বিচরণ করিতেছিল। তখনই গবাক্ষপথে, নিকটে লজ্জাহীন কালিদাসের উপস্থিতি তাকে
যুগপত ক্রুদ্ধ এবং কৌতূহলী করে তোলে। দরজা খুলে সামনে অপেক্ষারত
কালিদাসকে রূঢ়কণ্ঠে প্রশ্ন করে, কি তার উদ্দেশ্য? কেনই বা সে সেখানে এসে
দাঁড়িয়েছে।
কালিদাসের উত্তরের অপেক্ষা না করেই দ্রুততার সঙ্গে প্রাসাদ প্রহরীদের
আদেশ দেয় যে তারা যেন দ্রুত কালিদাসের জামাতাবেশ খুলে, তাকে প্রাসাদের
বাইরে বার করে দেয়, তবেই ওই নির্লজ্জ-মুখটার প্রাসাদে ঢোকার পথ বন্ধ
হবে।
প্রহরীগণ আদেশ পালনে যত্নবান হলে, কালিদাস, স্বীয় পত্নী চন্দ্রপ্রভার
উদ্দেশ্যে দ্রুততার সঙ্গে পণ্ডিত গণের শেখানো সেই বাক্য বলেছিল, "অস্তি,
কশ্চিৎ বাক্ বিশেষ" (তোমাকে বিশেষ কিছু বলার আছে)।
মুহূর্তে রাজকন্যার কাছে সমগ্র চিত্র পরিষ্কার হয়ে যায়, অবহেলে সে বুঝে
নেয় যে 'ঐ বাক্য' বলার এলেম এর নেই। বাক্যটি নিশ্চয়ই স্বয়ম্বর সভায়
অপমানিত সেই পণ্ডিতগণের শেখানো বুলি। নিমেষে চন্দ্রপ্রভার মস্তিষ্কের
মধ্যে বিদ্যুৎ খেলে গেল; অতিকষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ক্রোধাগ্নি পূরিত
সাশ্রুনয়নে সম্মুখে দণ্ডায়মান কালিদাসকে ব্যসাচ্ছলে উত্তর দিয়েছিল যে,
"সে যেদিন ঐ চার শব্দ সমন্বয়ে চারখানি মহাকাব্য রচনা করতে সক্ষম হবে,
সেদিনই যেন ফিরে আসে,' রাজকুমারী সেদিনের অপেক্ষায় থাকবে, অন্যথায় এমন
'প্রহসন' নিমিত্ত তার কারাবাস অবশ্যম্ভাবী।
এই পর্যন্ত বলে বিঈদা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালো। আমি তো চুপ। রেশ
টেনে বিষ্টুদা বললো, "এবার, বুঝলি তো, শিক্ষিত (?) বিদ্বান (?) মূর্খের
তফাৎটা কেমন। আর মহাকবি কালিদাস পরবর্তী কালে অতি অধ্যাবসয় সহকারে ওই
চারটি শব্দযোগে যে চারখানি বিশ্বশ্রেষ্ঠ কাব্য রচনা করেছিলেন, তাহা
নিম্নরূপ "অস্তি কশ্চিৎ বাক বিশেষ:"
১. 'অস্তি উত্তারাসাত দিপি দেবাত্মা... (কুমারসম্ভব)
২. কশ্চিদকান্তা বিরহ গুরুণা... (মেঘদূত)
৩. বাগার্থারিব সংপৃক্ত বাগার্থ... (রঘুবংশ)
৪. বিশেষসূর্য্যস্পৃহণীয়চন্দ্রমা... (ঋতুসংহার)